দেশের রপ্তানি ইতিহাসে নতুন এক মাইলফলক ছুঁতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আগামী ১লা মার্চ ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগযুক্ত স্মার্টফোন প্রবেশ করতে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এর মধ্য দিয়েই ইতিহাস গড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ তথা দেশের শীর্ষ ব্র্যান্ড ওয়ালটন। সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উদ্যাপন করতে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন। নিজ হাতে উদ্বোধন করে সেই ইতিহাসের সাক্ষী হবেন, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
জানা গেছে, আমেরিকার একটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ওরিজিনাল ইক্যুপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার (ওইএম) প্রতিষ্ঠানটিকে স্মার্টফোন তৈরি করে দিচ্ছে ইলেকট্রনিক্স, ইলেকট্রিক্যাল ও আইসিটি পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন। সেই স্মার্টফোনগুলো আমেরিকার বাজারে বিক্রি হবে। এর আগে আগামী রোববার গাজীপুরের চন্দ্রায় ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে আমেরিকায় স্মার্টফোন রপ্তানি কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন অর্থমন্ত্রী।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্মার্টফোন রপ্তানি করা সৌভাগ্যের ব্যাপার। এর ফলে বহিঃবির্শ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হবে। পোশাক-ওষুধের পরেই প্রথমবারের মতো আমেরিকার বাজারে প্রবেশ করতে যাচ্ছে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগযুক্ত স্মার্টফোন। এটা অনেক বড় গর্বের বিষয়।
ওয়ালটন নির্বাহী পরিচালক উদয় হাকিম বলেন, ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা ও জাতীয় পতাকা ধারণ করে প্রযুক্তিপণ্য আমেরিকার বাজারে প্রবেশ ওয়ালটন তথা বাংলাদেশিদের জন্য বিরাট সৌভাগ্যের। আমাদের চাওয়া দেশীয় পণ্য সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া। তিনি বলেন, একটা সময় জাহাজে করে বিদেশি পণ্য দেশে ঢুকতো। আর দেশীয় পণ্য জাহাজ ভর্তি বিদেশে যাচ্ছে। আর ওয়ালটনের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ব্র্যান্ডে পরিণত হওয়া।
শুরুর কথা: ২০১৭ সালে গাজীপুরের চন্দ্রায় ওয়ালটন হেডকোয়ার্টাসে মোবাইল ফোন কারখানাটির যাত্রা শুরু হয়। যাত্রা শুরুর ৩ বছরের মধ্যেই আমেরিকার মতো বড় বাজারে রপ্তানি কার্যক্রম শুরু হলো। ওয়ালটন বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনকারী বা ম্যানুফ্যাকচারার প্রতিষ্ঠান।
শুধু তাই নয়, ওয়ালটনই বাংলাদেশের একমাত্র মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী হিসেবে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর স্ট্যান্ডারডাইজেশন’ (আইএসও) সনদ অর্জন করেছে। ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ৩টি ক্যাটাগরিতে এই সনদ অর্জন করেছে।
যেসব যন্ত্রাংশ তৈরি হয়: সূত্র জানায়, ওয়ালটন মোবাইল ফোন কারখানায় প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এখানে যেসব যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে সেগুলো হলো- মেকানিক্যাল ডিজাইন, মোল্ড, ফোন ও চার্জারের হাউজিং অ্যান্ড কেসিং, চার্জার, ব্যাটারি, পিসিবি, পিসিবিএ, মাদারবোর্ড ও ডিসপ্লে।
উৎপাদন ক্ষমতা: ওয়ালটন মোবাইল ফোন কারখানায় মাসে ২০ লাখ ফিচার ফোন ও ৮ লাখ স্মার্টফোন উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে। এর মধ্যে কারখানা চালুর পর এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০ লাখ মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন ও বাজারজাত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে রয়েছে ৪২টি মডেলের স্মার্টফোন। যার পরিমাণ ১৭ লাখ ইউনিট। আর ২৮টি মডেলের ফিচার ফোন। যার পরিমাণ প্রায় ৪৩ লাখ ইউনিট।
ওয়ালটন মোবাইলের সিইও এস এম রেজওয়ান আলম বলেন, ওয়ালটন সবসময়ই দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ও চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখে সাশ্রয়ী মূল্যে উচ্চমানের মোবাইল হ্যান্ডসেট বাজারজাত করছে। স্মার্টফোনের দাম ২,৯৩০ থেকে ২৪,৯৯৯ টাকার মধ্যে। আর ফিচার ফোনের দাম মাত্র ৬৩০ থেকে ১৪০০ টাকার মধ্যে। তিনি বলেন, খুব শিগগিরই নতুন ফ্ল্যাগশিপ ফোন বাজারে ছাড়া হবে। যাতে থাকবে ৪৮ মেগাপিক্সেলের ক্যামেরা, ৬জিবি র্যাম ও ১২৮ জিবি ইন্টারন্যাল স্টোরেজ। পাশাপাশি মোবাইল ফোনের নানান যন্ত্রাংশ এবং এক্সেসরিজও তৈরি করছে ওয়ালটন। কারখানায় প্রতি মাসে ২০ লাখ চার্জার, ১০ লাখ ব্যাটারি ও ১০ লাখ ইয়ারফোন উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে।
মোবাইল বিক্রি: ২০১৯ সালে দেশের বাজারে ১২ লাখ ১ হাজার ৬২০ পিস স্মার্টফোন বিক্রি করেছে ওয়ালটন। পাশাপাশি ৪১ লাখ ৭৬ হাজার ৪০৭টি ফিচার ফোন বিক্রি হয়েছে।
