মানুষের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যকে পাত্তা দেননি তিনি। টার্গেট পূরণে এগিয়ে গেছেন সামনে। শুনেছেন ‘পাগলী’ কটূক্তিও। তারপরও পেছনে ফিরে আসেননি। মানুষের জন্য, পরিবারের জন্য, নিজের জন্য তার লড়াইয়ে কাউকে পাশে পাননি। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আজ তিনি সফলতার এক ছবি। এখন পরিবারও পাশে আছে, মানুষজনও তার সাথী। এ জন্য তাকে কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে অনেক।
মানুষের মুখে নিরাপদ ও বিষমুক্ত খাবার তুলে দিতেই তার এ সংগ্রাম। লড়াই। তিনি কাকলী খান। শুদ্ধ কৃষিপণ্য উৎপাদনে কৃষকের এক আপনজন।
কীভাবে মাথায় এলো শুদ্ধ কৃষিপণ্য উৎপাদনের চিন্তা? সে এক বিরাট কাহিনী। এক দশক আগের কথা।
শুরুটা ছিল নিজ পরিবারের এক সদস্যের দুটি কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঘটনা থেকে। ২০০৯ সালে তার ফুপু কিডনিজনিত রোগে আক্রান্ত হন। চিকিৎসকরা জানান, তার দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। রোগ ধরা পড়ার এক মাসের মধ্যেই তিনি ফুপুকে হারান। তার চিকিৎসা করার পর্যাপ্ত সময়টুকু পায়নি পরিবার। ফুপুর এই অকস্মাৎ মৃত্যু পুরো পরিবারকে শোকগ্রস্ত করে। কিন্তু কেন এই অকস্মাৎ মৃত্যু? কেন দুটি কিডনিই অকালে নষ্ট হয়ে যাওয়া? এমন এন্তার প্রশ্ন কাকলীকে ভাবায়।
চিকিৎসকদের কাছে এর উত্তর খুঁজেন তিনি। খাদ্যের মধ্যে বিষ ছড়িয়ে তা কতটা ক্ষতি করছে আমাদের পাকস্থলী আর কিডনির তা তিনি জানেন। এর প্রতিকার কী হতে পারে? আমাদের কোটি কোটি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা কীভাবে পাওয়া যেতে পারে? তার উত্তরে একটাই পথ, তা হলো নিরাপদ খাদ্য, বিষমুক্ত বা ফরমালিন মুক্ত খাদ্য। আর তা নিশ্চিতে কাজ শুরু করতে হবে ঘর থেকেই।
স্মরণীয় এক অভিজ্ঞতার কথাও বললেন। দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত এক মা হাসপাতালে শয্যাশায়ী। পরিবারের উৎকণ্ঠা। নানান পরীক্ষা চলছে। গাদাগাদা ওষুধের ভিড়ে চাওয়া একটাই ফরমালিন ছাড়া আম। কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে ফরমালিন মুক্ত আম। বাজার বোঝাই বিষযুক্ত আম। অভিযান চলছে সর্বত্র। মানুষ ক্যামিকেলে ভরা আম খেয়ে পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হচ্ছে, পাকস্থলী বিগড়ে যাচ্ছে। এরইমধ্যে সেই শয্যাশায়ী মায়ের স্বজনদের মাথায় এলো, শুদ্ধ কৃষির কথা। সেদিন বিষমুক্ত আম নিয়ে সেই মায়ের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন কাকলী। এক দশক আগের সেই ঘটনা তাকে এখনো ভাবায়। প্রেরণা যোগায় নিরাপদ খাদ্যের লড়াইয়ে।
শুরুর কথা: স্বপ্ন থেকে লড়াই। ভেজালের বিরুদ্ধে লড়ার কথা পরিবারের সদস্যদের জানান। একেকজন একেকভাবে নেন। পরিবারের বাইরেও অনেকেই নেতিবাচক কথা বলেন। কিন্তু কাকলী অটল। কাউকে না পাওয়া গেলে একাই পথে নামবেন। শুরুতে অনেকেই পাগলামি করছেন বলেও বলেছেন। কাকলী ভেজাল খাবার থেকে মানুষকে কীভাবে রক্ষা করা যায় সে উপায় নিয়ে ভাবতে লাগলেন। কেমিক্যাল মেশানো ভেজাল খাবারের ভিড়ে নিরাপদ খাদ্যের যোগান দিতে হলে মাঠে যেতে হবে। যারা ক্ষেত-খামারে চাষ করেন তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কুষ্টিয়ার গ্রামের পরিবেশে বেড়ে ওঠা কাকলী ছোটবেলা থেকেই কৃষকের শাক-সবজি, ফলমূল, শস্য উৎপাদন করা দেখে দেখে বড় হয়েছেন। কিন্তু শহরে তো আর তা সম্ভব নয়। চিন্তা করলেন, নিজেই জৈব সারের মাধ্যমে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে অর্থাৎ অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষ শুরু করবেন।
