× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রযুক্তিপণ্যের বাজারে করোনার প্রভাব

শেষের পাতা

কাজী সোহাগ ও এম এম মাসুদ
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, বুধবার

করোনা ভাইরাসের কারণে চীন থেকে সব ধরনের ইলেক্ট্রনিক পণ্য আমদানি বন্ধ থাকায় এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে রাজধানীর ইলেক্ট্রনিক্স মার্কেটগুলোতে। করোনার প্রাদুর্ভাবে চীন থেকে আমদানি করা অন্য পণ্যের মতো প্রযুক্তিপণ্যের দামও পাইকারি ও খুচরা বাজারে বেড়ে গেছে। রাজধানীর বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক্সের দোকান ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে যারা দেশেই এমন পণ্য উৎপাদন ও সংযোজন করে তারা বলছেন, এখনও সংকট হয়নি। আগের মজুত দিয়ে চলছে। তবে সমস্যা দীর্ঘ হল সংকট তৈরি হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ফ্রিজ, টিভি, মোবাইল, ওভেন, চার্জারসহ ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য ও পণ্যের যন্ত্রাংশের প্রায় ৮০ ভাগই আসে চীন থেকে। কিন্তু বর্তমানে শিপমেন্ট বন্ধ।


কম্পিউটার খাতের অনেকটাই চীন নির্ভরশীল। একই পণ্য ভারত থেকেও আসছে। এখনই বাজারে কিছু কিছু কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে। এ অবস্থা আরো কিছু দিন থাকলে কম্পিউটারের দাম বেড়ে যাবে। এর মধ্যে মোবাইল হ্যান্ডসেট খাতে বাজারের আকার বছরে ১২ হাজার কোটি টাকার উপরে। এটি প্রতি বছর বাড়ছে। এসব পণ্যের দাম ইতিমধ্যেই আগের চাইতে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, মার্কেটগুলোতে বেড়ে গেছে সব ধরনের প্রযুক্তিপণ্যের দাম। বিশেষ করে কম্পিউটারের মাদার বোর্ড, র‌্যাম, প্রসেসর, স্যাটা হার্ডডিস্ক, এসএসডি হার্ডডিস্ক, পাওয়ার সাপ্লাই, কুলিং ফ্যান, স্ক্যানার, ডিভিডি রাইটার, কি বোর্ড, মাউস, পেনড্রাইভ, ওয়াই-ফাই রাউটার, প্রিন্টার, টোনার, সিসি ক্যামেরা, ডিভিআর, এলসিডি-এলইডি মনিটর ও মোবাইল এক্সেসরিজসহ প্রায় সব পণ্যের দাম ক্রমেই বেড়েছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, পর্যাপ্ত পণ্য করো হাতেই নেই। যেসব দোকানে পণ্য আছে তারাও দাম বেশি রাখছেন।

বিভিন্ন দোকান ঘুরে দেখা গেছে, জেনারেশন ভেদে মাদার বোর্ডের দাম ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা বেশি রাখা হচ্ছে। র‌্যামের দামও ৪০০ থেকে ৬০০ টাকার বেশি। হার্ডডিস্কে বেড়েছে ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। এছাড়া অন্য সব পণ্যই বিক্রি হচ্ছে নির্দিষ্ট দামের চেয়ে বেশি। কি বোর্ড, মাউস, ইউএসবি পেনড্রাইভ, ক্যাবলসহ অন্যান্য মালামালের দাম আগের চেয়ে রাখা হচ্ছে ৫০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেশি। রায়ানস কম্পিউটারের এক কর্মকর্তা জানান, সপ্তাহখানেক আগে থেকেই কম্পিউটারের মাদার বোর্ডের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিটি বোর্ডে দাম বেড়েছে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত। পাশাপাশি প্রায় সব ব্র্যান্ডের ল্যাপটপের মডেল ভেদেও বেড়েছে দাম।

এদিকে সব ধরনের চায়না মোবাইলের দাম ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মোবাইল ফোনের কাভার আগে ৬০ থেকে ৭০ টাকার মধ্যে পাওয়া গেলেও এখন ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। হেডফোনের দামও ৩০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আগে ১৫০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে পাওয়া গেলেও এখন তা যাচ্ছে না। মোবাইল গ্লাসের দাম আগে ৬০ থেকে ৭০ টাকা হলেও এখন দাম বেড়ে ৮০ থেকে ১০০ টাকা হয়েছে। ডাটা ক্যাবল ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় পাওয়া গেলেও এখন দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা। মোবাইলের ব্যাটারির দাম আগে ২৫০ টাকা থাকলেও এখন ৫০ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০০ টাকা। ব্যাটারির দাম ৩০০ টাকা থাকলেও এখন দাম ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা হয়েছে। মোবাইল চার্জার ৯০ থেকে শুরু করে ১৫০ টাকার মধ্যে পাওয়া গেলেও এখন আরও বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। এছাড়াও দাম বেড়েছে পাওয়ার ব্যাংকের। রাজধানীর বসুন্ধরা সিটির মোবাইল হ্যান্ডসেট ও মোবাইল এক্সেসরিজ বিক্রেতা সাগর বলেন, চীন থেকে আসা সব ধরনের মোবাইল হ্যান্ডসেট, এক্সেসরিজের দাম বেড়ে গেছে। সপ্তাহখানেক আগেও রেডমি নোট-৮ মডেলের হ্যান্ডসেট বিক্রি করতাম ১৪ হাজার ৫০০ টাকা, এখন আমাদেরই কিনতে হচ্ছে ১৬ হাজার টাকায়। অথচ এই সেটের দাম আরো কমার কথা। যেসব এক্সেসরিজ আগে ২ হাজার টাকায় কিনতাম, এখন কিনতে হচ্ছে আড়াই হাজার বা তার চেয়ে বেশি দরে। তিনি বলেন, দোকানগুলোতে পণ্যের মজুদ নেই, সরবরাহও নেই। কোনো দোকানেই নতুন ব্যাটারি নেই। মেমোরি চিপসের দাম ৫০ টাকা থেকে দেড়শ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। টেকনো মোবাইলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেজায়ানুল হক বলেন, এখন পর্যন্ত ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের যন্ত্রাংশের কোনো সংকট তৈরি হয়নি। আগের যা আমদানি করা ছিল তা দিয়েই চলছে। কিন্তু আগামী মাসে সংকট সৃষ্টি হবে বলে জানান তিনি। তার মতে, দেশে বছরে সাড়ে ৩ কোটি মোবাইলের চাহিদা রয়েছে। সংকট শুরু হলে দামেও প্রভাব ফেলবে বলে জানান তিনি।

এদিকে দাম বেড়েছে অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যর। চায়না এলইডি টিভির দাম ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা করে বেড়েছে। নন ব্রান্ড এলইডি ২৪ ইঞ্চি টিভি আগে ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া গেলেও এখন দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা।

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ইলেক্ট্রনিক পণ্যের বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স আদম ইলেক্ট্র্রনিক্সের বিক্রেতা সুহৃদ বলেন, সব ধরনের চীনা ইলেকট্রনিক্স পণ্যের দামই বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, ওয়াই-ফাই সংযোগে ব্যবহৃত রাউটার আমরা কিনতাম ৬৫০ টাকা, বিক্রি করতাম ৯০০ টাকায়। এখন আমাদেরই কিনতে হচ্ছে ৮০০ টাকা। ক্রেতাদের কাছে ৯৫০ টাকা বিক্রি করতে চাইলেও বাক-বিতণ্ডা হয়। তারা কিনতেও চান না। তিনি বলেন, দোকানে যা আছে, সবই চীনা পণ্য। আর সবকিছুর দামই বাড়তি। বড় আমদানিকারকদের কাছ থেকে পণ্য ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। ইলেক্ট্রনিক ক্যালকুলেটর দেখিয়ে তিনি বলেন, আগে এটি ২৫০ টাকায় বিক্রি করতাম, এখন ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।

মোবাইল হ্যান্ডস্টে ব্যবসায় সঙ্কটের আশঙ্কা: করোনা ভাইরাসের প্রভাবে গভীর সংকটে পড়তে যাচ্ছে মোবাইল হ্যান্ডসেট ব্যবসা। চীন থেকে আমদানি যোগ্য যন্ত্রাংশের অভাবে দেশে হ্যান্ডসেট উৎপাদন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। এপ্রিলের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহ থেকে চড়া হতে যাচ্ছে হ্যান্ডসেটের মূল্য। প্রায় প্রতিটি হ্যান্ডসেটের দাম অস্বাভাবিক বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে দেশে হ্যান্ডসেট উৎপাদনের জন্য গড়ে তোলা কারখানার মালিকরা আছেন নানা ঝুঁকিতে। তারা বলেন, আমরা যারা কারখানা গড়ে তুলেছি তারা শতভাগ নির্ভরশীল চীনের ওপর। করোনার এ অবস্থা চলতে থাকলে বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়তে হবে। যন্ত্রাংশের অভাবে প্রথমে উৎপাদনের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়বে। এতে হ্যান্ডসেট উৎপাদন কমবে। ফলে শ্রমিক ছাটাইয়ের মতো সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। আর এ সুযোগে দেশে নিম্ন মানের হ্যান্ডসেট বাজার দখল করতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। মানবজমিনের সঙ্গে আলাপকালে কয়েকটি হ্যান্ডসেট কারখানার মালিক বলেন, যে পরিমান যন্ত্রাংশ মজুদ রয়েছে তাতে মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত চালিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। এরপর যন্ত্রাংশের অভাবে কমে যাবে উৎপাদনের মাত্রা।

