শেষের পাতা

ব্যবসায়ী পপিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে কনস্টেবল রবিউল

জাদেভ ইকবাল, রংপুর থেকে

২০২০-০১-২৫

ব্যবসায়ী তোষাররফ হোসেন পপি হত্যার মাস্টার মাইন্ড ছিলেন পুলিশ কনস্টেবল রবিউল ইসলাম। সু-পরিকল্পিতভাবে কাজের মেয়ে পাইয়ে দেয়ার কথা বলে রংপুর ডেকে আনে রবিউল। ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরে নগর থেকে প্রত্যন্ত এলাকায় বোনের বাসায় পরিকল্পনা মাফিক পপিকে হত্যা করা হয়। আখ ক্ষেতের পাশে চাষ করা জমির নিচে পুঁতে রাখা হয় তার লাশ। সুচতুর কনস্টেবল রবিউল মোবাইল ট্র্যাকিং এড়াতে পপির মোবাইল ফোনটি হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ঝোপে ফেলে দেন। গত রোববার সকালে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সোমবার ময়না তদন্ত শেষে লাশটি পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। এদিকে ৫ দিনের রিমান্ড শেষ হয়েছে পুলিশ সদস্য রবিউলের। রিমান্ডে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে বলে জানায় পুলিশ।

যেভাবে পাওয়া গেল পপি’র লাশ: পপি’র পরিবারের সদস্যরা জানায়, শনিবার রংপুরে এসে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর প্রথমে রংপুর জেলা পুলিশ সুপার, পরে র‌্যাবকে নিখোঁজের বিষয়টি জানায় তারা। ১৪ই জানুয়ারি মেট্রোপলিটন কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করেন পপি’র ছোট বোন সাজিয়া আফরিন ডলি। এ ঘটনার পর থেকে পুলিশ পপি’কে উদ্ধারে মাঠে নামে। শুক্রবার পুলিশ কনস্টেবল রবিউলকে গ্রেপ্তার করে মেট্রোপলিটন পুলিশ। এরপর তার দেয়া তথ্য মতে, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত রবিউলের দুলাভাই সাইফুল ও বাসার কাজের ছেলে বিপুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। রবিউলকে সাথে নিয়ে পুলিশ শনিবার রাতে সাকুয়াপাড়ায় লাশ উদ্ধারে নামে। কিন্তু জায়গা শনাক্ত ব্যর্থ হয় পুলিশ। এরপর আবারও রোববার ভোরে পুলিশ রবিউলকে নিয়ে সাকুয়াপাড়ায় আসলে পপি’কে মাটি চাপা দেয়া জায়গাটি শনাক্ত করে দেয় রবিউল।

এরপর পুলিশ সদস্য কোদাল দিয়ে খুুঁড়ে এক কোমড় মাটির নিচ থেকে পপি’র লাশ উত্তোলন করে। এরপর ওই স্থানটি আলাদাভাবে চিহ্নিত করে ঘিরে রেখে মেট্রোপলিটন পুলিশ, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), সিআইডি, মেট্রোপলিটন বিশেষ শাখা লাশের সুরতহালসহ বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় পর্যবেক্ষন করে।

