শেষের পাতা

একযোগে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলিত হয় এদিন

নূরে আলম সিদ্দিকী

২০২০-০৩-২৩

১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত ২৩শে মার্চ উদ্‌যাপিত হতো পাকিস্তান দিবস বা লাহোর প্রস্তাব দিবস হিসেবে। এদিন পাকিস্তানের পতাকায় আচ্ছন্ন থাকতো রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, দোকানপাট সব। যেদিকে তাকাতাম, চাঁদ-তারা আর চাঁদ-তারা। মনে হতো যেন রাত ঘনিয়ে এসেছে চতুর্দিকে। এই বছরই, সম্ভবত মার্চ মাসের ১৮/১৯ তারিখ জনাব আবদুর রাজ্জাকের উপস্থিতিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে, অর্থাৎ তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আর নয়, এবার পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে ২৩শে মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উঠবে। প্রতিটি যানবাহনে, ভবনে, সমস্ত কার্যালয়ে, উচ্চ আদালতে উত্তোলিত হবে ওই পতাকা। এই নির্দেশনার আলোকে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পূর্বঘোষিত ও সুস্পষ্ট পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পতাকা উত্তোলন দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এটা প্রদীপ্ত সূর্যের মতো সত্য যে, শুধু পল্টনেই নয়, সমগ্র দেশের প্রতিটি বিভাগ, জেলা ও মহকুমা শহরেও ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ডাকে একযোগে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলিত হয় এদিন। কেবলমাত্র ক্যান্টনমেন্ট, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের খণ্ডিত অবাঙালি অধ্যুষিত কয়েকটি এলাকা ছাড়া সব জায়গা থেকে পাকিস্তানের শেষ চিহ্নটি অবলুপ্ত করে দেয়া হয়।

২৩শে মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলন দিবস, এটা ইতিহাসস্বীকৃত বাস্তব। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, এই পতাকাটি যতদিন আপন মহিমায় গৌরবদীপ্ত ভঙ্গিমায় বাঙালির সুতীব্র আবেগের আবীর মাখিয়ে উড্ডীয়মান থাকবে- ততদিন দিগন্তবিস্তীর্ণ আকাশের বক্ষে প্রদীপ্ত সূর্যের মতো শাশ্বত এবং স্মরণীয় থাকবে। ওইদিন ইসলামাবাদে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর উড্ডীয়মান পাকিস্তানের পতাকাখচিত মঞ্চে দাঁড়িয়ে সামরিক অভিবাদন গ্রহণ করতেন। এই দিনটিতেই আমরা পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলনের নির্দেশনা প্রদান করি। এর আগের দিন ২২শে মার্চ গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত বিবৃতি প্রদান করি। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে (পূর্বের ইকবাল হল) স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ছিল বলেই প্রায় সার্বক্ষণিক দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের কর্মীদের পদচারণায় মুখর থাকতো। এটা নতুন প্রজন্মের অবগতির জন্য উল্লেখ্য যে, আমাদের আন্দোলনের মূল স্থপতি বঙ্গবন্ধু ছিলেন এবং ২৩শে মার্চ তারই অভিবাদন গ্রহণ করা বাহ্যত সঙ্গত ছিল কিন্তু সেটি হয়নি। কেননা, তিনি ওইদিন অভিবাদন গ্রহণ করলে ঘুরেফিরে বিচ্ছিন্নতাবাদের অপবাদটি তার স্কন্ধে বর্তাতো। ২৩শে মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃ-চতুষ্টয়ের অভিবাদন গ্রহণ সন্দেহাতীতভাবে আবারো প্রমাণ করলো আমাদের প্রাণের মুজিব ভাই, স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মননশীলতা ও মানসিকতা, প্রতীতি ও প্রত্যয়, আদর্শ ও চেতনা তো বটেই; ক্ষেত্রবিশেষে তাঁর অবয়বেরও প্রতিনিধিত্ব করতো স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। বলাবাহুল্য, এসব সিদ্ধান্ত একমাত্র বঙ্গবন্ধুর সম্মতিতেই আমরা গ্রহণ করতাম।