কর্মসংস্থান: মোবাইল ফোন কারখানায় কাজ করছেন ৪ হাজার প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ান। এর মধ্যে বেশিরভাগ নারী। ওয়ালটনের রয়েছে সফটওয়্যার অ্যান্ড হার্ডওয়্যার আরএন্ডডি, প্রোসেস ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রোডাকশন, কোয়ালিটি কন্ট্রোল, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, প্লানিং অ্যান্ড ম্যাটেরিয়াল কন্ট্রোল, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সম্পন্ন টেস্টিং ল্যাব, অপারেশন্স ইত্যাদি বিভাগ।
ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম মঞ্জুরুল আলম বলেন, প্রযুক্তিপণ্যে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ছিলো দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। ২০১৭ সালে মোবাইল ফোন কারখানা উদ্বোধনের মাধ্যমে সে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পায়। খুব অল্প সময়ে অত্যাধুনিক ফিচারের স্মার্টফোন দিয়ে ক্রেতাদের মন জয় করে নিয়েছে ওয়ালটন। এবার লক্ষ্য আন্তর্জাতিক বাজার। সে লক্ষ্যের শুরুতেই আমেরিকার মতো উন্নত দেশে যাচ্ছে বাংলাদেশের তৈরি স্মার্টফোন। পর্যায়ক্রমে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশেও রপ্তানি হবে স্মার্টফোনসহ বিভিন্ন প্রযুক্তিপণ্য।
সিইও এস এম রেজওয়ান আলম বলেন, ওয়ালটন দেশের প্রথম ও একমাত্র মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী (ম্যানুফ্যাকচারার)। এর পর অনেকেই এসেছে। কিন্তু তারা উৎপাদনকারী (ম্যানুফ্যাকচারার) নয়, সংযোজনকারী (অ্যাসেম্বলার)। উৎপাদনকারীকে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হয়। যার ফলে উৎপাদনকারীর সুযোগ-সুবিধাটাও যৌক্তিক হতে হয়।
সমস্যা: জানা গেছে, দেশের বর্তমান শুল্ক কাঠামো অনুযায়ী, আমদানিকারকদের সঙ্গে সংযোজনকারীদের শুল্ক পার্থক্য ৩০ শতাংশ। কিন্তু সংযোজনকারীদের সঙ্গে উৎপাদনকারীদের শুল্কপার্থক্য মাত্র ৫ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের বাইরে থেকে এনে সংযোজন করলেই মুনাফা বেশি। ফলে এখানে একটা বিশাল শুন্যতা রয়ে গেছে। এর ফলে দেশে মোবাইল হ্যান্ডসেট সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও, নতুন আর কোনো উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না। এতে দেশের প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদন শিল্প খাতের বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান উদ্যোক্তারা।
সম্ভাবনা: বর্তমানে চীন ও আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্যিক যুদ্ধ চলছে। এতে করে চীন থেকে বহু প্রতিষ্ঠান তাদের কারখানা অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশ এ সুযোগটা নিতে পারে। কিন্তু বর্তমান শুল্ক কাঠামোয় উৎপাদনকারীদের যে সুযোগ দেয়া হচ্ছে, তাতে কেউই এখানে মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনে আগ্রহী হবে না। তারা বড়জোর সংযোগজনকারী হতে পারে। তাই ম্যানুফ্যাকচারার এবং অ্যাসেম্বলারদের মধ্যে শুল্ক পার্থক্যটা আরো বেশি হওয়া প্রয়োজন।
করোনার প্রভাব: দেশীয় উদ্যোক্তাদের মতে, মোবাইল ফোনের পাশাপাশি যন্ত্রাংশ এবং এক্সেসরিজ উৎপাদনেও দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। ইতিমধ্যেই করোনা ভাইরাস ইস্যুতে চীন থেকে এক্সেসরিজ আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। অনেক বিনিয়োগকারী চীন থেকে তাদের কারখানা অন্য দেশে সরিয়ে নেয়ার চিন্তা করছে। এখানেও বাংলাদেশ সুযোগটা নিতে পারে। এজন্য দরকার প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা দেয়া। যাতে মোবাইল ফোন উৎপাদন ও সংযোজনের পাশাপাশি এক্সেসরিজ কারখানাও গড়ে ওঠে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে ওয়ালটন কারখানায় মাসে যে পরিমাণ এক্সেসরিজ উৎপাদিত হচ্ছে, তার দ্বিগুণ পরিমাণ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। সরকারি নীতি নির্ধারণী মহল থেকে প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা পেলে ওয়ালটন এখনই দ্বিগুণ এক্সেসরিজ উৎপাদন করতে সক্ষম হবে।
উল্লেখ্য, এর আগে আমেরিকার বাজারে ইলেকট্রনিক্স এবং আইসিটি পণ্য বিক্রির জন্য বিশ্বখ্যাত ই-কমার্স জায়ান্ট অ্যামাজনের সঙ্গে চুক্তি করে ওয়ালটন। খুব শিগগিরই ওয়ালটন ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, কমপ্যাক্ট মিনি রেফ্রিজারেটর, হোম অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল অ্যাপ্লায়েন্সসহ বিভিন্ন পণ্য অ্যামাজনের ওয়েবসাইটে বিক্রির জন্য উন্মুক্ত করা হবে। এছাড়া দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে ওয়ালটন এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের প্রায় ৩৫টি দেশে পণ্য রপ্তানি করছে।