যেই কথা সেই কাজ। প্রথমেই নিজ এলাকা কুষ্টিয়ার পরিচিত কৃষক যারা জৈব সার ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করেন তাদের কাছ থেকে নিজ পরিবারের জন্য খাদ্যপণ্য সংগ্রহ করেন। এক সময় ওখানকার এক আত্মীয়ের খামারও করেছিলেন কাকলী। তবে বছরখানেকের মধ্যে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে চুয়াডাঙ্গায় তার মামার বাড়িতে আরো একটা খামার করেন। ঢাকা থেকে সেখানে গিয়ে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। একসময় সেটিও বন্ধ হয়ে যায়।
বার বার বাধার মুখে পড়লেও থেমে যাননি। যেখানেই নিরাপদ খাদ্যের সন্ধান পেয়েছেন, সেখানেই ছুটে গেছেন অদম্য এই উদ্যোক্তা। মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকেছেন অসংখ্যবার। তবু ছুটে গেছেন বিভিন্ন গ্রামে, জেলায় জেলায়। বিভিন্ন এলাকায় কৃষকদের বোঝাতে শুরু করেন জৈব পদ্ধতির চাষাবাদের কথা। প্রথমদিকে অনেকেই ফিরিয়ে দিয়েছেন। অনেক স্থানে নিজ স্বার্থে কাজ করছেন বলে অপমানিতও হয়েছেন। আবার কোথাও কোথাও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। এভাবে এসব জেলার সঙ্গে একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেন। সেসব জেলার খামারিদের কাছ থেকে জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফসল নিয়মিত নিয়ে আসেন ঢাকায়।
সময় বদলায়। একসময় পরিবার পাশে দাঁড়ায়। এগিয়ে আসে এই উদ্যোগে। আস্তে আস্তে স্বামী, ভাই, বাবা যুক্ত হন তার উদ্যোগের সঙ্গে। চলার পথে সহযোগী হিসেবে নানানভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন তার বন্ধু-বান্ধব ও শুভাকাক্সক্ষীরাও। নিয়মিত এভাবেই চলতে থাকলে উদ্যোগটা। আত্মীয় ও পরিচিতজনদের কাছ থেকেও প্রশংসা পায়। একপর্যায়ে পরিচিতজনরা তাদের জন্যও অর্গানিক খাদ্যপণ্য সংগ্রহ করে দেয়ার আবদার করতে থাকেন। সেই আবদারের ফলাফলই কাকলীর আজকের ‘শুদ্ধ কৃষি’।
যেভাবে শুদ্ধ কৃষি কাজ করে: এই এক দশকে কাকলী খান ঘুরে বেড়িয়েছেন গ্রামবাংলায়। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া। যেখানে যে পণ্য উৎপাদিত হয় তা যেন জৈব সারে হয় তা নিশ্চিত করেন। সকল স্থানের পণ্য ঢাকার বাইরে থেকে পরিবহনে আনেন। তাছাড়া নিজ উদ্যোগে ঢাকার কেরানীগঞ্জের রুহিতপুরে ১২ বিঘা জমির ওপর গড়ে তুলেছেন নিরাপদ খাদ্যের খামারও। এ ছাড়া ঝিনাইদহের আলম ডাঙ্গায় নিজেদের একটি খাদ্য গুদাম রয়েছে। যেখানে চারপাশের কৃষক তাদের ভেজালমুক্ত খাদ্যশস্য নিয়ে আসেন। সেখান থেকে আসে রাজধানীতে। এভাবেই শুদ্ধ কৃষি কাজ করে নিরাপদ খাদ্য সরবরাহে।
বর্তমানে রাজধানীর গ্রিন রোড, ধানমণ্ডি ইউনিমার্ট ও গুলশানে তিনটি আউটলেট গড়ে উঠেছে শুদ্ধ কৃষির। এই নিরাপদ খাদ্যের লড়াইয়ের সঙ্গে শরিক হয়ে ইউনিমার্ট শুদ্ধ কৃষির আউটলেটের জন্য কোনো ভাড়াই নিচ্ছে না। রাজধানীর গ্রিন রোডে অবস্থিত কমফোর্ট হাসপাতালের বিপরীতে এবং ধানম-ি ক্লিনিকের নিচতলায় শুদ্ধ কৃষির বিপণনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা প্রাকৃতিক ও জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত কৃষিপণ্য এখানেই বিক্রি হয়। শুদ্ধ কৃষির বিক্রয়কেন্দ্রটি খোলা থাকে সপ্তাহের সাতদিনই। শুক্র ও মঙ্গলবার হচ্ছে শুদ্ধ কৃষির হাটবার। এই দুই দিন গ্রামের হাটের মতোই এখানে মাছ, মাংস, সবজি, চাল, ডাল থেকে শুরু করে নানারকম কৃষিপণ্য থাকে। গ্রিন রোডের আউটলেটে কিডনি এবং ক্যানসার রোগীর পরিবারের জন্য ২০ শতাংশ কমদামে পণ্য কেনার সুযোগ রয়েছে।
