লকডাউনের পর এক সপ্তাহ কেটে গেছে বৃটেনে। থমকে গেছে জীবনযাত্রা। প্রগতির দেশ যুক্তরাজ্য এখন কার্যত স্থবির। অফিস, আদালত, শপিং মল, সিটি সেন্টার থেকে সাধারণ দোকানপাট সবই। কয়দিন আগেও যেখানে লোকজনের আনাগোনায় মুখরিত থাকতো সেখানে এখন সুনসান নীরবতা। রাস্তাঘাটে যানবাহন খুবই কম। লোকজন ঘরবন্দি।কিন্তু এখনো হু হু করে বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর ঘটনা। সবচেয়ে বেশী মৃত্যু ঘটেছে লন্ডনে, তারপরই বার্মিংহামের অবস্থান।
তবে পরিস্থিতি তুলনামূলক নিয়ন্ত্রনে আছে স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও নর্দান আয়ারলযান্ডে। লকডাউনের আগে যারা সংক্রমিত হয়েছেন তাদের শরীরে ভাইরাসের লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে ফলে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। যাদের আগে থেকেই বয়সজনিত বা অন্যান্য শারীরিক জটিলতা রয়েছে তারা দ্রুতই কাবু হচ্ছে করোনায়। মৃতের সংখ্যা বাড়ছে তাই। সংক্রমন বিস্তাররোধে লকডাউনের ঘোষনা দেয়ার পর দেখা যাচ্ছে তার কঠোর বাস্তবায়ন। পাশাপাশি চিকিৎসাসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। নাগরিকদের মোবাইল বার্তার মাধ্যমে ঘরে থাকার নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। প্রতিদিন পরীক্ষা করা হচ্ছে হাজার হাজার রোগির। আক্রান্তদের মধ্যে যারা প্রাথমিক স্তরে রয়েছেন তাদের পাঠানো হচ্ছে আইসোলেশনে।গুরুতর আক্রান্তদের ভর্তি করা হচ্ছে হাসপাতালে। সরকারের তরফে লন্ডন, বার্মিংহাম ও মানচেস্টারে চালু করা হচ্ছে তিনটি অস্থায়ী বিশেষ হাসপাতাল। এই তিন হাসপাতাল মিলিয়ে শয্যা থাকবে ১০ হাজার। পাশাপাশি বার্মিংহাম বিমানবন্দরের একটি অংশে ১৫০০ মৃতদেহ রাখার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে মর্গ। জাতীয় স্বাস্হ্য সংস্থা এনএইচএস তাদের অবসরে যাওয়া স্বাস্থ্যকর্মীদের তলব করেছে। স্বেচ্ছাসেবি হিসেবে কাজ করার জন্য আবেদন আহ্বানের পর বিপুল সাড়া পড়েছে সে আহ্বানে। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা আশংকা করছেন ইতালীর মতো বড় ধরনের বিপর্যয়ের শিকার হতে পারে বৃটেন। ২৮ মার্চ এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাজ্যের কমিউনিটি সেক্রেটারি রবার্ট জেরনিক বলেছেন, ‘দেশের সব জায়গা এখন জরুরি অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এটি শান্তির সময়ের এক অভূতপূর্ব পদক্ষেপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমরা এ জাতীয় কিছু করিনি।এর অর্থ এই যে আমরা পুরো দেশ জুড়ে কৌশলগত সমন্বয় কেন্দ্র স্থাপন করছি।’
২০২০ সালের জানুয়ারীর শেষে যুক্তরাজ্যে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগি সনাক্ত হয়। ফেব্রুয়ারি জুড়ে বেশ কয়েকজন লোকের করোনা টেস্ট পজেটিভ আসে। মার্চের শুরুতে যুক্তরাজ্যের পরিসংখ্যান বাড়তে শুরু করে। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে এসে এই সংখ্যা এখন অত্যন্ত দ্রুত বৃদ্ধি পায়। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে। শনিবারে প্রতিদিনের নিশ্চিত হওয়া মামলার আগের দিনের তুলনায় ২,৫০০-রও বেশি লাফিয়ে উঠেছে। সবচেয়ে আতংকের বিষয় হচ্ছে আক্রান্তের মতোই ইংল্যান্ডে অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাড়ছে করোনা ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা। মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ষাটোর্ধ বয়সি মানুষের সংখ্যাই বেশি। তবেত্রিশের কোটার বয়সিও রয়েছে মৃতের তালিকায়। যুক্তরাজ্যের বেশিরভাগ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ইংল্যান্ডে। মূলত লন্ডনে। লন্ডনে এপর্যন্ত সাড়ে তিনশ জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। ৩০ মার্চের সরকারী পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, লন্ডনে এখন আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার। লন্ডনের সাউথওয়ার্ক, ল্যাম্বেথ, ব্রেন্ট, ক্রয়েডন, ওয়ান্ডসওয়ার্থ সবখানেই প্রতিদিন সনাক্ত হচ্ছে উল্লেখ যোগ্য সংখ্যক আক্রান্ত। লন্ডনের বাইরে বার্মিংহাম, শেফিল্ড এবং হ্যাম্পশায়ারই বেশি। বার্মিংহাম সিটিসহ আশপাশের টাউনগুলোতে প্রতিদিনই বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। তবে বৃটেনের অপর তিন অংশ স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও উত্তর আয়ারল্যান্ডেপরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। এই তিন দেশে মৃতের সংখ্যা ১০০ পেরোয়নি।