যেভাবে হত্যা করা হয় পপি’কে : পুলিশ কনস্টেবল রবিউল রিমান্ডে পুলিশকে জানায়, ব্যবসায়িক লেনদেন নিয়ে ঢাকার এনায়েতগঞ্জ লেন হাজারীবাগের ব্যবসায়ী তোষাররফ হোসেনের সঙ্গে (৪৫) রংপুর ট্রেনিং সেন্টারে প্রেষণে থাকা কনস্টেবল রবিউল ইসলামের দ্বন্দ্ব ছিল। পপি’র কাছে ২০ থেকে ২২ লাখের মতো টাকা পেতো রবিউল। কিন্তু পপি টাকা দিতে গড়িমসি করায় টাকা উদ্ধার করা যাচ্ছিলো না। পপি’র কাছে টাকা উদ্ধারে পরিকল্পনার ছক আঁকে রবিউল। কাজের মেয়ে পাইয়ে দেবার কথা বলে সুকৌশলে রংপুরে পপি’কে ডেকে আনা হয়। ১১ই জানুয়ারি ভোর ৬টায় রংপুর নগরীর কামারপাড়া বাসস্ট্যান্ডে নামে পপি। রবিউল মোটরসাইকেল যোগে বদরগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর সাকুয়াপাড়ায় তার ছোট বোন লাবণীর বাসায় পপিকে নিয়ে আসে। সেখানে পপি’র কাছে টাকা চায় রবিউল। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে পপি’কে মারধর করে রবিউল, রবিউলের দুলাভাই সাইফুল ও বাসার কাজের ছেলে বিপুল। পপিকে ১০টি চেতনা নাশক সিজোফিন ট্যাবলেট খাইয়ে শ্বাসরোধসহ কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর সুযোগ বুঝে বোনের বাসা থেকে প্রায় ৫’শ গজ দূরে আখ ক্ষেতের পাশে স্থানীয় কৃষক মিজানুর রহমানের (৩০) চাষ করা জমির নিচে পপির লাশ মাটি চাপা দেয়া হয়।

পুলিশ সদস্যসহ গ্রেপ্তার ৩: ১৪ই জানুয়ারি মামলার পর অভিযানে মাঠে নামে পুলিশ। ১৭ই জানুয়ারি পুলিশ কনস্টেবল রবিউলকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্য মতে রবিউলের দুলাভাই সাইফুল ও বাসার কাজের ছেলে বিপুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। আসামিদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

বাকরুদ্ধ পপি’র পরিবার: পপি’র হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে তার পরিবার। ৩ সন্তানের জনক ব্যবসায়ী পপি অকালে পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ায় স্ত্রী ইভা মেনে নিতে পারেনি। বিলাপ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। পপি’র দুলাভাই আলতাফ হোসেন বলেন, পপি একজন মেধাবী ছেলে ছিল। তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমরা তো পপি’কে আর ফেরত পাব না। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তসহ দোষীদের দৃষ্টান্তুমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।

পপি’র বড় বোন শাহীন সুলতানা জানান, পপি’র ৩ ছেলে বড় ছেলে ফাইয়াজ (৮), মেজ ছেলে আরাফ (৪) ও ৮ মাস বয়সী ছেলে আরুশ। এই সন্তানগুলো অকালেই এতিম হয়ে গেল। তার ছেলেগুলো আমাকে কাকা ডাকে। সকালে বলেছিল যেহেতু বাবা’র মোবাইল পাওয়া গেছে, বাবাকেও পাওয়া যাবে। আমি তাদের কি জবাব দেব এখন।

পুলিশের বক্তব্য: রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (অপরাধ) কাজী মুত্তাকী ইবনু মিনান বলেন, রবিউলকে গ্রেপ্তারের পর তাকে রিমান্ডে নিলে সে হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করে। রবিউলকে নিয়ে সারা রাত আমরা অভিযান করে লাশটি পাইনি। পরে সকালে সাকুয়াপাড়া আখক্ষেতের পাশে মাটি চাপা দেয়া জায়গাটি দেখিয়ে দিলে পুলিশ সদস্যদের দিয়ে মাটি উত্তোলন করে লাশটি আমরা উদ্ধার করি। লাশটি সুরতহাল রিপোর্ট করাসহ বিভিন্ন খুঁটিনাটি দিক পর্যবেক্ষন করা হয়েছে। রবিউল পপি’র কাছে বেশ কিছু টাকা পেত বলে জানিয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তাকে রংপুরে বোনের বাসায় ডেকে এনে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ কিংবা যে কোন পদেই কর্মরত কেউ হোক না কেন, তারা অপরাধ করলে তাদের আইনের আওতায় আসতে হবে। অপরাধী অপরাধীই, আইন সবার জন্যই সমান।
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status