তখন স্বাভাবিকভাবেই হ্যান্ডসেটের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইম্পোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিএমপিআইএ) সাধারণ সম্পাদক ও এসবিটেল এন্টারপ্রাইজ এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর জাকারিয়া শহীদ মানবজমিনকে বলেন, এই মুহুর্তে করোনার কোন প্রভাব মোবাইল হ্যান্ডসেট ব্যবসায় নেই। কারন আমরা যারা ব্যবসায়ী তারা বিভিন্ন সেটের যন্ত্রাংশ আগে থেকে নিয়ে এসে রাখি। অর্থাৎ কিছৃ মজুদ রয়েছে। মার্চ মাস পর্যন্ত হয়তো ব্যবসা টেনে নেয়া যাবে। তবে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি উন্নতি নাহলে এপ্রিলের শুরু থেকে ব্যবসায় বড় ধরনের বিরুপ প্রভাব পড়বে। সিম্ফনি ব্র্যান্ডের মোবাইল হ্যান্ডসেট তৈরি করতে দেশে কারখানা স্থাপনকারী এই ব্যবসায়ী বলেন, আমাদের যাদের কারখানা রয়েছে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবো বেশি। কারণ যন্ত্রাংশের অভাবে শ্রমিক বসিয়ে রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা প্রতিটি হ্যান্ডসেটের দাম বেড়ে যাবে। হ্যান্ডসেটেরও সংকট দেখা দিতে পারে। আবার পরিস্থিতির কারনে বাজারে অনেক ফেক প্রডাক্ট ঢুকে যেতে পারে। তখন পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হবে বলে জানান তিনি। প্রায় একই অভিমত জানান ট্রান্সশন বিডি লিমিটেড এর সিইও ও বিএমপিআইএর পরিচালক রেজওয়ানুল হক। দেশে টেকনো ও আইটেল ব্র্যান্ডের মোবাইল হ্যান্ডসেট কারখানা স্থাপন করেছেন তিনি। রেজওয়ানুল হক বলেন, হ্যান্ডসেটের জন্য চীনের ওপর আমরা শতভাগ নির্ভরশীল। করোনার প্রভাব আরও দীর্ঘস্থায়ী হলে শিগগিরই যন্ত্রাংশ সরবরাহে ঘাটতি দেখা যাবে। এতে কারখানায় উৎপাদন কমে যাবে। ফলে দাম বাড়বে হ্যান্ডসেটের। তিনি বলেন,‘মার্চের মধ্যেই মোবাইল হ্যান্ডসেট বাজারে বিরুপ প্রভাব দেখা যেতে পারে।’ এরইমধ্যে বাংলাদেশে ৯টি প্রতিষ্ঠান হ্যান্ডসেট উৎপাদনের উদ্দ্যেশ্যে কারখানা গড়ে তুলেছে এবং আরো কিছু প্রতিষ্ঠান কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করেছে।

দেশের চাহিদার প্রায় ৫০-৬০ ভাগ হ্যান্ডসেট এখন দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। এদিকে করোনার বিরুপ প্রভাবের এই সুযোগে অবৈধ পথে আমদানি হওয়া হ্যান্ডসেট বাজারে সয়লাব হয়ে যাবে বলে আশংকা করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, করোনার কারণে এমনিতেই হ্যান্ডসেট কারখানার মালিকরা আছে বিপদে তার ওপর অবৈধ পথে আসা হ্যান্ডসেট দেশীয় উৎপাদন শিল্পের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিএমপিআইএ জানিয়েছে, বাংলাদেশের হ্যান্ডসেট বাজারের প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ এখন অবৈধ পথে আমদানি হওয়া ব্যবসার দখলে। যার আনুমানিক বাজার মূল্য হতে পারে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে স্মার্টফোন আমদানির উপর সরকার টোটাল ট্যাক্স ইনসিডেন্ট বা টিটিআই ৩২ ভাগ থেকে বাড়িয়ে ৫৭ ভাগ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ফলে হ্যান্ডসেটের দাম বেড়েছে। অন্যদিকে অবৈধ পথে আসা হ্যান্ডসেটের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন ভোক্তারা। কারন নন-ওয়ারেন্টি পন্য কিনে তারা প্রতারিত হচ্ছেন। বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হচ্ছে, টাকার অংকে যা প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। অবৈধ পথে আসা নিম্নমানের পন্যে বাজার সয়লাব হয়ে যাওয়ায় বৈধ পন্যের বিক্রি কমে যাচ্ছে। ফলে মোবাইল কারখানার শত কোটি টাকার বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়েছে।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর