থমথমে লিবিয়া। বারুদের গন্ধে ত্রিপোলিতে অন্য এক পরিবেশ। বিদেশি অনেক মিশন অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ দূতাবাস এখনো আছে। দূতাবাস এলাকার কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপগুলোর মধ্যে গোলাগুলি চলছে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানালেন বাংলাদেশ দূতাবাসের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তবে তারা এখনো নিরাপদে আছেন। যুদ্ধকবলিত দেশটিতে থাকা প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশির নিরাপত্তা নিয়েই তাদের যত উদ্বেগ-দুশ্চিন্তা।
লিবিয়া পরিস্থিতি নিয়ে টেলিফোন আলাপে ত্রিপোলিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ সিকান্দার আলী গতকাল মানবজমিনকে বলেন, সাত মাস ধরে লিবিয়া পরিস্থিতি উত্তপ্ত। কিন্তু এটি এখন বিধ্বংসী রূপ নিয়েছে। সর্বশেষ বিমান হামলার ঘটনাটি ঘটেছে ত্রিপলীতেই। ওই ঘটনায় ৫ জন বাংলাদেশি নিহত হওয়ার ‘উড়ো’ খবরে উদ্বিগ্ন দূতাবাস কর্মকর্তাদের মধ্যে রীতিমত আতঙ্ক ছড়িয়েছিল।
কিন্তু না, তাৎক্ষণিক ছুটাছুটি আর ব্যাপক অনুসন্ধানে এটা নিশ্চিত যে, সোমবারের ওই হামলায় দুই লিবিয়ানসহ বিভিন্ন দেশের ৭জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে একজন বাংলাদেশি রয়েছে। দূতাবাস কর্মকর্তারা হাসপাতালে তার মৃতদেহ শনাক্ত করেছেন। ওই বাংলাদেশির নাম আবুল হাসান ওরফে বাবু লাল বলে নিশ্চিত হয়েছে দূতাবাস। তিনি রাজশাহী জেলার বাগমারা উপজেলার বাসিন্দা। রাষ্ট্রদূত আরও জানান, ড্রোন হামলায় আহতদের মধ্যে ১৫জন বাংলাদেশি রয়েছেন। বিভিন্ন হাসপাতালে তাদের চিকিৎসা চলছে। এরমধ্যে দু’জন- কুমিল্লার ইমন এবং ঝিনাইদহের মোহাব্বত আলীর অবস্থা গুরুতর। আশংকাজনক অবস্থায় আইসিইউতে তাদের চিকিৎসা চলছে। আইসিইউতে চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে ২৪ ঘণ্টা পার হয়েছে। তাদের অবস্থা প্রায় অপরিবর্তিত। দূতাবাস কর্মকর্তারা হাসপাতালগুলোতে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। যুদ্ধকবলিত দেশটিতে মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশিদের দেশে ফেরাতে দূতাবাস নতুন কোন নোটিশ জারি করেছে কি-না? রাষ্ট্রদূত বলেন, সাত মাস আগেই তারা বাংলাদেশিদের প্রতি একটি নোটিশ জারি করেছেন। এটি এখনও বলবৎ আছে। এদিকে দূতাবাসের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, ঢাকার তরফেও লিবিয়া ভ্রমণে বাংলাদেশিদের নিরুৎসাহিত করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে এ নিয়ে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। যুদ্ধাবস্থা প্রলম্বিত হওয়ায় অনেকে এরই মধ্যে দেশে ফিরে গেছেন জানিয়ে ত্রিপলী মিশনের ওই কর্মকর্তা বলেন, সাত মাসে প্রায় ৫০০ বাংলাদেশি লিবিয়া ছেড়ে গেছেন। এর মধ্যে ৩৪০ জন ফিরেছেন দূতাবাস এবং আইওএম এর মাধ্যমে। যাদের একটি অংশ যুদ্ধাবস্থার সূযোগ নিয়ে সাগর পথে ইউরোপ পাড়ি দেয়ার চেষ্টায় ধরা পড়েছেন, না হয় সাগর থেকে কোন মতে জীবিত উদ্ধার হয়েছেন। চলতি মাসে সাগর থেকে জীবিত উদ্ধার ১৭১ জন বাংলাদেশি এখন দেশে ফেরার অপেক্ষায় কারাগারে রয়েছেন। এ রিপোর্ট লেখার মুহুর্তে তাদের ফেরতের প্রক্রিয়া নিয়ে তিউনিশিয়ায় স্থানান্তরিত হওয়া আইওএম প্রতিনিধির সঙ্গে ত্রিপলীতে দূতাবাসের বৈঠক চলছিলো।
বিমান হামলার বিস্তারিত রাষ্ট্রদূতের বার্তায়: এদিকে হামলার বিস্তারিত জানিয়ে মানবজমিনকে পাঠানো এক বার্তায় রাষ্ট্রদূত বলেন- ১৮ই নভেম্বর সকালে ত্রিপলীর ওয়াদি রাবিয়া এলাকার একটি বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে ড্রোন হামলায় ৭ জন শ্রমিক নিহত এবং ৩০ জন আহত হয়েছেন বলে খবর পান। দূতাবাসের তরফে তাৎক্ষনিকভাবে ‘সানবুলাহ বিস্কুট ফ্যাক্টরি’ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা জানান, হতাহত সব শ্রমিককে ত্রিপলীর বিভিন্ন হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। তাদের দেয়া তথ্য মতে দূতাবাসের প্রতিনিধিরা তাজুরা হার্ট হসপিটাল, ত্রিপলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সারে জাওইয়া কেন্দ্রীয় হাসপাতাল এবং আবু সেলিম হাসপাতাল পরিদর্শন করেন।
ওই হাসপাতালগুলোতে নিহত ৬ জনের লাশ ছিল। বাকী একটি লাশ অন্যত্র ছিল। এরমধ্যে রাজশাহীর আবুল হাসান ওরফে বাবু লাল নামে একজন বাংলাদেশি নাগরিকের মৃতদেহ সনাক্ত করা হয়। নিহত অন্য ৫ জনের মধ্যে দুই জন লিবীয়ার নাগরিক এবং ৩ জন আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের শ্রমিক বলে লিবিয়া কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ দূতাবাসকে নিশ্চিত করে। বাকী একজনের পরিচয় পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি, তবে তিনি বাংলাদেশি নন এটা নিশ্চিত করেন রাষ্ট্রদূত। উল্লেখ্য লিবিয়ান কর্তৃপক্ষের বরাতে পাঁচ বাংলাদেশিসহ অন্তত সাত জন নিহত হয়েছেন মর্মে সোমবার সন্ধ্যায় আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে রিপোর্ট ছড়িয়ে পড়লে ঢাকায় উদ্বেগ দেখা দেয়। এ নিয়ে অনলাইনে একটি ভিডিও ছড়িয়ে যায় মুহুর্তেই। যাতে দেখা যায়, পায়ে আঘাত পাওয়া কয়েকজনকে ব্যান্ডেজ পরিয়ে স্ট্রেচারে করে এম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে হাফতার নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়াদের সঙ্গে লিবিয়া সরকারের ধারাবাহিক রক্তক্ষয়ী সংঘাত-সংঘর্ষ চলছে।