পূর্ব-নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে সারা বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকাটি সগৌরবে উড়িয়ে দেয় এদেশের স্বাধীনতা-পাগল মানুষ। আনুষ্ঠানিকভাবে পল্টন ময়দানে আমরা চারজন মঞ্চে দাঁড়াই অভিবাদন গ্রহণের জন্য এবং খসরু, মন্টু, সেলিম, সম্ভবত হাসানুল হক ইনুও সঙ্গে ছিলেন। বিউগলে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের সুর ভেসে আসছে। ধীরে ধীরে পতাকাটি উড়লো আর শুরু হলো একেকটি ব্রিগেডের অভিবাদন দেয়ার অভিযাত্রা। ৩০৩ রাইফেল থেকে উপর্যুপরি আকাশের দিকে গুলিবর্ষণ হতে লাগলো। তখন আউটার স্টেডিয়ামটি ছিল না। যতদূর চোখ যায়, সীমাহীন সমুদ্রের উচ্ছ্বসিত ঊর্মিমালার মতো মানুষ আর মানুষ। কর্মসূচি অনুযায়ী আমরা ওই ব্রিগেড ও স্বতঃস্ফূর্ত জনতাকে নিয়ে মার্চপাস্ট করে ৩২ নম্বরে গিয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে আমি বঙ্গবন্ধুর হাতে পতাকাটি তুলে দেই। পতাকাটি গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি উচ্চারণ করেন। আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করছিলাম, আমার চিত্ত উদ্বেলিত হয়েছিল, উদ্যত উদ্‌গত উদ্ধত পূর্ণায়ত পদ্মটির মতো আমার সমস্ত সত্তা দুরন্ত আবেগে অনুভব করছিল- লক্ষ জনতার কণ্ঠ হতে জয় বাংলা স্লোগানটি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে ইথারে ভাসতে ভাসতে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে।
আজকে যারা সুপরিকল্পিতভাবে ছাত্র ইউনিয়নকে স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলনের সিংহভাগ কৃতিত্ব অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেতভাবে প্রদান করার অপচেষ্টায় ব্যাপৃত, তাদের এই অভিলাষ এবং অভিপ্রায়ের প্রেক্ষিতে নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে ২৩শে মার্চের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরতে চাই। বাঙালির জাতীয় চেতনার উন্মেষ, বিকাশ, ব্যাপ্তি ও সফলতার আন্দোলনের সোপানগুলোয় ছাত্রলীগই একেকটি আন্দোলনের সফলতার মধ্যদিয়ে এর ব্যাপ্তি ও বিকাশ ঘটিয়েছে। প্রতিটি স্তরের জাগ্রত জনতার মানসিকতায়, তাদের হৃদয়ের ক্যানভাসে বাঙালি সত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে শুধু হাল ধরা নয়, ক্রমান্বয়ে তাদেরকে উচ্চারণ করতে হয়েছে- “তুমি কে, আমি কে? বাঙালি বাঙালি”, “পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা”।
