× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার , ৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

যুদ্ধে বিপর্যস্ত ইদলিবে ঠাণ্ডায় জমে মরছে শিশুরা

বিশ্বজমিন

মানবজমিন ডেস্ক
(৪ বছর আগে) ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২০, বুধবার, ৮:২৩ পূর্বাহ্ন

মোস্তফা হামাদি তার পরিবারকে নিয়ে সম্প্রতি কিল্লি গ্রামে অস্থায়ী এক তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছেন। এ নিয়ে এক বছরের কম সময়ে দুই বার ঘরছাড়া হয়ে অন্যত্র ঠাঁই নিতে বাধ্য হয়েছেন তারা। কিল্লি সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশের এক ছোট গ্রাম। ফেব্রুয়ারির রাতগুলোয় সেখানে নেমে আসে ভয়ানক, তীব্র শীত। পানি জমে বরফ হয়ে যাওয়ার মতো তাপমাত্রা বিরাজ করছে এবার। ১১ই ফেব্রুয়ারিও তার ব্যতিক্রম ছিল না। হাড় জমে যাওয়া ঠাণ্ডায় সে রাতে ঘুম হয়নি মোস্তফা পরিবারের কারোরই। মধ্যরাতের দিকে মোস্তফা তার গ্যাস হিটারটি তাঁবুর ভেতরে নিয়ে আসেন।
এই গ্যাস হিটারই তাদের মৃত্যু ডেকে আনে। সকালে তার স্ত্রী আমৌন, ১২ বছরের মেয়ে হুদা ও ৩ বছর বয়সী নাতনী হুরকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। সকলেই বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইডের শিকার হয়ে মারা গেছেন। ওই রাতে মোস্তফার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেছিলেন তার ভাই নিজার হামাদি। নিজার জানান, তাঁবুটিতে ধোঁয়া বের হওয়ার জন্য কোনো ভেন্টিলিশন ব্যবস্থা ছিল না। পুরো তাঁবুটি তৈরি ছিল ধাতব পাইপ ও নাইলনের পাত দিয়ে। কিন্তু এতেও ঠাণ্ডা কমেনি। তিনি বলেন, সে রাতে তাপমাত্রা অন্তত মাইনাস নয় ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল। আমার ভাই জানতো যে, বদ্ধ জায়গায় গ্যাস হিটার আনতে নেই। কিন্তু তার কাছে এছাড়া আর কী উপায় ছিল?

হামাদি পরিবারের আদি নিবাস ইদলিবের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, মারাত আল-নুমান শহরের কাফরৌমা গ্রামে। বিদ্রোহীদের হটাতে সিরিয়া সরকার গত বছর থেকে সেখানে তীব্র বোমা হামলা চালানো শুরু করলে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হন তারা। কিছুটা উত্তরে বিনিশ শহরের নির্মাণাধীন এক খালি স্কুলে ঠাঁই নেন মোস্তফা ও নিজার। কিন্তু সরকারি বাহিনীর বোমা বর্ষণ ফের তীব্র হওয়ায় আরো দূরে সরে যান মোস্তফা, পৌঁছান কিল্লিতে।

নিজার বলেন, স্কুলটি বসবাসের উপযুক্ত নয়। কিন্তু আশেপাশে আর কোনো খালি ঘরও নেই। সবগুলো আগ থেকেই আরো বাস্তুচ্যুতরা দখল করে নিয়েছে। কোথাও কোথাও একরুমে তিনটি করে পরিবার বাস করছে। বাস্তুচ্যুতরা ঠিক তুষারবলের মতো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গড়িয়ে চলছে, প্রতিনিয়ত সংখ্যায় বেড়ে চলছে।

আশ্রয় নেই কোথাও: রুশ বিমান বাহিনীর সমর্থন নিয়ে সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সেনারা গত এপ্রিল থেকে ইদলিবে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তীব্র হামলা অভিযান শুরু করে। প্রদেশটিতে বসবাস প্রায় ৩০ লাখ মানুষের। এদের অনেকে সরকারি বাহিনীর দখলে থাকা বিভিন্ন এলাকা থেকে সেখানে গিয়ে জড়ো হয়েছেন। বিদ্রোহীদের সামরিক বাহিনীর এই ধাক্কা সিরিয়ার প্রতিবেশী দেশ তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে সহযোগিতায় ফাটল ধরিয়েছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে এক চুক্তি অনুসারে, ইদলিবকে ‘ডি-এস্কালেশন জোন’ বা যুদ্ধ-মুক্ত অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত হলেও গত ডিসেম্বর থেকে সেখানে সামরিক অভিযান নতুন উদ্যোমে শুরু করেছে সরকার। প্রদেশটির মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক রাস্তা এমফাইভ হাইওয়ে দখলে চেষ্টা জোরদার করে সরকারি জোট। আলেপ্পো প্রদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক পরিবহণ ও যোগাযোগে অন্যতম প্রধান রাস্তা এটি। সরকারের এমন পদক্ষেপে আলেপ্পোর পশ্চিমাংশ থেকে জোরপূর্বক ঘরছাড়া হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে গেছেন ইদলিবে। প্রাণ হারিয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। ২০১১ সালে গৃহযুদ্ধ শুরুর পর থেকে এক দফায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন আলেপ্পো ও ইদলিব থেকে। জাতিসংঘ অনুসারে, এ সংখ্যা অন্তত ৯ লাখ। উপরন্তু, বেসামরিকদের ওপর নির্বিচারে গোলাবর্ষণে খোলা আকাশের নিচে- গাছের নিচে, তুষারে ভরা মাঠে- ঠাঁই গাড়তে বাধ্য হয়েছেন ৮২ হাজার মানুষ। ঠাণ্ডায় জমে মারা যাওয়ার তীব্র ঝুঁকিতে রয়েছে তারা।

জাতিসংঘের মানবিক বিষয় সমন্বয়কারী সংস্থা ওসিএইচএ’র হিসাব অনুসারে, নতুন বাস্তুচ্যুত হওয়া পরিবারের ৩৬ শতাংশ আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছেন বা বাসা ভাড়া নিয়েছেন। ১৭ শতাংশ আশ্রয় পেয়েছেন জনাকীর্ন শিবিরগুলোতে। অন্তত ১৫ শতাংশ নির্মাণাধীন ভবনগুলোয় মাথা গুঁজেছেন ও ১২ শতাংশ এখনো আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছেন। নিজার হামাদি এখনো বিনিশের ওই নির্মাণাধীন স্কুলেই থাকেন। তিনি বলেন, বাস্তুচ্যুত মানুষগুলোর জন্য শিবিরে থাকার বাস্তবতা হচ্ছে মূলত গরমের সময় গাছের নিচে থাকা আর শীতের সময় নাইলনের পাত ও কম্বল দিয়ে তাঁবু বানিয়ে নেয়া। নিজার আরো বলেন, আমার ভাই ও তার পরিবার এমন নির্মম পরিণতির শিকার হওয়ার পরও কোনো মানবাধিকার সংগঠন আমাদের কোনো রসদ বা তাঁবু দেয়নি। প্রায় দুই মাস ধরে এমনটা চলছে। আমাদের সাহায্য দরকার, কিন্তু সহানুভূতি কেবল নতুন পত্রিকার শিরোনামগুলোর জন্যই বরাদ্দ যেন।

ঠাণ্ডায় জমে মরছে শিশুরা: সিরিয়ার নতুন বাস্তুচ্যুতদের ৮০ শতাংশই নারী ও শিশু। সবচেয়ে বেশি পীড়াও তাদেরই সহ্য করতে হয়। জাতিসংঘের মানবিক বিষয় ও জরুরি ত্রাণ বিষয়ক প্রধান মার্ক লোকক বলেন, সিরিয়ার পরিস্থিতি ভয়াবহতার নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। সোমবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, বাস্তুচ্যুতরা ‘আতঙ্কিত’। শিবিরগুলোয় জায়গা নেই। জমে যাওয়ার মতো তাপমাত্রায় তাদের বাইরে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে। মায়েরা প্লাস্টিক পুড়িয়ে শিশুদের উষ্ণ রাখার চেষ্টা করছেন। ঠাণ্ডায় নবজাতক ও ছোত শিশুরা মারা যাচ্ছে।

কয়েকদিন আগে সিরিয়া-তুরস্ক সীমান্তের নিকটে কালবিত শিবিরে আরিজ মজিদ আল-হমেইদি নামের পাঁচ মাস বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। শিবিরের এক কর্মকর্তা আবু আনোয়ার জানান, শিশুটির পরিবার গণমাধ্যমের সামনে আসতে চায় না। শিশুটির মৃত্যুর জন্য তারা নিজেদের দায়ী করছে। তাকে পর্যাপ্ত উষ্ণ রাখতে না পারায় নিজেদের দোষ দিচ্ছে। আনোয়ার আরো বলেন, এখানকার পরিস্থিতি অসহনীয়। এখানে প্রায় ৫ হাজার ৫০০ মানুষের ৮০০ পরিবার আছে। অথচ, শিবিরটিতে পানি সরবরাহ করছে মাত্র একটি সংগঠন।

অকাট্য নীরবতা, পদক্ষেপের ঘাটতি: মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সিরিয়ায় কাজ করা গবেষক সারা কায়ালি বলেন, দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নজিরবিহীন মানবিক সংকট চলছে। একটি বিষয় হচ্ছে, বাস্তুচ্যুতের মাত্রা মানবাধিকার কর্মীদের সামাল দেয়ার সক্ষমতার চেয়ে বহুগুণ বেশি। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সহিংসতা- গোলাবর্ষণ, বিমান হামলায় কেবল মানুষ ঘরছাড়াই হচ্ছেন না, তাদের আশ্রয় ও খাদ্য প্রদানের সক্ষমতাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

 ইদলিবের সারমাদায় এক হাসপাতালে কাজ করেন ইউনিয়ন অব মেডিক্যাল কেয়ার অ্যান্ড রিলিফ অর্গানাইজেশন (ইউওএসএসএম)-এর সদস্য মায়দা কাবালাম। তিনি বলেন, এখানে বাস্তুচ্যুতদের অবস্থা ‘সহনসীমা’ ছাড়ানোর পর্যায়ে পৌঁছেছে। আমি নিজের চোখে যা দেখেছি তা হৃদয়বিদারক। খোলা আকাশের নিচে কোনো আবরণ ছাড়া বাস করছে মানুষ। তিনি আরো বলেন, একটি তাঁবুর দাম ১৫০ ডলার। মানবাধিকার সংগঠনগুলো জোগান ও লোকবলের ঘাটতিতে ভুগছে। ত্রাণ সংস্থাগুলোর নতুন বাস্তুচ্যুতদের সহায়তা করার সক্ষমতা নেই।

কায়ালি বলেন, এসব ঘটনা একেবারে নতুন নয়। কিন্তু এ নিয়ে এরকম অকাট্য নীরবতা ও পদক্ষেপের অভাব হতবাক করার মতো। অনেকটা এমন যে, মানুষ কেবল দেখছে ও অপেক্ষা করছে কখন তারা ফাঁদে আটকা এই লাখো বেসামরিকদের রক্ষার অভিনয় করতে পারবে। (আল জাজিরা অবলম্বনে)
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর