× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার , ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

রাজস্ব নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে অমিল

প্রথম পাতা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২১ জানুয়ারি ২০২০, মঙ্গলবার

প্রতি বছরই রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি দেখানো হয় জাতীয় বাজেটে। যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় তাও পূরণ হয় না অর্থবছর শেষে। চলতি বাজেটে রাজস্ব আদায়ে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা পূরণে এ পর্যন্ত তেমন কোনো সুখবর নেই। হিসাবেও অনেকটা গোলমাল দেখা যাচ্ছে। হিসাবের এমন গোলমালের কারণে বাজেট বাস্তবায়নেও ঘাটতি দেখা দিতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পৃথক হিসাবে রাজস্ব আয়ে ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি গরমিল দেখা দিয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে সংশ্লিষ্টরা প্রধানমন্ত্রীকে যে তথ্য সরবরাহ করেন তার ভিত্তিতে তিনি উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশনা দেন। আর এই উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন হয় প্রধানতরাজস্ব আয়ের ওপর ভিত্তি করে।
রাজস্ব আয়ের হিসেবের গোলমালের কারণে সার্বিক উন্নয়ন কাজে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। দেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যেতে প্রধানমন্ত্রী যে স্বপ্ন নিয়ে এগোচ্ছেন তার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়াচ্ছে এ তথ্য। একই সঙ্গে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য পুরণেও এটি সমস্যা তৈরি করবে বলে তারা মনে করেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মিজ্জা আজিজুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, তথ্যের গরমিল বরাবরই দেখা যাচ্ছে। এটি হওয়া উচিত না। এ ধরনের গরমিল বড় মাত্রায় হলে জাতির কাছে ভুল তথ্য যাবে। অর্থনীতির সূচক মূল্যায়নেও এটি সমস্যা তৈরি করবে।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ বিষয়ে মানবজমিনকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থায়নের হিসেবে আয়-ব্যয়ের হিসাব করে। আর অর্থমন্ত্রণালয় ব্যয়ের হিসাব করে। উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে পরিকল্পনা মন্ত্রণায়। এই তিনটিই সরকারি প্রতিষ্ঠান। তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব যদি না মেলে তাহলে তাদের কাছ থেকে কি আশা করা যায়। তিনি বলেন, জুন মাসের হিসাব জানুয়ারিতে প্রকাশ পেলো, এতেও দেখা গেলো তথ্যের গরমিল। এতে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের প্রধান অর্থনৈতিক সূচকগুলোর সঙ্গে রাজস্ব ঘাটতির হার নিয়ে সম্প্রতি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে অর্থমন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের রাজস্ব ঘাটতির তথ্যের সঙ্গে কোনো মিল পাওয়া যায়নি। অর্থ বিভাগের পূর্ণাঙ্গ আর্থিক তথ্য সম্বলিত মাসিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, অনুদান ব্যতীত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি দেখানো হয়েছে জাতীয় প্রবৃদ্ধি বা জিডিপির শতকরা ৩.৯ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা ছিল শতকরা ৪.৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ আগের বছরের চেয়ে রাজস্ব ঘাটতি কমে এসেছে। অপরদিকে শুধু জিডিপির শতকরা হারেই ঘাটতি কমে এসছে এমন নয়। একই সঙ্গে তা মোট টাকার হিসাবেও কমে এসছে। যা গত অর্থবছরে ছিল শতকরা প্রায় ৬ শতাংশ।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের রাজস্ব ঘাতটি জাতীয় প্রবৃদ্ধির শতকরা ৩.৮৯ ভাগ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শতকরা ৪.৫ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতির চেয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৩০.৫ ভাগ।
অন্য দিকে এনবিআর তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের ৫ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রাজস্ব আদায় হয়েছে ৮৩ হাজার ৭০৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা। প্রবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশ। কিন্তু রাজস্ব আদায়ে টার্গেট থেকে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে ২৮ হাজার ৩০১ কোটি টাকা। তবে হিসেবের এই গোলমালের বিষয় অর্থ সচিব মো. আসাদুল ইসলাম টেলিফোনে কথা বলতে রাজি হননি।
সদ্য বিদায়ী এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, এনডিসি এ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেছেন, বিস্তারিত খোঁজ-খবর না নিয়ে কিছু বলতে পারবো না।

সরকারের দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হিসাব ভিন্ন ভিন্ন হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। তাদের মতে, নিট বৈদেশিক অর্থায়ন ও ব্যাংকের ঋণের বিষয়ে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে পার্থক্য তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। দুটি প্রতিষ্ঠানই ম্যাক্রো ফিজিক্যাল পলিসি কোঅর্ডিনেশন কাউন্সিলে প্রতিনিধিত্ব করে। তাহলে এসব ফিগার বা সংখ্যা নিয়ে কি তাদের বৈঠকে আলোচনা হয় না-এমন প্রশ্ন তাদের। তারা জানান, এই দুটি হিসাবের মধ্যে যে পার্থক্য তা ঠিকঠাক করার প্রয়োজন কি কেউ অনুভব করেন না?
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন উন্নয়নে বাংলাদেশ বিশ্বের রোল মডেল। প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হচ্ছে আমাদের সব ধরনের সূচক বাড়ছে। অথচ এক প্রতিষ্ঠনের সূচকের সঙ্গে অন্য অন্য প্রতিষ্ঠানের সূচকের কোনো মিল নেই। এখানে তথ্য ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকেও ক্ষেত্র বিশেষে হয়তো ভুল তথ্য দেয়া হচ্ছে। এনবিআর’র সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দায়িত্ব ছেড়ে আসায় এখন এ বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে পারেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এনবিআর খাতে রাজস্ব সংগ্রহ হয়েছে প্রায় ২২৩৮.৯২ বিলিয়ন টাকা (২ লাখ ২৩ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা)। আর অর্থ বিভাগের হিসাবে, এই টাকার অংক ২১৮৭ বিলিয়ন টাকা (২ লাখ ১৮ হাজার ৭ কোটি টাকা)। এ খাতে দুটি সংখ্যার মধ্যে পার্থক্য ৫১ বিলিয়ন টাকা (৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা)।
অর্থ বিভাগ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সম্পূরক কর যে পরিমাণ আদায় হয়েছে বলে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, এই অংক তার দ্বিগুনেরও বেশি। ইমপ্লিমেন্টেশন মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন ডিভিশন (আইএমইডি) ও অর্থ বিভাগ এডিপির খরচ নিয়ে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে যে পার্থক্য, তা আরো নাটকীয়। এই সংখ্যা যথাক্রমে ১৫৮৩.৭ বিলিয়ন টাকা (১৫ হাজার ৮৩৭ কোট টাকা) ও ১১৩৫.২ বিলিয়ন টাকা (১১ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা)। অর্থ বিভাগের তথ্য বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের আকার ২০১৭-১৮ অর্থবছরের চেয়ে শতকরা ৫ ভাগ কম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এডিপির বাজেট ছিল ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে শতকরা ৩২.২ ভাগ বেশি।

ওদিকে ব্যাংকে সুদের হার এক অংক বাস্তবায়নে ব্যাংকারদের সহায়তা করতে অর্থমন্ত্রী মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সরকারি তহবিলের শতকরা ৫০ ভাগ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা হবে শতকরা ৬ ভাগ সুদে। রাষ্ট্রীয় ৬১টি প্রতিষ্ঠানের যে উদ্বৃত্ত অর্থ জাতীয় কোষাগারে আছে, তা উন্নয়নমুলক প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য গত ১৪ই জানুয়ারি জাতীয় সংসদে একটি বিল উত্থাপন করে সরকার। অর্থবছর শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে উদ্বৃত্ত অর্থ জমা দিতে হবে জাতীয় কোষাগারে। ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকে এসব সংস্থা জমা করেছে ২১৮৮.৩৯ বিলিয়ন টাকা (২ লাখ ১৮ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা)।

এই দুটি নীতি একই সময়ে কার্যকর কীভাবে হয় তা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ জমা দেবে জাতীয় কোষাগারে। এই অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখা হবে ট্রেজারি সিঙ্গেল একাউন্টে (টিএসএ)। সরকার যতক্ষণ এই অর্থ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সংস্থার কাছে ফেরত না দেবে, ততক্ষণ তা ব্যাংকিং খাতে আসবে না। এই অর্থ সংস্থাগুলোর কাছে দীর্ঘ সময় থাকবে না। কারণ, আর্থিক বছর শেষে তাদেরকে উদ্বৃত্ত অর্থ আবার টিএসএ’তে জমা দিতে হবে। এমন সিদ্ধান্তে ব্যাংকারদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তাদের আশঙ্কা, এই অর্থ জাতীয় কোষাগারে জমা দেয়ার ফলে তারল্য সংকট আরো তীব্র হতে পারে। এতে সুদের হার এক অংকে নামিয়ে আনাও বাধাগ্রস্ত হবে।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর