বিদেশ থেকে আমদানী হলেও বর্তমানের রেলওয়ের বেশিরভাগ সরঞ্জামই তৈরী হচ্ছে দেশেই। নীলফামারীর সৈয়দপুরে গড়ে উঠেছে ছোট বড় প্রায় দেড় শতাধিক ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা। এসব কারখানায় রেলওয়ে কারখানার অবসরপ্রাপ্ত দক্ষ শ্রমিকদের হাতে তৈরী হচ্ছে রেলকোচের ১৬০ প্রকারের পণ্য। পাশাপাশি খড়কাটা মেশিনসহ বিভিন্ন খাদ্য পণ্য তৈরীর মেশিন এবং বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় মেশিন ও যন্ত্রাংশও তৈরী করা হচ্ছে এখানে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের সৈয়দপুর কারখানায় কোচ মেরামত করতে এতদিন জার্মানি থেকে আমদানী করা হতো স্কু লিফটিং জগ। যার মূল্য দেড় কোটি টাকা। অথচ সৈয়দপুরের মেসার্স স্টার টেকনিক্যাল ওয়ার্কস এটি তৈরী করছে মাত্র ৫০ লাখ টাকায়। এরই মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ে এখান থেকে কেনা শুরু করেছে পন্যটি।
সৈয়দপুর রেলওয়ের কারখানার পাশাপাশি চিলাহাটি, ঈশ্বরদী ও ঢাকার জন্য কেনা হয়েছে এবং পরবর্তীতে সিলেটের জন্য একটির অর্ডার দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া এমার্জেন্সি ব্রেক ভালব্ এখানে তৈরী হচ্ছে ১৫ হাজার টাকায়। যা আমদানী করতে খরচ হতো ৪৫ হাজার টাকা।
তাছাড়া রেলওয়ে ইঞ্জিনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি পণ্য হচ্ছে সেন্ড বক্স। যেটি থেকে বৃষ্টি বা অন্য কোন কারণে রেল লাইন পিচ্ছিল হয়ে পড়লে অথবা উঁচু স্থানের দিকে যাওয়ার সময় ব্রেক কাজ না করলে সেসময় চাকায় শুকনা বালু স্প্রে করা হয়। এই সেন্ড বক্সটি মাত্র ২৫ হাজার টাকায় তৈরী করে দিচ্ছে সৈয়দপুরের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা কর্তৃপক্ষ।
শুধু এসব পণ্যই নয়, এক সময় বিদেশ থেকে আমদানী করা রেলওয়ে কোচের ফ্যান, জানালা, ব্রেক, রেলক্রসিংয়ের সিগন্যাল বাতির মত ১শ’ ৬০টি পণ্য তৈরী হচ্ছে সৈয়দপুরে গড়ে ওঠা ওয়ার্কশপগুলোতে।
রেলওয়ের পণ্য ছাড়াও খড়কাটা মেশিন, বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈরীর ছোট ছোট মেশিন সহ আরও শতাধিক পণ্য তৈরী হচ্ছে এসব জায়গায়। এর মধ্যে খড়কাটা মেশিন ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে সৈয়দপুর থেকে।
স্থানীয় বেকারী, সাবান ফ্যাক্টরী, ইটভাটাসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের তৈরী মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় খুচরা যন্ত্রাংশও আর ভারত বা চীন থেকে আমদানী না করে এসব কারখানা থেকেই বানিয়ে নিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সৈয়দপুর বিসিক শিল্প নগরীসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা এসব ওয়ার্কশপে কাজ করছেন ৫ হাজারের বেশি কর্মচারী। যাদের বেশিরভাগই রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। এসব প্রবীণ দক্ষ কারিগরদের সঙ্গে থেকে নতুন প্রজন্মের মধ্য থেকেও অনেক শ্রমিকই দক্ষতা অর্জন করেছে। যারা বিদেশী পণ্যের হুবহু পণ্য তৈরী করছে। যা মানের দিক থেকে বিদেশী পণ্যের শুধু কাছাকাছিই নয় অনেক ক্ষেত্রে নিজস্ব কারিগর ও কর্মচারী এবং স্থানীয় বাছাইকৃত কাচামাল দিয়ে তৈরী হওয়ায় বিশ্বমানের।
কিন্তু আমদানী নির্ভরতা কমিয়ে বিদেশে রপ্তানির সম্ভাবনাময় এ শিল্পটি সম্পূর্ণরুপে সরকারী বা বেসরকারী কোন রকম সহযোগিতা পাচ্ছেনা। বিশেষ করে ব্যাংকগুলো থেকে আর্থিক সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতায় রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা। অথচ ব্যাংকের ঋণ ও সরকারী প্রণোদনা পেলে এসব প্রতিষ্ঠান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক প্রযুক্তির প্রায় সকল প্রকার শিল্প মেশিন ও যন্ত্রাংশ তৈরী করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হতো।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি মোঃ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আগামী দিনে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্র হিসেবে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টর অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বিশ্ব মন্দার প্রভাবে গার্মেন্টস শিল্প যে কোন সময় মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। ইতোমধ্যে প্রায় প্রতিদিনই ছোট বড় ২/৩ শ’ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পন্য রপ্তানি করার মাধ্যমে আমরা এগিয়ে যেতে পারি। কিন্তু সে অনুযায়ী সরকারী-বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতা নেই বললেই চলে।
সংগঠনটির সৈয়দপুর সাংগঠনিক জেলা সভাপতি এরশাদ হোসেন পাপ্পুর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, দেশের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প ক্ষেত্রে সৈয়দপুরের প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। একারণে শিল্প মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে এসেছে। তাই পর পর দুইবার সৈয়দপুরে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য ও প্রযুক্তি নিয়ে ৩ দিন ব্যাপী মেলা আয়োজন করা হয়েছে। আগামীতে রংপুর বিভাগীয় মেলা আয়োজন করা হবে বলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কাছ থেকে আশ্বাস পাওয়া গেছে। কিন্তু শুধু মেলা করার আশ্বাস নয় আমাদের প্রয়োজন সরকারী প্রণোদনামূলক সুবিধাসহ ব্যাংক ঋণের সহযোগীতা। তা না হলে সম্ভাবনাময় এ শিল্প টিকিয়ে রাখতে আমরা চরম হুমকির মধ্যে আছি। আশা করি সরকার এ ব্যাপারে খুব দ্রুতই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন।
বিদেশ থেকে আমদানী নির্ভরতা কমিয়ে দেশেই পণ্য উৎপাদনে আরও উৎসাহ দিতে এসব প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ নাসিম আহমেদ জানান, স্থানীয়ভাবে এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি আমরা পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারি তাহলে দেখা যাবে যে আমাদের অধিকাংশ পণ্য স্থানীয়ভাবেই উৎপাদন এবং সরবরাহ করা সম্ভব। তাতে সরকারের ব্যয় অনেকটাই কমবে। পাশাপাশি রপ্তানী করার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার পথও সুগম হবে।
তিনি আরো বলেন, ইতোমধ্যে সৈয়দপুরের ব্যাংকগুলো এ ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষন করেছে। ইন শা আল্লাহ আগামীতে এ সেক্টরকে এগিয়ে নিতে সরকারীভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।