বাঙালির হৃদয়স্পর্শী এসব স্লোগান উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তথাকথিত রোমান্টিক বামদের (মস্কো, পিকিং উভয়ই) কতই-না কটাক্ষ সইতে হয়েছে, প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়েছে। আমাদের প্রাণের মুজিব ভাইকে তারা ভারতের চর, সিআইএ’র দালাল বলে গালিগালাজ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। ক্ষেত্রবিশেষে এনএসএফ ও ইসলামী ছাত্রসংঘের চাইতেও তাদের বক্তব্য ছিল নেতিবাচক ও আক্রমণাত্মক। ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ক্রমেই এই বিরোধ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। মুজিব ভাই ৬ দফা প্রদানের পর আমাদের স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার আন্দোলনে পদার্পণের মুহূর্তে তারা আমাদের এতটাই সমালোচনা করে যে, সিআইএ’র দালাল ও ভারতের চর তো বলতোই, এমনকি তাদের রাজনৈতিক সংগঠন ন্যাপ-এর নেতারা ৬ দফা প্রদানের মাধ্যমে স্বাধীনতার উপক্রমণিকা ও প্রচ্ছন্ন প্রচ্ছদপট হিসেবে আমরা যেমন বিশ্বাস করতাম, তারাও তেমনি বিশ্বাস করে প্রচণ্ড বিরোধিতা করেছিল। মশিউর রহমান যাদু মিয়া এমনকি পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে মুজিব ভাই’র মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দাবি করেছিলেন।
স্বপ্নবিলাসী বিপ্লবীরা আমাদেরকে যখন প্রতিক্রিয়াশীল বলে গালিগালাজ করতেন, আমরা ৫৬ হাজার বর্গমাইলের সীমানা অতিক্রম করতে পারি না- এই তির্যক কটাক্ষ করতেন, তখন আমরা, বিশেষ করে আমি সারা বাংলাদেশে বাউলের মতো বাঙালির ঐতিহ্য, তার মননশীলতা, সংস্কৃতি ও সাহিত্য তিলতিল করে তুলে ধরে বলতাম- “এ মাটি আমার সোনা, আমি করি তার জন্মবৃত্তান্ত ঘোষণা”, “সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি, যে আছে মাটির কাছাকাছি”, “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর”। আমার কণ্ঠে বজ্রনির্ঘোষে বাংলার প্রতিটি কন্দরে কন্দরে উচ্চারিত হতো- “লেনিন, স্ট্যালিন, চে গুয়েভারা, ফিদেল ক্যাস্ট্রো বা মাও সেতুংকে আমি অশ্রদ্ধা করি না। কিন্তু বাংলার দোঁআশ মাটির অপূর্ব গন্ধ আমাকে বিমোহিত করে, খরতপ্ত রৌদ্রে হালচাষ করা কৃষকের বুক-নিঃসৃত ঘাম আমার চিত্তকে উদ্বেলিত করে, দুর্গন্ধময় পানিতে দাঁড়িয়ে পাট-কাচা কৃষকের গায়ের গন্ধ আমার চিরায়ত সত্তার উৎস। যে গ্রাম্য জননী মাঝরাতে উঠে ধান সেদ্ধ করে, ঢেঁকিতে পাড় দেয়, জর্দা দিয়ে পান খেয়ে পিক ফেলে, শহরের প্রসাধনী নয়, পূতঃপবিত্র বাংলার মাটি গায়ে মেখে গোসল করে, ঘোরতর খররৌদ্রে উঠোনে ধান শুকায়- সেই গ্রাম্য বালাকে মা বলে ডাকতে পারি বলেই, আমার নেতা লেনিন, স্ট্যালিন, চে গুয়েভারা, ফিদেল ক্যাস্ট্রো বা মাও সেতুং নয়; আমার নেতা শেরেবাংলা, আমার নেতা সোহরাওয়ার্দী, আমার নেতা শেখ মুজিব। পেন্টাগন, ক্রেমলিন বা দিল্লির শক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে নয়, শেখ মুজিবের একক নেতৃত্বে আমরা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে হলেও পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনবোই।”
২৩শে মার্চের এই নিবন্ধে সত্যের খাতিরে আমাকে উল্লেখ করতেই হয়, বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে কীভাবে? তার জন্য একটি গণম্যান্ডেট দরকার। ’৬৬-এর ৭ই জুন মনু মিয়ার বুকনিঃসৃত রক্তকণা থেকে বাংলাদেশ দৃপ্তশপথে উজ্জীবিত হয়- আজ আর স্বাধিকারের কথা নয়, আমরা পরিপূর্ণ স্বাধীনতা চাই এবং তারই সনদ ৬ দফা। অতি সংক্ষেপে বিবৃত করা যায়, মুজিব ভাই থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের প্রায় সকল শীর্ষ নেতাকে এবং ছাত্রলীগের শেখ ফজলুল হক মণি, আব্দুর রাজ্জাক, আল মুজাহিদীকে দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। সৌভাগ্য আমার, ’৬৬-এর ৭ই জুনের পর গ্রেপ্তারকৃত ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে আমিই ছিলাম প্রথম। পরে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড় করানোর লক্ষ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয়। ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ মিছিলটি বের করে জগন্নাথ কলেজ। সঙ্গে তখনকার কায়েদে আযম কলেজ। এই বিশাল দৃপ্ত মিছিলের নেতৃত্ব দেন ছাত্রলীগের সর্বজনাব কাজী ফিরোজ, এমএ রেজা, সাইফুদ্দিন, মফিজ, ছাত্র ইউনিয়নের ইয়াকুব। যার ফলশ্রুতিতে তারাও সকলে কারারুদ্ধ হন। বিস্তৃত বিবরণে না গিয়ে বলতে হয়, দীর্ঘদিন পর ’৬৯-এর গণআন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২৪শে জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয়। যখন ঢাকা শহর আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো বিস্ফোরিত হয়, তখন লৌহমানবখ্যাত আইয়ুব খানকে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করতে হয়। ’৬৯-এর ফেব্রুয়ারি মাসের ১১ তারিখ আমরা মুক্তি পাই। বঙ্গবন্ধু অবমুক্ত হন ২১ তারিখে। ইতিহাসকে সম্মান করি বলেই আমি দ্বিধাহীন চিত্তে বলবো- ১১ দফার সংগ্রাম কমিটি সর্বদলীয় হলেও ডাকসু’র ভিপি তোফায়েল আহমেদই সংগ্রাম কমিটির মুখপাত্র হিসেবে কার্যপরিচালনার গৌরব অর্জন করেছেন। ১১ দফায় ৬ দফাকে সম্পূর্ণ অবিকৃত রেখে সম্পৃক্ত করার কৃতিত্বও ছাত্রলীগ নেতৃত্বের। কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে দেখলাম, বাঙালি জাতীয় চেতনার একমাত্র প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগেও সশস্ত্র বিপ্লবের মননশীলতায় একটি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। তারা কার্ল মার্ক্স, লেনিন, স্ট্যালিন, চে গুয়েভারাকেও যেন ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। তাদের চেতনার ধ্রুবতারা ছিল রেজিস দেব্রে। তিনি বিশ্বাস করতেন, বিপ্লবের মধ্যে বিপ্লব (ৎবাড়ষঁঃরড়হ রিঃযরহ ৎবাড়ষঁঃরড়হ)। রেজিস দেব্রে বিশ্বাস করতেন, সশস্ত্র বিপ্লব কখনো থেমে থাকে না। সমুদ্রের উচ্ছ্বসিত তরঙ্গমালার মতো একটি তরঙ্গ ধ্বংসের মধ্যদিয়ে আরেকটি তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। এই মননশীলতায় বিশ্বাসীদের কাছে নির্বাচন অর্থহীন এবং হাস্যকর। ৭০-এর নির্বাচনকে তারা পাত্তাই দিতে চাননি। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’- এটিই ছিল তাদের চিন্তার প্রতিপাদ্য। তাদের স্লোগান ছিল- ‘বাংলার অপর নাম, ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম’, ‘বিপ্লব বিপ্লব, সশস্ত্র বিপ্লব’, ‘নির্বাচনের কথা বলে যারা, ইয়াহিয়া খানের দালাল তারা’, ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো”।
আজকেও আমি ভাবলে শিউরে উঠি, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সশস্ত্র বিপ্লবীদের উচ্চকিত স্লোগানের ফলশ্রুতিতে ৭০-এর নির্বাচনটি যদি আমরা করতে না পারতাম, তাহলে বঙ্গবন্ধু গণম্যান্ডেটটি পেতেন কোথা থেকে? ৭০-এর নির্বাচন বঙ্গবন্ধুকে একক নেতৃত্বেই অধিষ্ঠিত করে নাই, তাকে বাংলার স্বাধীনতা অর্জনের মূল কর্ণধারের অধিকার প্রদান করে এবং এই লক্ষ্যে যেকোনো কর্মসূচি গ্রহণের অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা এবং বৈধতা আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্গে ন্যস্ত করে। এই সশস্ত্র বিপ্লবীদের সঙ্গে আমাদের মনস্তাত্ত্বিক চেতনার বিভাজনের বিস্তীর্ণ বিবরণ নিবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি করবে।
