বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (ক্যাব) নিয়ে যে বিতর্ক হচ্ছে, তার অনভিপ্রেত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব। ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ লোকসভায় এই বিল নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যতদিন জীবিত ছিলেন বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো নৃশংস ঘটনা ঘটেনি। তবে তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার বিএনপির শাসনামলে বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠী, তাদের সম্পত্তি ও মন্দিরে হামলা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বাংলাদেশের ভোলা জেলায় হিন্দুদের ওপর শ’ শ’ আক্রমণ হয়েছে। যাতে হাজার হাজার হিন্দু ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এ কারণেই প্রতিবেশী দেশ থেকে পালিয়ে আসা হিন্দুদের নাগরিকত্ব দিতে সরকার এই বিল উত্থাপন করেছে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, প্রায়শই বাংলাদেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা হয়েছে। এই নির্যাতিত শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাতেই হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ইস্যু কি এভাবেই উপস্থাপন করতে হবে যাতে বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুব্ধ হয় ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে প্রভাব ফেলে? যদি এখন বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশ নিজেদের পার্লামেন্টে দাবি করে যে, ভারতেও মুসলিমরা নির্যাতিত হচ্ছে, তাহলে? যদি তারা দাবি করে যে, ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে, অতএব পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাস হোক।
ভারত কি এটা সোজাভাবে মেনে নেবে? অবশ্যই নয়।
সমস্যা হলো যে, বিজেপি বাংলাদেশ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এমন এক ন্যারেটিভ তৈরি করছে যা দুই দেশের সম্পর্কের পক্ষে সহায়ক নয়। এটি সত্য যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অসাধারণ পর্যায়ে আছে। কিন্তু দুই সরকারের মধ্যে সম্পর্ক যতই ভালো হোক, দুই দেশের জনগণ পর্যায়ে সম্পর্ক ভালো না হলে কোনো সম্পর্কই দৃঢ় হয় না। গত বছর অমিত শাহ অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসীদের উইপোকা বলে সম্বোধন করেন। এই মন্তব্য বাংলাদেশী সমাজ মোটেই ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। এরপর আসামে অমিত শাহ ও তার দল বিজেপি আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি করলো। একে অবৈধ বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ হিসেবে উপস্থাপন করা হলো। আর এখন তিনি প্রকাশ্যেই পূর্বতন বাংলাদেশ সরকারকে সংখ্যালঘু নির্যাতনের জন্য দায়ী করছেন।
বিজেপি সরকার ঢাকাকে নাগরিকপঞ্জি ও অন্যান্য বিষয়ে বার বার আশ্বস্ত করেছে। কিন্তু নিজেদের রাজনৈতিক প্রকল্প এগিয়ে নিতে যে বাগাড়ম্বর বিজেপি ব্যবহার করছে, তা নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করবে। অমিত শাহ ও বিজেপির জানা উচিত যে, সরকার আসে, সরকার যায়; কিন্তু সমাজ ও জনগণ পর্যায়ে যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক তাতে ক্ষত সৃষ্টি হলে তা বছরের পর বছর বজায় থাকে। বাংলাদেশকে কৃতীত্ব দিতেই হয় এই কারণে যে, দেশটি এনআরসি ও ক্যাব নিয়ে কূটনৈতিকভাবে নীরব থেকেছে। কিন্তু বিজেপির বাগাড়ম্বর বাংলাদেশের জনগণ আর কতদিন সহ্য করবে? আর এর কারণে কি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে পরে প্রভাব ফেলবে? সময়ই বলে দেবে।
(রুদ্রনীল ঘোষ দিল্লি-ভিত্তিক সাংবাদিক। তিনি টাইমস অব ইন্ডিয়ার স¤পাদকীয় বিভাগে কর্মরত। তার এই নিবন্ধ টাইমস অব ইন্ডিয়ার ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া হয়েছে।)