কাকলীর কথা: শুরুতেই বিরক্তি প্রকাশ করেন যারা বলেন, গতানুগতিকতার বাইরে কাজ করছেন তাদের নিয়ে। কাকলী বলেন, এটাই তো আমাদের সত্যিকার কৃষিকাজ। এটাই মূলধারা। কাজেই এই কৃষিকাজ গতানুগতিকতার বাইরে হবে কেন? হাইব্রিড কৃষি পরে যুক্ত হয়েছে। নানান রকম রাসায়নিক পদার্থ আগে ছিল না। লোকে প্রথমদিকে আমাকে পাগল বলতো। অনেকে সবজিওয়ালিও ডেকেছে। বলতো, ওনি পাগলামি শুরু করেছেন। সম্ভ্রান্ত পরিবারের বউ। শহরের মেয়ে এটা কেন করবে? সবাই আমাকে উদ্ভট মন্তব্য করে থামাতে চেয়েছে। কৃষকও প্রথমদিকে আমাকে সহজভাবে নেয়নি। ধীরে ধীরে বৃত্ত ভাঙার লড়াইটা শুরু করি।
ঝিনাইদহের আলমডাঙ্গার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, সেখানে বাড়ির গৃহিণীরা তাদের আঙ্গিনায় যেসব ফল হয় তার উদ্বৃত্তটুকু আমাদের কাছে বিক্রয় করে। দেখা গেছে, কারও গাছে ১০টি লাউ হয়েছে। কিন্তু তার পরিবারে ৪টি লাউ দরকার। বাকি ৬টি তিনি আমাদের কাছে বিক্রয় করে দেন। এই শস্যগুলো পুরোপুরি জৈব সারে উৎপাদিত। একটি বিষয় লক্ষণীয়, যে নারীরা এই পণ্যগুলো আমাদের কাছে নিয়ে আসে তাদের পক্ষে এগুলো বাজারে নিয়ে বিক্রয় করা সম্ভব নয়। তারা শুদ্ধ কৃষির কাছে তা তুলে দিয়ে নিজেরা স্বাবলম্বী হচ্ছে আবার দেশের প্রতি দায়িত্বও পালন করছে। একটি বিষয় হচ্ছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শুদ্ধ কৃষির পণ্য একটু দাম বেশি পড়ে। কারণ, যে কৃষক জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেন তাতে তারও খরচ বেশি পড়ে। আর ফসলও কম হয়। কাজেই নিরাপদ খাদ্যের দাম কিছুটা বেশি পড়ে।
অতিমাত্রায় পেস্টিসাইড ও নানা ধরনের রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি দিনদিন তলানিতে ঠেকেছে। এ মুহূর্তে জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে খুব একটা ফলন হবে না। জৈব পদ্ধতির চাষে ফলন পেতে জমির উর্বরতা বাড়াতে হবে। আর তা করতে ন্যূনপক্ষে তিন বছর সময় লাগে।
কেন শুদ্ধ কৃষি: দু’দিনের এই দুনিয়ায় আমরা বাড়ি-গাড়ি কতকিছু করছি। কিন্তু নিজেদের শরীরের জন্য কি সঞ্চয় করছি? আমার সন্তানের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তার জন্য নিরাপদ খাদ্যের প্রয়োজন এটা কি ভাবছি? আমরা নানা ধরনের ভেজাল খাবারে আমাদের শরীরের বারোটা বাজাচ্ছি। অথচ একটু বেশি খরচ হলেও নিরাপদ খাদ্য আমাদের সুস্থ রাখবে তা করতে অনেক সময়ই কার্পণ্য করছি। দিনবদলে সক্রিয় হচ্ছি না। এ জায়গাগুলো নিয়ে অনেকেই সচেতনভাবে এগিয়ে আসছি না।
আশার কথা শোনালেন কাকলী, এক দশকে অনেক বদলেছে মানুষ। এখন নিরাপদ খাদ্যের ব্যাপারে মানুষ যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি সচেতন। এক দশক আগে যখন শুদ্ধ কৃষির লড়াই শুরু করি তখন আমি মানুষকে খুঁজতাম। আর এখন মানুষ আমাকে খুঁজে। তবে এই উদ্যোগের সফলতা পেতে প্রয়োজন যৌথ উদ্যোগ। তাগিদও অনুভব করেন তিনি। বলেন, এলাকাভিত্তিক নিরাপদ খাদ্যের গুদাম গড়ে তোলা দরকার। তাহলে যারা নিরাপদ খাদ্য নিয়ে কাজ করবেন সকলেই সেখানে তাদের খাদ্যপণ্য মজুত করবেন। আর এ ব্যবস্থায় পণ্যের দামও অনেক কমে আসবে।
শেষকথা- আমরা যারা সচেতন, যাদের বিবেক আছে, আমাদের একটু ভাবতে হবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করার জন্য হাতে হাত মিলে কাজ করতে হবে। আমরা যদি কৃষকের হাতে ন্যায্য মূল্য তুলে দেই তাহলেই কৃষকও নিরাপদ খাবার তুলে দেবে।