সারাবিশ্ব জুড়ে যখন সমাজতন্ত্রের উন্মাদনা অগ্নিঝরা সশস্ত্র বিপ্লবের মানসিকতায় উদ্দীপ্ত তরুণ সমাজ, বাংলাদেশেও তখন তরুণ ও যুব সমাজের মধ্যে এই মানসিকতার প্রভাব তুঙ্গে। তার মধ্য থেকে ৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে ছাত্রলীগের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সফলতা ও গৌরবময় অর্জন।
স্বাধীনতা অর্জনে সশস্ত্র বিপ্লব ও নির্বাচনের প্রশ্নে দুটি ধারা থাকলেও স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রশ্নে কোনো বিভাজন ছিল না। তাই ৭০-এর নির্বাচনে আমরা নিরঙ্কুশ জয়টি নিতে পেরেছিলাম এবং বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্বের একক কর্তৃত্ব লাভ করেছিলেন। এটি আমাদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত। তবুও আধিপত্যবাদী পাকিস্তানি শক্তি তাদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখার নেশায় নির্বাচনের গণম্যান্ডেট ও বঙ্গবন্ধুর কর্তৃত্বকে মেনে নিতে পারেনি বলেই ৩রা মার্চের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষিত করে। ১লা মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং ২রা মার্চ, ৩রা মার্চ, ২৩শে মার্চ এবং ২৬শে মার্চে স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা একই ধারাবাহিকতার ফসল। নির্বাচনের ম্যান্ডেট-বিবর্জিত বঙ্গবন্ধুর যেকোনো ডাক শ্রীলঙ্কার এলটিটি, পাঞ্জাবের খালিস্তান, সেভেন সিস্টারসহ পৃথিবীর বহু দেশের ব্যর্থ আন্দোলনের মতোই বিচ্ছিন্নতাবাদের আখ্যা পেয়ে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতো। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস ম্যান্ডেট-বিবর্জিত হওয়ার পরও বৈপ্লবিক চেতনার মহাপুরুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন কিন্তু স্বাধীনতা এসেছে কংগ্রেসের হাত ধরে নির্বাচনের ম্যান্ডেট নিয়েই। এই নিবন্ধে আমি আর কোনো উদাহরণ টানতে চাই না।
আজকের এই দিনে আমার গৌরবের দিকটি উচ্চকিত কণ্ঠে তুলে ধরতে চাই। সংবাদমাধ্যমগুলো যেভাবেই উত্তাল মার্চের দিনগুলোকে তুলে ধরুক না কেন, সূর্যালোকের মতো সত্য যে, বঙ্গবন্ধু শুধু আমাদের নির্দেশকই ছিলেন না, তিনি আমাদের কথা শুনতেন, আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ করতেন। বোধ করি সেজন্যই দেশের মানুষ আমাদের ৪ জনকে খলিফা সম্বোধন করতে শুরু করে। আজ পর্যন্ত আমাদের গৌরবদীপ্ত পরিচয় আমরা বঙ্গবন্ধুর ৪ খলিফা।
২৩শে মার্চকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের সকল নেতৃত্বের কাছে আমার আকুতি, আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতের যত পার্থক্যই থাকুক না কেন, ছাত্রলীগের গৌরব মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র, ছাত্রলীগকে অবক্ষয়ের অতলান্তে নিক্ষেপ করার অপপ্রয়াসকে প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে যে যার আঙ্গিক থেকে সক্রিয় হয়ে উঠুন। ছাত্রলীগ আপন ঐতিহ্যে ফিরে আসলে দুর্নীতি, দুর্বিচার ও সব রকমের অবক্ষয় থেকে জাতি রক্ষা পাবে, ইনশাআল্লাহ।
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status