গত ৫ই ডিসেম্বর মানবজমিনে ‘ক্র্যাচের বাসস’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এ রিপোর্টের প্রেক্ষিতে বাসস কর্তৃপক্ষ সোমবার রাত ৮টায় একটি প্রতিবাদ পাঠিয়েছে। এতে তারা বলেছেন, রিপোর্টে কিছু সত্যতা থাকলেও বেশির ভাগই কল্পনাপ্রসূত, বানোয়াট, অর্ধসত্য এবং অসত্য তথ্যনির্ভর। প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়নি, কোন্টি অসত্য, কোন্টি বানোয়াট। ঢালাওভাবে বলা হয়েছে, রিপোর্টটি কল্পনাপ্রসূত। ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মুহাম্মদ আনিসুর রহমান স্বাক্ষরিত প্রতিবাদলিপিতে একটি অভিযোগও সরাসরি খণ্ডন না করে কিছু অপ্রাসঙ্গিক বিষয় টেনে আনা হয়েছে। মানবজমিন প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বাসস পরিচালনা পরিষদে থাকাকালে চাকরিচ্যুতির ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবাদপত্রে। প্রথম কথা হলো- বোর্ড কাউকে চাকরিচ্যুত করেনি।
এ ব্যাপারে বাসসের প্রতিবাদলিপিতে যা বলা হয়েছে, তা সত্য নয়। ঐসময় চাকরিবিধির ৫৪/২ ধারায় চাকরিচ্যুত কতিপয় সাংবাদিক-কর্মচারীর আপিল আবেদনের প্রেক্ষিতে তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক চিঠির জবাবে তৎকালীন বাসস এমডি গাজীউল হাসান খান স্পষ্টতই বলেন, ‘‘চাকরিচ্যুতির অফিস আদেশ ব্যতীত এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত লিখিত বা নোট আকারে নেই।’’ পরবর্তীতে তথ্য মন্ত্রণালয় ৮ই সেপ্টেম্বর ২০০৪ এক চিঠিতে জানায়, ‘‘উক্ত পত্রসমূহের জবাব পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, ৫৪ (২) বিধির অধীন চাকরি অবসানে বোর্ডের অনুমোদন গ্রহণ করা হয়নি।’’ প্রশ্ন হচ্ছে এখন যে চাকরিচ্যুতি ঘটছে তা কি বোর্ডের অনুমতি নিয়ে হচ্ছে। তাছাড়া, বোর্ড কার্যসূচিতে দেখা যাবে, বোর্ডের নির্ধারিত মেয়াদের মাঝপথে মানবজমিন প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বোর্ড থেকে সরে দাঁড়ান। এটা না জানার কথা নয় যে, মতিউর রহমান চৌধুরী বোর্ড থেকে কখনও কোনো সম্মানীও নেননি। প্রয়াত সিনিয়র সাংবাদিক জগলুল আহমেদ চৌধূরীর নাম বিভ্রাট নিয়ে বাসসের তৎকালীন ম্যানেজিং ডিরেক্টর আমানুল্লাহ কবীর নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলেন। সেটা রোধ করেছিল বোর্ড। আর এর পেছনে মুখ্য ভূমিকা ছিল মানবজমিন প্রধান সম্পাদকের। প্রতিবাদকারী মুহাম্মদ আনিসুর রহমানের প্রমোশন এই বোর্ডই দিয়েছিল, নানা জটিলতার মধ্যে। আনিসুর রহমান বর্তমানে একইসঙ্গে বাসসের দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল আছেন বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই। তিনি কোন সরকারের আমলে বাসসে চাকরি পেয়েছেন এটাও সবার জানা। আমরা সেটা উল্লেখ করতে চাই না।
প্রতিবাদপত্রে বলা হয়েছে, মানবজমিন বাসসের পাওনা পরিশোধ করেনি। এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য হলো- ২০০০ সালের ২৭শে মে আমরা বাসস কর্তৃপক্ষকে সার্ভিস বন্ধ করার কথা জানাই। কারণ যে টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে খবর সরবরাহ করা হতো তা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। মাসের মধ্যে বেশির ভাগ সময়ই অকেজো থাকতো। বাসসের একভাগ রিপোর্টও আমরা ব্যবহার করতে পারিনি। তারপরও বাসসকে আমরা ২ লাখ ৬১ হাজার টাকা পরিশোধ করেছি। তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর অনুরোধে সার্ভিসটি পুনরায় নেয়া হয়। কিন্তু দুইদিন পরই মেশিনটি বিকল হয়ে যায়। এরপর থেকে আমরা আর বাসসের সার্ভিস ব্যবহার করিনি। বাসসকে আমরা জানিয়ে দেই, যেখানে আমরা সার্ভিস পাচ্ছি না সেখানে অর্থ পরিশোধের যৌক্তিকতা নেই। বিষয়টি এখানেই নিষ্পত্তি হয়ে যায়। ১৭ বছর পর এসে একটি সংবাদের প্রতিবাদ দিতে গিয়ে বিষয়টির অবতারণা করা হয়েছে। সত্য চাপা দেয়ার কৌশলের অংশ হিসেবেই হয়তো এটি করা হয়েছে। অনিয়মের অভিযোগ খণ্ডন করতে না পেরে অপ্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গ টেনে আনা হয়েছে। প্রতিবাদপত্রে বলা হয়েছে, বাসস সরকারের কোনো রাজস্ব উপার্জনকারী সংস্থা নয়। তাই বলে কী জবাবদিহিতারও ঊর্ধ্বে। মনে রাখতে হবে, এটি জনগণের অর্থে পরিচালিত।
বাসস ভালো চলুক- এটা কে না চায়। আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধান এবং দুদকে বাসস কর্মীদের দাখিল করা অভিযোগের ভিত্তিতে রিপোর্টটি তৈরি করা হয়। রিপোর্টে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বক্তব্যও প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টে আমরা যেসব বিষয়ের উল্লেখ করেছি সুষ্ঠু তদন্ত হলে তার সত্যতা প্রমাণিত হবে।
মানবজমিন স্বাধীন সাংবাদিকতায় বিশ্বাসী, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সাংবাদিকতার রীতি মেনে আমরা সবসময়ই সংবাদের প্রতিবাদ প্রকাশ করে থাকি। কিন্তু বাসস কর্তৃপক্ষ রিপোর্টের বাইরে গিয়ে অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য দিয়ে যে প্রতিবাদ পাঠিয়েছে সম্ভবত সাংবাদিকতার ইতিহাসে তা এক নতুন সংযোজন। এখানে উল্লেখ্য যে, বাসসের আর্থিক সংকট, দায়-দেনা, অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা প্রসঙ্গে এমডি আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, সংস্থাটিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। অথচ, তিনি যখন বাসস-এ যোগ দেন তখন দায়-দেনা ছিল সাড়ে ৬ কোটি টাকা। এখন সে দেনা বেড়ে ১৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।