× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ইকোনমিস্টের রিপোর্ট /অসমর্থনযোগ্যের পক্ষাবলম্বন, সুচি কেন হেগে গেলেন!

বিশ্বজমিন

মানবজমিন ডেস্ক
(৪ বছর আগে) ডিসেম্বর ৯, ২০১৯, সোমবার, ১২:০২ অপরাহ্ন

এটা করার দরকার ছিল না তার। প্রকৃতপক্ষে মিয়ানমারের বেসামরিক নেত্রী অং সান সুচি যখন ঘোষণা করলেন যে, তিনি গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) ব্যক্তিগতভাবে এ সপ্তাহে উপস্থিত হয়ে দেশের পক্ষে কথা বলবেন, তখন তার এই কথাটি ছিল ভীষণ মাত্রার বেদনার। জাতিসংঘ তার রিপোর্টে অভিযোগ করেছে, ২০১৭ সাল থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতন চালিয়ে আসছে। এর ফলে বাধ্য হয়ে কমপক্ষে ৭ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু জাতিসংঘের এই রিপোর্ট সরাসরি প্রত্যাখ্যান করছে মিয়ানমার। আইসিজেতে রাষ্ট্রকে অবশ্যই একজন এজেন্টকে মনোনয়ন দিতে হয় মামলা লড়ার জন্য। তবে এই ভূমিকা সাধারণত পালন করে থাকেন এটর্নি জেনারেল অথবা আইনমন্ত্রীরা।

৫৭টি মুসলিম দেশের সংগঠন ওআইসির পক্ষে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা করেছে আফ্রিকার ছোট্ট দেশ গাম্বিয়া।
এটা সত্য যে, এই গণহত্যার অভিযোগ সাদামাটাভাবে এড়িয়ে যেতে পারে না মিয়ানমার। জাতিসংঘের একটি সদস্য দেশ মিয়ানমার। আবার জাতিসংঘেরই সর্বোচ্চ আদালত আইসিজে। কৌশলগতভাবে স্টেট কাউন্সেলর এবং মিয়ানমারের প্রকৃত নেত্রী অং সান সুচি এই শুনানিতে একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সক্ষমতা নিয়ে যাচ্ছেন। তাকে এক সময় বিশ্ব দেখতো একজন হিরোইন বা বীরাঙ্গনা হিসেবে, যিনি ১৯৯১ সালে সামরিকজান্তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের স্বীকৃতিস্বরূপ শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন। বিশ্ব সেই বিষয়টিকে স্মরণে নিয়ে বিস্মিত যে, কেন তিনি এখন নিজের সেই প্রেস্টিজ এবং ক্যারিশমা জেনারেলদের পিছনে খরচ করছেন।

এর কারণ হয়তো নিহিত আছে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। আগামী নভেম্বরে সেখানে জাতীয় নির্বাচন। সেই দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন অং সান সুচি। তিনি হয়তো হিসাব কষে দেখেছেন যে, আইসিজের মামলা তাকে রাজনৈতিক সুবিধা দেবে। ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ইতিহাসবেত্তা মেরি ক্যালাহান মনে করেন, গাম্বিয়ার মামলাটিকে সুচি ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছেন। এর কারণ, এটা করে তিনি বিরোধীদের কাছ থেকে জাতিকে রক্ষাকবজ নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেন। এই বিরোধী পক্ষে আছে সেনাবাহিনী সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (এইএসডিপি)।

ওই বিরোধীদের লক্ষ্য ছিল দেশকে রক্ষার জন্য তারাই সক্ষম একক দল এমন প্রচারণা চালানো। কিন্তু সুচি যখন ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনিই মামলার শুনানিতে হেগে যাচ্ছেন, তখন ওই বিরোধীরা যেন নীরব হয়ে মৃত অবস্থা নিয়েছে। ক্যালাহান বলেন, পক্ষান্তরে সুচির সমর্থকরা পুরো অ্যাকশনে মাঠে নেমে পড়েছেন। তিনি ওই ঘোষণা দেয়ার কয়েক দিন এবং সপ্তাহের মধ্যে ইয়াঙ্গুনে সুচির র‌্যালিতে হাজার হাজার মানুষ যোগ দিয়েছেন। তাদের অনেকের হাতে একটি বাক্য লেখা ব্যানার ছিল। তা হলো ‘উই স্ট্যান্ড উইথ ইউ, মাদার সু’। অর্থাৎ আমরা আপনার সঙ্গে আছি মা সু(চি)।

মিসেস ক্যালাহান ও অন্য পর্যবেক্ষকরা বিশ্বাস করেন, হেগের শুনানিতে যাওয়ার জন্য সুচির প্রাথমিক উদ্দেশ্য তার ব্যক্তিগত। তার জীবনের কাহিনী সব সময়ই তার দেশের সঙ্গে যেন জড়িয়ে আছে। বৃটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে তার পিতা অং সান ছিলেন বিপ্লবী বীর। তাকে জাতিরজনক হিসেবে মানা হয়। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীরও প্রতিষ্ঠাতা বলে অনেক সময় বলে থাকেন সুচি। তিনি দাবি করেন, তার পিতা জাতি গঠনের যে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি সেই কাজটি করে যাচ্ছেন এবং এই জাতিকে রক্ষা করছেন। তাই মিসেস ক্যালাহানের ধারণা, তিনি যখন জানতে পারলেন যে, গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করছে, সম্ভবত এ নিয়ে দ্বিতীয় চিন্তা করেন নি সুচি। তার সেই চিন্তা হলো- তিনি দেশের ব্যক্তিত্ব (পারসোনিফিকেশন অব দ্য কান্ট্রি) এবং এই মামলায় তিনিই লড়াই করবেন। ইয়াঙ্গুনে অবস্থানরত একজন কূটনীতিক মনে করেন, নিজের আইনী টিমের সঙ্গে প্রাথমিক কোনো পরামর্শ না করেই সুচি অমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারেন। সুচি যা করেন তার বেশির ভাগই নিজের ওপর ভিত্তি করে।

কিন্তু যদি মিসেস অং সান সুচি পশ্চিমাদের কাছে তার অবস্থানকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়ে সচেতন থাকেন তাহলে তাকে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন। সেনাবাহিনীর আচরণকে তিনি কিভাবে দেখান আদালতে সে বিষয়টিতে ঘনিষ্ঠভাবে নজরদারি করা হবে। তার পক্ষাবলম্বনকারীরা বিশ্বাস করেন, তিনি তার দেশের সুশৃংখল সেনাবাহিনীর কিছু দুর্বৃত্ত সেনা সদস্যের কাঁধে দায় চাপাতে পারেন। সুচি যে এমন কাজ করবেন অন্যরা তা মনে করেন না। মিসেস ক্যালাহান বলেন, রাখাইন রাজ্যে কি ঘটেছিল তা নিয়ে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় যেসব কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে তা নিয়ে সুচি সম্প্রতি যেসব বক্তব্য বিবৃতি দিয়েছেন অথবা ব্যক্তিগত কথোপকথন হয়েছে, সে সম্পর্কে আমি যা জানতে পেরেছি, তাতে কিছুই বলার মতো নেই।

ওই কূটনীতিক উল্লেখ করেন, অং সান সুচি ২০১১ সালে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে, তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে তাকে কাজ করতে হবে সেনাবাহিনীর সঙ্গে। তখন থেকেই তিনি সেনাবাহিনীর সমালোচনায় খুবই সতর্ক থেকেছেন সব সময়। একজন বিশ্লেষক বিশ্বাস করেন, সুচি সেনাবাহিনীর সঙ্গে চুক্তি করে থাকতে পারেন। সেই চুক্তি হলো আইসিজে’তে তিনি যদি সেনাবাহিনীর পক্ষাবলম্বন করেন তার বিনিময়ে সাংবিধানিক সংস্কার মেনে নেবে জেনারেলরা। দীর্ঘ সময় ধরে অং সান সুচি সংবিধান সংশোধনের আহ্বান জানিয়ে আসছেন। এই সংবিধানের কারণে তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট হতে পারেন নি। এই সংবিধানের অধীনে তিনটি মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী এবং পার্লামেন্টের এক চতুর্থাংশ আসনে নিয়োগ দেয়ার কর্তৃত্ব রয়েছে  সেনাবাহিনীর। তবে বেশির ভাগ বিশ্লেষক মনে করেন অং সান সুচি এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে এমন চুক্তি অভাবনীয়।

এই মামলাটি বহু বছর ধরে আলোচনায় আলোড়ন তুলবে। কিন্তু খুব দ্রুততার সঙ্গে এই মামলায় জনগণের মতামত প্রকাশ করবেন আদালত। যদি সাক্ষ্য দেয়ার সময়ে অং সান সুচি সেনাবাহিনীর নিন্দা না জানান, যদি রোহিঙ্গাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ না করেন, তাহলে ক্যালাহানের মতে, এর জন্য মূল্য দিতে হবে। এখনও বিষয়টি বহু পশ্চিমা মহলে বহুল প্রচলিত। মিসেস ক্যালাহানের মতে রাখাইনে নৃশংসতার জন্য দায়ী হওয়া উচিত নয় অং সান সুচির। তার সমর্থকরা এমন যুক্তি দেখান যে, যেহেতু সেনাবাহিনী নিজেই একটি আইন, সেখানে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য সুচির হাতে সুযোগ ছিল না- এমনটাই বলা যায়। মিসেস ক্যালাহান বলেন, এ কথার মধ্যেও তার প্রত্যাখ্যান করার সঙ্গে মিলে যায়, মিলে যায় বিশ্বাসযোগ্যতা। সুচি যেমন একগুঁয়ে এবং গর্বিত যে, তিনি খুব সাহসী। তাই এমনটা হতে পারে যে, সুচি ভেবে থাকতে পারেন তার কিছু অস্বীকার করার নেই, কোনো কিছুর জন্য ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই। এক সময় বিশ্বজুড়ে সন্তদের মতো তার যে সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল তা পুনরুদ্ধানের কোনো আগ্রহও নেই।

(লন্ডনের বিখ্যাত দ্য ইকোনমিস্টে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ)
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর