ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের চার শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের প্রতিবাদে গতকাল বিভিন্ন ব্যানারে দফায় দফায় বিক্ষোভ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি, ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতাদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কার করতে হবে। এদিকে, ঘটনার দুইদিন পেরিয়ে গেলেও এখনো কোন মামলা হয়নি। তবে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। দুপুরে ১২টি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম ‘সন্ত্রাসবিরোধী ছাত্র ঐক্যের’র ব্যানারে বিক্ষোভ করেছে সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা। তারা ঘটনার বিচার দাবি করেন। একই সঙ্গে ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। বিক্ষোভ পরবর্তী সমাবেশে ছাত্র ঐক্যের অন্যতম নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র্র্রীয় ছাত্র সংসদের ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া সংগঠন ছাত্রলীগকে এখনি সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।
তা নাহলে ছাত্রলীগ সকারের গদি ছাড়ানোর কারণ হবে।
নুর বলেন, ছাত্রলীগের নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়। তারা ডাকসুতে হামলা চালিয়েছে, বুয়েটে হামলা করেছে। শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করছে এই পেটুয়া বাহিনী। যদি আমরা প্রতিরোধ না করি তাহলে নিরাপদ ক্যাম্পাস পাব না। ঐক্যবদ্ধ হলে যেকোনো কোন কিছু আদায় করা যাবে। সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে এক ধরনের গণসচেতনতা তৈরি হয়েছে তা আপনারা দাবায়ে রাখতে পারবেন না।
বিভিন্ন ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির বিষয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় অসংখ্য তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সেই তদন্ত কমিটি গুলোর দৃশ্যমান পদক্ষেপ আমরা কখনো দেখিনি। কোন নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে একটি তৎক্ষণাৎ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় যেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা নিশ্চুপ হয়ে যায়। এর পরে সেই তদন্ত কমিটির কোন কাজ আমরা দেখিনা। এর আগে ঢাবির বটতলায় বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের ৩৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে ছাত্র সমাবেশে অংশ নিয়ে ডাকসুর ভিপি বলেন, প্রথম বর্ষ থেকে বৈধ সিট দিতে হবে। হল থেকে অছাত্র, বহিরাগতদের বিতাড়িত করতে হবে। নির্যাতনের ঘটনায় যারা জড়িত তিনজনেরই ছাত্রত্ব শেষ। এরা যদি হলে না থাকত, তাহলে হয়ত এই কান্ড ঘটত না।
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকী বলেন, গত পরশু চারজন ছাত্রকে ছাত্রশিবির সন্দেহ করে নির্মমভাবে পেটানো হয়েছে। এর আগে বুয়েটের আবরার ফাহাদকে মারা হয়েছে। মারার পর প্রক্টর ভুক্তভোগীদের পুলিশের হাতে সোপর্দ করেছে। কিন্তু যারা শিক্ষার্থীদের মারলো তাদের কিছুই হলো না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি ছাত্রলীগকে পেটানোর দায়িত্ব দিয়ে থাকে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে তা সরাসরি ঘোষণা করতে হবে। অন্যথায় যারা ৪জন ছাত্রদের মারছে তাদের ব্যাপারে আইনি ব্যাবস্থা নিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, অন্যদের কথা বাদ দিলেও ডাকসুর ভিপিতো আপনাদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছে। ডাকসু ভিপিকে মারা মানেতো আপনাদেরকেই মারা, যারা তাকে ভোট দিয়েছেন তাদের গাঁয়ে লাগা। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন হলে ছাত্রদের পেটানো হয় আর তখন সেই পেটানোতে সহযোগিতা করে শিক্ষকরা।
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, প্রত্যেকটি আন্দোলনের ক্ষেত্রে সরকারী দল বা তার অঙ্গ সংগঠনের থেকে শক্তির প্রয়োগ করে আন্দোলনকে ব্যাহত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই শক্তি প্রয়োগের শিকার হচ্ছেন সাধারণ ছাত্ররা। যারা কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। এমনকি এটা শিক্ষক পর্যায়েও চলে এসেছে। শিক্ষকদের লাঞ্ছনা করার জন্য যখন শিক্ষক সমিতিকে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয় তখন তারা ব্যবস্থা নেয়নি।
চার দফা দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ: এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে নির্যাতনের শিকার মুকিমের পাশে দাঁড়িয়েছেন তার নিজ বিভাগ ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টের শিক্ষার্থীরা। বিভাগের প্রায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে নির্যাতনকারীদের বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন। আগামী রোববার এই ঘটনার বিচারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যায় ভিসি বরাবর স্মারকলিপি দেবেন তারা।
মানববন্ধনে অংশ নিয়ে বিভাগটির দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী কবিতা বলেন, আমাদের বন্ধু মুকিমসহ চারজন ছাত্রকে নিষ্ঠুরভাবে মারা হয়েছে। সে শিবির করে নাকি অন্য কোনো দল করে সেটা একান্তই তার ব্যক্তিগত বিষয়। তাকে মারার অধিকার কারো নেই। সে যদি কোনো অপরাধ করে থাকে, তাহলে সেটার বিচারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আছে।
এসময় তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে চার দফা দাবি জানান। দাবিগুলো হল- যারা মুকিমের উপর অন্যায়ভাবে পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার ও দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দিতে হবে; একটা নিরাপদ ক্যাম্পাস, যেখানে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ ও স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা যাবে এবং রাজনৈতিক মতের প্রতিফলন ঘটানো যাবে; আবাসিক হলগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, প্রথম বর্ষ থেকেই হলে সিট বরাদ্দ দিতে হবে এবং সিট বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে।
সন্ত্রাস বিরোধী ঐক্য জঙ্গিদের মদদদাতা: যারা জঙ্গিদের মদদদাতা তারাই সন্ত্রাসবিরোধী ছাত্র ঐক্য গড়ে তুলেছে বলে অভিযোগ করেছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়। গতকাল বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু কর্নার উদ্ভোধনকালে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানের ঢাবির ১৮ টি হলে বঙ্গবন্ধু কর্ণার উদ্বোধন করা হয়। যার উদ্যোক্তা ডাকসুর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরী।
ছাত্রলীগের নির্যাতনে আহত চার শিক্ষার্থীর বিচারের দাবিতে চলমান আন্দোলন করছে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের ১২টি জোট। যারা গঠন করেছে সন্ত্রাসবিরোধী ছাত্র ঐক্য। তাদের চলমান এই আন্দোলনের বিষয়টি উল্লেখ করে ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বলেন, ডাকসু ভিপি নুরুল হককে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বর্জন করেছে। জঙ্গি সংগঠন শিবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা ভিপিকে বলতে চাই, আপনারা যে সন্ত্রাস বিরোধী ঐক্য গড়ে তুলেছেন সেটা কিসের সন্ত্রাসবিরোধী ঐক্য? এটাতো জঙ্গির মদদে গড়া ঐক্য। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি শিক্ষার্থী আজ সচেতন। অভিনয় করে ভিপি হয়েছেন সেটা আমরা বুঝে গিয়েছি। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং ডাকসুতে ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে এরকম নাম সর্বস্ব সংগঠন জঙ্গি কার্যক্রম করতে পারবেনা।
অনুষ্ঠানে উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক মোহাম্মদ ড. আখতারুজ্জামান। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান, বিশেষ অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ। এছাড়াও প্রত্যেকটি হল থেকে ছাত্রলীগ ইউনিটের প্রায় তিন শতাধিক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডাকসুর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক সাদ দিন কাদের চৌধুরী।
তদন্ত কমিটি গঠন: নির্যাতনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। জানতে চাইলে প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রাব্বানী বলেন, আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। কমিটি যে প্রতিবেদন দিবে সে অনুযায়ী দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মঙ্গলবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে চারশিক্ষার্থীকে রুম থেকে ডেকে নিয়ে নির্যাতন চালায় হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। শিবির সন্দেহে তাদেরকে কয়েক দফায় নির্যাতন করার পর পুলিশে দেওয়া হয়। পরদিন মঙ্গলবার বিকেলে শাহবাগ থানা থেকে মুচলেকা রেখে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ঘটনার বিচারের দাবিতে থানা থেকে ছাড়া পেয়েই রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে মুকিম চৌধুরী। টানা ২২ ঘন্টা অবস্থানের পর শারীরিক দুর্বলতায় অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে জানায় সেখানে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা। পরে ডাকসুর ভিপি নুরুল হক তাকে বৃহস্পতিবার বিকাল তিনটার দিকে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করেন।