ভারতের রাজধানী দিল্লির ঐতিহ্যবাহী জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ) রবিবার সন্ধ্যায় শতাধিক মুখোশধারী হিন্দুত্ববাদী ছাত্র ও দুষ্কৃতিদের তান্ডবে রক্তাক্ত হয়েছে ছাত্র থেকে শিক্ষকরা। এ ঘটনার প্রতিবাদে ভারতজুড়ে ধিক্কার জানানো হয়েছে। এমনকি বিজেপি নেতারাও ঘটনার নিন্দা করতে বাধ্য হয়েছেন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছেন, জেএনইউয়ের ছাত্র এবং শিক্ষকদের উপর মুখ ঢাকা গুন্ডাদের বর্বরোচিত হামলার ঘটনা মারাত্মক। ফ্যাসিস্টরা আমাদের দেশের দখল নিয়েছে। সাহসী ছাত্রদের কন্ঠস্বরে তারা ভীত। হিংসার ঘটনায় সেই ভয়েরই প্রতিফলন। সিপিআইএমের সাধারণ সম্পাদক এবং জেএনইউ-র প্রাক্তনী সীতারাম ইয়েচুরি অভিযোগ করেছেন, এটা ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের সুপরিকল্পিত আক্রমণ।
তাদের হিন্দুত্বের কর্মসূচির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো জেএনইউয়ের ছাত্রদের ওরা ভয় পেয়েছে। আইনের রক্ষকদের নাকের ডগা দিয়ে মুখোশ পরা গুন্ডারা জেএনইউয়ে ঢোকে। ভিডিও থেকেই প্রমাণ, আরএসএস-বিজেপি দেশকে কোথায় নিয়ে চলেছে। জেএনইউয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের অভিযোগ, দিল্লি পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মদতে হিন্দুত্ববাদী ছাত্র সংগঠন এবিভিপি-র সদস্যেরা মুখ ঢেকে ক্যাম্পাসে ঢুকে এই হামলা করেছে। জেএনইউয়ের ছাত্রছাত্রীরা বর্ধিত হোস্টেল ফির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও পরীক্ষার জন্য নাম নথিভুক্তিকরণ বয়কট করছিলেন। এর পরে নয়া নাগরিকত্ব আইন এবং এনআরসির বিরুদ্ধেও দিল্লিতে যাবতীয় প্রতিবাদ-বিক্ষোভের পুরোভাগে ছিল জেএনইউ। তার জেরেই এই পরিকল্পিত হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ। রবিবার গোটা দিনের উত্তেজনার শেষে সন্ধ্যায় এবিভিপি নেতা-নেত্রীরা ভাড়াটে গুন্ডাদের নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে রড, লাঠি, বাঁশ ও বড় বড় পাথর নিয়ে ছত্রিদের উপর চড়াও হয়েছিল। তাদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল বাম ছাত্র-ছাত্রীরাই। প্রত্যক্ষদর্শী ছাত্ররা জানিয়েছেন, হোস্টেলের আলো নিভিয়ে দিয়ে হামলার পাশাপাশি সাবরমতী, কাবেরী, পেরিয়ার হোস্টেলে ভাঙচুরও চালানো হয়েছে। এই হামলার ঘটনায় ছাত্র সংসদের সভানেত্রী ঐশী ঘোষ-সহ একাধিক ছাত্রছাত্রী আহত হয়েছেন। প্রতিবাদ করতে গিয়ে মার খেতে হয় জেএনইউয়ের ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব রিজিওনাল ডেভেলপমেন্ট’-এর অধ্যাপিকা সুচরিতা সেন-সহ একাধিক শিক্ষক-শিক্ষিকাকে। অভিযোগ উঠেছে, পুলিশের সামনেই এই হামলা হয়েছে। পুলিশ ছিল নীরব দর্শক। শুধু হোস্টেল নয়, ক্যাম্পাসে গাড়িতেও ভাঙচুর করা হয়েছে। পাথর ছোড়া হয়েছে।
মেয়েদের হোস্টেলে এসিড নিয়েও হামলার চেষ্টা হয়েছিল বলে অভিযোগ।এই হামলায় আহত প্রায় ৩০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পক্ষ থেকে অবশ্য ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঘটনার নিন্দা করেছে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকও। তবে জেএনইউয়ের এবিভিপি সভাপতি দুর্গেশ কুমারের অভিযোগ, বামেরাই হামলা চালিয়েছে। আর জেএনইউ কর্তৃপক্ষের দেওয়া লিখিত বিবৃতিতে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদেরই সিংহভাগ দোষারোপ করা হয়েছে। মুখোশধারীদের হামলার প্রসঙ্গ সেই বিবৃতিতে রয়েছে নামমাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপিকা জয়তী ঘোষ বলেছেন, পুরোপুরি পরিকল্পিত হামলা। বিকেলে গুন্ডাদের জড়ো করা হয়েছিল। তারা নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল। আগে থেকেই পুলিশ বাইরে অপেক্ষা করছিল।
ছাত্রদের মতে, হোস্টেলের ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে চলা আন্দোলনে চিড় ধরাতে কর্তৃপক্ষ ক্রমশ মরিয়া হচ্ছিল। ‘নাম নথিভুক্ত না-করলে পরের সেমিস্টার দেওয়া যাবে না’ বলে হুমকিতেও কাজ হয়নি। এর পরেই বলপ্রয়োগ শুরু হয়েছে। সঙ্গী হয়েছে এবিভিপি। কখনও প্রশাসনিক ভবনের সামনে যাঁরা শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রতিবাদ করছেন, তাঁদের জোর করে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কখনও হোস্টেলের আলো মাঝরাতে বন্ধ করে দিয়ে ছাত্রদের একাংশের গায়ে হাত তোলা হয়েছে। ছাত্র-নেতারা প্রতিবাদ করলে তাদেরও রেয়াত করা হয়নি। এর মধ্যেই নির্দেশ বলবৎ হয়, হোস্টেল ফি না-দিলে চলে যেতে হবে। তা নিয়েও ছাত্ররা এককাট্টা ছিলেন। রবিবার সন্ধ্যার ঘটনার পর থেকেই দেশজুড়ে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। রবিবারই কলকাতায় ছাত্ররা মিছিল করেছেন। পশ্চিমবঙ্গেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুইট করে পড়ুয়াদের উপর হামলার কড়া নিন্দা করে বলেছেন, কোনও শব্দ দিয়েই এই ঘটনার ব্যাখ্যা করা যায় না। এটা গণতন্ত্রের লজ্জা। বিজেপি সরকারের দুই শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রীও ক্ষোভ জানিয়েছেন একই সুরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেছেন, জেএনইউয়ে যা ঘটেছে, তার ছবি দেখেছি। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিন্দা করছি। এই ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বিরোধী। আরেক প্রাক্তনী অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন বলেছেন, জেএনইউয়ের আজকের ছবি ভয়াবহ। যে বিশ্ববিদ্যালয়কে আমি জানতাম, তা তীব্র বিতর্ক এবং মতামতের জায়গা ছিল, হিংসার নয়। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আজকের ঘটনার নিন্দা করছি। গত কয়েক সপ্তাহে যা-ই বলা হয়ে থাক, এই সরকার চায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জন্য মুক্ত পরিসর থাকুক। বিরোধীরা দাবি করেছেন, নাগরিকত্ব আইন এবং এনআরসি নিয়ে বিরোধিতা করে এসেছে জেএনইউ ছাত্র সংসদ। সেটাই হামলার অন্যতম কারণ। ফেডারেশন অব সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন (ফেডকুটা) জানিয়েছে, জেএনইউয়ের উপাচার্য ও তার অনুগতরা পরিকল্পনা করে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। উপাচার্যের অপসারণও দাবি করেছেন তারা। আলিগড় সোসাইটি অব হিস্ট্রি অ্যান্ড আর্কিওলজি ঘটনার নিন্দা করে বলেছে, আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় ও জামিয়ায় একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের উপরে হামলা হয়েছিল। জেএনইউয়ে যারা ফ্যাসিস্ট ও বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির বিরোধিতা করেছেন তাদেরই মারা হয়েছে।