× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার , ৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

গণপরিবহন নারীর জন্য যেন এক বিষ ফোঁড়া

মত-মতান্তর

মো. সাইফুল ইসলাম মাসুম
৮ মার্চ ২০২০, রবিবার

স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছাত্রীরা কিংবা কর্মজীবি নারীরা স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য যেসব গণপরিবহন ব্যবহার করেন তা তাদের জন্য বিষ ফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাস্তব অভিজ্ঞতা ও চোখে দেখা অসহ্য ভোগান্তি দেখে তাই-ই মনে হয়েছে।

একদিন সকালে অফিসে যাচ্ছি ঢাকা থেকে বাসে উঠলাম, পাবলিক বাস ওই বাসেই পরবর্তী স্টপেজে ৪-৫ জন মেডিকেল ছাত্রী উঠলো। তারা ইউনিফর্ম/এপ্রোন পরা। একটা সিটও বাসে খালি নেই। এদের সবাই দাঁড়িয়ে রইলো। কি একটা দুরবস্থা। বাসে শুরু হলো চাপাচাপি।
আমি দাঁড়িয়ে একজনকে সিট দিলাম, তাদের প্রত্যেকের কাঁধে ব্যাগ, এভাবে আরো চারজন যদি দাঁড়িয়ে তাদের সিট দিত তাহলে তো আর কোনও সমস্যা থাকতো না। নির্বিকার যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হতো না ওইসব মেয়েদের। দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদের পেয়ে বাসে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য পুরুষযাত্রীদের মধ্যে একটা উৎসব উৎসব ভাব ফুটে উঠলো । সবার মাঝে কেমন যেনো একটা পুলকিত অনুভূতি। মনে হয় যেনো ক্ষূধার্ত হায়েনারা হঠাৎ পেয়েছে হরিণ শাবক্। লিউপার্ডরা এবার বেশ ক্ষেপে উঠেছে, ক্ষেপাটে লিউপার্ডদের কে রুখবে? বাস চলছে গাড়ি এদিক ওদিক হেলছে দুলছে আর বার বার মেয়েগুলোর উপরে হেলিয়ে দুলিয়ে পড়ছে পুরুষগুলো। হঠাৎ করেই বাসের সব পুরুষ কেমন যেন ব্যস্ত হয়ে উঠল। আর অসহায় বাচ্চা মেয়েরা কোনও রকমে নিজের আব্রু রক্ষা করে নিজেদের গন্তব্যে বাস আসার আগেই ঠিক পরের স্টপেজে নেমে পড়ে। কিন্তু তাতেই বা কি লাভ। অন্য কোনও বাসেই তো উঠতে হবে, আর এমনই তো হবে। আহারে নারী জীবনের অসহায়ত্ব! আমারও বোন আছে, ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ব্যাংকে চাকরি করে। পাবলিক বাসে চড়ে ভার্সিটিতে যায়, কর্মস্থলে যায়। বাঙালী সমাজে কি অদ্ভুত এক বাজে ব্যাপার-গণপরিবহনে নারীর হয়রানি।

বাংলাদেশের গণপরিবহন খাতকে বলা হয় একটি সেবামূলক খাত। কিন্তু আসলেই কি তা? নানা কারণে এখন আর গণপরিবহন সেবামূলক খাত হিসেবে নেই। এখন তা পরিণত হয়েছে গণভোগান্তি হিসেবে, বিশেষ করে নারীদের জন্য।ন্ত্রতিদিন সকালে উঠে বিভিন্ন বাস স্টপেজের সামনে দাঁড়ালে যেসব ভয়াবহ ও বিভৎস চিত্র দেখতে পাই, তা নিঃসন্দেহে ভীতিকর।

আমাদের অজ্ঞ ও নির্বোধ চিন্তার মানসিকতা, আমাদের সেকেলে ও ঘুমন্ত সমাজ ব্যবস্থা, জনগণের অসচেতনতা, নারীর প্রতি অবহেলা, আইনের শৈথিল্য, অসামঞ্জস্যপূর্ণ রাষ্ট্রনীতি, পূরুষযাত্রীদের স্বৈরাচারী মনোভাব, নারীর প্রতি ত্যাগ,  শ্রদ্ধাশীলতার অভাব, গণপরিবহনে নারীদের ভোগান্তি ও লাঞ্ছনার জন্য প্রধানতঃ দায়ী।

একটি স্কুলছাত্রী থেকে শুরু করে মধ্যবয়স্ক কর্মজীবি নারী পর্যন্ত কেউই যেন নিরাপদ নয়। বাসযাত্রী থেকে ড্রাইভার, কনট্রাক্টর, হেলপার পর্যন্ত প্রতিটি পুরুষই যেন নারীর প্রতি নন-কোঅপারেটিভ। পুরুষদের ভূমিকা যেন হায়েনার মত। প্রায়ই দেখা যায় বাসের হেলপাররা বাসে ওঠানো-নামানোর সময় নারীদের কোমরে-পিঠে ধাক্কা দেয়,  যখন প্রয়োজন নেই তখনও। সুস্থ, সক্ষম নারীকেও ধাক্কা দিতে ভুল করে না বাসের হেলপার, ‘অবলা’ নারী মুখ বুজে সহ্য করে এসব হাজারো নিযার্তন, কথা বলে না লোকলজ্জার ভয়ে। গাড়িতে চেঁচিয়ে ওঠে না। বাঙালী নারীর চিরচেনা এই লাজুকতাকে পুঁজি করেই হিংস্র হায়েনার মত নেশায় মেতে উঠেছে সহস্র পুরুষ। বাসে যখন সিট থাকে না তখন দাঁড়িয়ে থাকা নারীদের গা ঘেঁষে দাঁড়ায় আমাদের তথাকথিত সভ্য সমাজের এক ধরণের বিকৃত মানসিকতার সব বয়সী পুরুষ। কি যুবক, কি বৃদ্ধ, বাদ যায় না কেউ-ই।

পুরুষদের সামনে কোন বৃদ্ধ মা, কোলের বাচ্চাসহ তরুণী মা, শিশু বাচ্চাসহ যুবতী মা, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, সন্তন কিংবা ছোটবোনতূল্য কোনও কিশোরীও যদি বেকায়দায় দাঁড়িয়ে থাকে তবুও কেউ কেউ উঠে দাঁড়িয়ে তাদেরকে সিট স্যাক্রিফাইজ করে না, কেউ তাদের সম্মান জানায় না। কন্যা সন্তনতূল্য স্কুলছাত্রী ভীষণ ভারী স্কূলব্যাগটা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও কেউ তাদের বসতে দেয় না। তাছাড়া নানা কায়দায় যৌননিপীড়ন তো আছেই।পুরুষের কামুক চোখের লোলুপ চাহনীর নিপীড়নটাই তো মারাত্মকভাবে অসহনীয় ।

নারীদের ওপর একের পর এক যৌন নিপীড়ন চলছেই। এত এত ঘটনা প্রতিদিন এই দেশে ঘটে যাচ্ছে তার যৎসামান্যই প্রকাশ পাচ্ছে। প্রতিদিন আমরা যা দেখি তার এক-দশমাংশও প্রকাশ পায় না। শুধুমাত্র পাবলিক বাসগুলোতে যে নিপীড়নের ঘটনা ঘটে তা নিয়ে এক উপাখ্যান লেখা যাবে। আমরা লিখতে চাই না, আমরা চাই প্রতিকার। নারীরা, বিশেষ করে নারীর শ্লীলতাহানি ও যৌন হয়রানির ঘটনা যেন আর কোনও লেখকের লেখনীর উপজীব্য না হয়। শ্রদ্ধা ভালোবাসায় বিনির্মিত হোক মাতৃতুল্য মায়ের জাতি নারীর জীবন।

শুধুমাত্র বিত্তবান নারীরা যাদের নিজস্ব গাড়ি আছে তারা হয়তো এই ভোগান্তির শিকার হন না, কিংবা দেখেনও না। কিন্ত এই রকম নারীর সংখ্যা নগণ্য।

গণপরিবহনে নারীদের এই ভোগান্তির জন্য আমরা সকলেই কোন না কোনভাবে দায়ী। বাসের চালক, কনট্রাক্টর ও হেলপাররা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিপীড়ন করছে সব সময়ই, মোটামুটি সব গণপরিবহনেই। আর সেই সাথে একই বাসের ভেতর যাত্রীবেশে আমরা ভদ্রতার মুখোশধারী অসভ্য পুরুষরাও করছি অদৃশ্য হয়রানি। নারীদের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক স্পেশাল বাস সার্ভিস চালু করতে পারতো সরকার। প্রতিটা বাসে নারীদের জন্য সংরক্ষিত সিটের সংখ্যা আরোও বাড়াতে পারতো। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আরো অনেক কিছুই সম্ভব। বড় বাসগুলাতে নারীদের জন্য সংরক্ষিত প্রবেশদ্বার রাখা, নারীদের জন্য আলাদা বাস স্টপেজ রাখা ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমরা নিজেরাই নিজ নিজ অঙ্গণে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি।‘আমার সামনে অন্তত কোনও নারীর মযার্দাহানি হতে দেবো না। আমার চোখের সামনে কোনও নারীকে লাঞ্ছিত হতে দেবো না, আর যেনো কোনও নারী পাবলিক বাসে লাঞ্ছিত না হয়। আমাদের সামনে যেন কোনও নারী বাসে দাঁড়িয়ে না থাকে। কোনও নারীর সাথে কোন পুরুষ যেন গা ঘেঁষে না দাঁড়ায়– এই প্রতিজ্ঞায় মুষ্ঠিবদ্ধ হই।

আজ ৮ই মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই দিনে আমাদের অঙ্গীকার হোক ‘নারীরা নিরাপদে ঘরে ফিরবে, নারীরা নিরাপদে বাইরে যাবে, নারীদের জন্য চাই নিরাপদ বাসভূমি, গণপরিবহন হোক নিরাপদ ও নিপীড়নমুক্ত।’

(লেখক: ব্যাংকার ও প্রাবন্ধিক)
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর