বৃটেনের নির্বাচনে চমকের পর চমক দেখা দিয়েছে। বিশাল জয় দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে কনজারভেটিভ পার্টি। ৩২ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আসনে জয় পেয়েছে তারা। এর আগে ১৯৮৭ সালে এমন জয় দেখেছিল দলটি। ক্ষমতাসীনদের জয়ের কোণঠাসা হয়ে পড়েছে বিরোধীরা। প্রায় ৮৫ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বিপর্যয়কারী পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছে প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টি। কনজারভেটিভরা যেখানে প্রায় ৫০টি আসন বেশি জিতেছে, সেখানে লেবার হারিয়েছে ৬০টি। দলের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন জেরেমি করবিন।
কেবল তিনিই নন, লিবারেল ডেমোক্র্যাটস এর প্রধান জো সুইনসন নিজের আসন খুইয়ে সরে দাঁড়িয়েছেন।
ব্রেক্সিট বিরোধিতায় লেবারের বিপর্যয় বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে সবচেয়ে অসন্তুষ্ট গোষ্ঠী লেবার নেতারা। ১৯৩৫ সালে দলটি মাত্র ১৫৪ আসনে জয়ী হয়েছিল। এরপর থেকে বহু বছর পেরিয়ে গেছে এমন পরাজয় আর দেখতে হয়নি তাদের। তবে ওই নির্বাচনের পর এবার সবচেয়ে কম আসনে জয় পেয়েছে দলটি। সব মিলিয়ে ২০৩টি আসনে জয় লাভ করেছে জেরেমি করবিনের দল। দলের বেশির ভাগ নেতাই এই পরাজয়ের জন্য তাকেই দায়ী করছেন। প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও নিজ আসন আইসলিংটন থেকে ১০ম বারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। করবিন জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচনের আগেই দলপ্রধানের পদ থেকে সরে যাবেন তিনি। তবে দলের বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ বিবেচনা করতে আরো কয়েকদিন দায়িত্ব পালন করে যাবেন তিনি। তিনি বলেন, তার দল আশা জাগানিয়া একটি ইশতেহার তৈরি করেছিল। তাদের ইশতেহার জনপ্রিয়ও ছিল তবে ব্রেক্সিট নির্বাচনের ধারাপ্রবাহ পাল্টে দিয়েছে। নির্বাচনের ফলাফল অনুসারে, দলটি তাদের বহু শক্ত ঘাঁটি হারিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, ব্লাইথ ভ্যালি। এই আসনটি বিগত ৬৯ বছর ধরে লেবারের দখলে ছিল। তবে তাদের শক্ত ঘাঁটি লন্ডনে জয় ধরে রেখেছে দলটি। শহরটিতে মোট আসন ৭৩টি। সেখানে ৪৯ আসন ধরে রেখেছে দলের প্রার্থীরা। আগের চেয়ে তিনটি আসন বেশি জিতেছে। লন্ডনে কনজারভেটিভ পার্টি বিজয়ী হয়েছে ২১ আসনে।
এদিক, লেবার পার্টির পরাজয়ের কারণ হিসেবে ব্রেক্সিট বিরোধিতাকে দায়ী করেছেন দলটির চেয়ারম্যান ইয়ান ল্যাভেরি। তিনি মনে করেন, অত্যধিক মাত্রায় ব্রেক্সিটবিরোধী অবস্থানের কারণেই এই বিপর্যয়কারী হার দেখেছে লেবার। দলনেতা জেরেমি করবিনের বেশির ভাগ মিত্রই এই ধারণা পোষণ করেন।
বিবিসি রেডিও ৪-এর টুডে প্রোগ্রামে ইয়ান ল্যাভেরি বলেছেন, ২০১৭ সালের নির্বাচন এবং এই নির্বাচনের মধ্যে মাত্র একটিই পার্থক্য আছে। তা হলো, লেবার পার্টি আরেকটি ব্রেক্সিট গণভোটের পক্ষ নিয়েছিল। তার ভাষ্য, এতে ভোটারদের মধ্যে দলের প্রতি আস্থার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কারণ, ২০১৭ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে লেবার বলেছিল, তারা ব্রেক্সিট গণভোটের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাবে। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ কর্মজীবী সম্প্রদায়ের বহু মানুষ এখন মনে করেন, এই দলটি ব্রেক্সিট আটকে দেয়ার চেষ্টা করছে।
লিবারেল ডেমোক্র্যাটের নেতৃত্বেও পরিবর্তনসামপ্রতিক বছরগুলোয় ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা প্রত্যাশার বাইরে গিয়ে হারিয়েছে অনেক আসন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দলটির সাবেক প্রধান জো সুইনসনের আসন, ইস্ট ডানবার্টনশায়ার। নিজ আসনে হেরেছেন তিনি। হারার পরপরই দলপ্রধান হিসেবে পদত্যাগ করেছেন। তার জায়গায় যৌথভাবে দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছেন উপনেতা স্যার এড ড্যাভি ও প্রেসিডেন্ট ব্যারোনেস স্যাল ব্রিন্টন। সব মিলিয়ে এক হাসন হারিয়ে ১১ আসনে জয়ী হয়েছে দলটি। ড্যাভি ও ব্রিন্টন জানিয়েছেন, নতুন বছরে দলের নেতৃত্ব নিয়ে নির্বাচন হবে। অন্যদিকে, সুইনসন নিজের পরাজয় নিয়ে বলেন, আজকের পরাজয় নিশ্চিতভাবেই ব্যাপক হতাশার। আমি গর্বিত যে, লিবারেল ডেমোক্র্যাটস নির্বাচনী প্রচারণায় উন্মুক্ততা, উদারতা ও আশার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। আমরা নিজেদের বিশ্বাসের ব্যাপারে সপষ্ট ছিলাম।
তিনি আরো বলেন, এটা সপষ্টতই একটি পিছিয়ে পড়া। কিন্তু দেশজুড়ে লাখো মানুষ দলের বিশ্বাসে বিশ্বাস করে। তাদের হয়ে লড়ার জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, যাতে আমরা একটি ইতিবাচক ভবিষ্যৎ গড়তে পারি।
এসএনপি’র বাজিমাতবিরোধীদের মধ্যে সবার চেয়ে লাভজনক ফলাফল দেখেছে নিকোলা স্টার্জনের স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি। ব্রেক্সিটবিরোধী প্রচারণা চালিয়েও, অপ্রত্যাশিত অগ্রগতি করেছে তারা। সর্বমোট ৪৮ আসনে জয়ী হয়েছে দলটি। জয়ের ভাণ্ডারে যোগ হয়েছে নতুন ১৩টি আসন। স্কটল্যান্ডের প্রভাবশালী দলটি এবার ইংল্যান্ডেও বিস্তার ঘটিয়েছে। স্টার্জন তার দলের জয়ে বলেছেন, এই জয় অপ্রত্যাশিত ইংল্যান্ডের ইস্ট ডানবার্টনশায়ারে লিবারেল ডেমোক্র্যাটের সাবেক প্রধান জো সুইনসনকে পরাজিত করেছে এসএনপি প্রার্থী।
ধারণা করা হচ্ছে, এই জয়ের পর বৃটেন থেকে স্বাধীনতার দাবি জোরদার হবে । স্টার্জন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ বিষয়ে চিঠি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বলেছেন, এসএনপি’র এই জয় দেশজুড়ে স্কটিশ স্বাধীনতার ব্যাপারে দ্বিতীয় গণভোট নিয়ে সপষ্ট বার্তা পাঠায়। প্রথম গণভোটে বৃটেনের অংশীদার থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছে বেশির ভাগ স্কটিশরা।
শূন্য আসন ব্রেক্সিট পার্টির২০১৯ সালে ডিসেম্বরের নির্বাচন কনজারভেটিভ পার্টির জন্য নিরঙ্কুশ জয়ের ইতিহাস হয়ে থাকবে। বিপরীতে নাইজেল ফারাজের ব্রেক্সিট পার্টির জন্য এটা হবে সমালোচনার নির্বাচন। একটি আসনও জেতেনি তার দল। বৃহস্পতিবার সকালে এক ঘোষণায় তিনি জানান, ব্রেক্সিট সমর্থকদের ভোট ভাগ হয়ে যাক এমনটা চান না তিনি। তাই কনজারভেটিভ প্রার্থীদের ঘাঁটিগুলোয় নির্বাচনে দাঁড়াবে না তার দলের কোনো প্রার্থী। তার দল হয়তো কোনো আসন জেতেনি। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজের স্বার্থ হাসিলে সক্ষম হয়েছেন ফারাজ।