প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ২৩ শে মার্চ এই রোগের অপ্রয়োজনীয় সংক্রমণ এড়াতে লোকজনকে ঘরেই থাকার আহ্বান জানিয়েলকডাউন ঘোষণা করেছেন। তারপর তিনি নিজেই ভাইরাস পরীক্ষায় পজেটিভ হয়েছেন। ব্রিটিশ রাজপরিবারের সিনিয়র সদস্যপ্রিন্স চালর্স করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। দুটো ঘটনাই সবার জন্য আলার্মিং। এনএইচএস ইংল্যান্ডের চিকিত্সক পরিচালক স্টিফেন পাওস সতর্ক করে বলেছেন, যুক্তরাজ্য যদি মৃতের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে আমাদের প্রত্যেকেরই ভূমিকা রাখতে হবে।বৃটেনের আশংকার কারণ হচ্ছে, দেশে শ্বাস-প্রশ্বাসের সংক্রমণে আক্রান্তদের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে করোনা ঝুঁকিরমাত্রাও অত্যাধিক। ইংল্যান্ডের হাসপাতাল কর্মীরা ডাক্তার-নার্স থেকে শুরু করে প্রতিদিন হাজার হাজার লোকের করোনা টেস্ট করছেন। পেশাগত কারণে ঝুঁকির শীর্ষে রয়েছেন চিকিৎসক ও নার্স। ইংল্যান্ডের পাশাপাশি ওয়েলস, স্কটল্যান্ড এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডে স্বাস্থ্য কর্মীদের ইতিমধ্যে পরীক্ষা করা হচ্ছে।
হাসপাতালের প্রতিনিধিত্বকারী এনএইচএস সরবরাহকারী ক্রিস হপসনের মতে লন্ডনের হাসপাতালগুলো করোনা ভাইরাসরোগের শুনানীর মুখামুখি হচ্ছে এবং নিবিড় পরিচর্যা শয্যা শেষ হতে শুরু করেছে। পূর্ব লন্ডনের এক্সকেল প্রদর্শনী কেন্দ্রটি রূপান্তর করা হচ্ছে একটি ফিল্ড হাসপাতালে। যেখানে সর্বমোট চার হাজার রোগী ভর্তি রাখা যাবে। এছাড়া ইংল্যান্ডে আরও দুটি অস্থায়ী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেছে সরকার। যার একটি বার্মিংহামের এনইসি কেন্দ্রে পাঁচ হাজার শয্যা এবং অন্যটি ম্যানচেস্টারের কনভেনশন কমপ্লেক্সে এক হাজার শয্যা বিশিষ্ট। অন্যদিকে বার্মিংহাম বিমানবন্দরের কিছু অংশে একটি মর্গে পরিনত করার কাজ শুরু হয়েছে। যেখানে কমপক্ষে ১,৫০০ মৃতদেহ রাখা যাবে। যদি মৃতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায় এটি ব্যবহ্নত হবে। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় অবসরপ্রাপ্ত এনএইচএস কর্মীদের কাজে ফিরে যেতে বলা হয়েছে। দুর্বলদের জন্য খাবার ও ওষুধ সরবরাহে সহায়তার জন্য এনএইচএস যে স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগের ঘোষনা দেয় তাতে বিপুল পরিমান (প্রত্যাশার চেয়ে বেশী) আবেদন জমা পড়েছে।
জন হপকিন্স ইউভার্সিটির ২৬ মার্চ প্রকাশিত এক গবেষনার গ্রাফ করে ইউরোপের দেশগুলোর পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। সে গ্রাফ অনুযায়ী ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যায় বিপর্যস্ত দেশ ইতালি। ইতালিতে মৃত্যুর সংখ্যা গড়ে প্রতি তিন দিনে দ্বিগুণ হয়েছে। তবে লকডাউন পরবর্তি এই বর্ধনের ধীর গতিতে এটি ইঙ্গিত দেয় যে মহামারীটির ক্রমটি পরিবর্তিত হচ্ছে। অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর তুলনায় ব্যতিক্রম কেবল স্পেন। এখানে মৃত্যুর হার অত্যন্ত বেশী। সে গ্রাফমতে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, যুক্তরাজ্য কি ইতালির মতো সংক্রমন ও মৃতের সংখ্যায় শিখরের পৌঁছানোতে কয়েক সপ্তাহ পিছনে রয়েছে? তবে তারা কোনো সরাসরি উপসংহারে আসেনি। তারা বলেছে, প্রতিটি দেশে আলাদা আলাদা স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা রয়েছে এবং ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছে। মৃত্যুর সংখ্যা ভাইরাসের সংক্রমণ এবং লোকেরা যখন তাদের কাছে নিয়ে যেতে পারে তখন যে চিকিত্সা ব্যবহার করতে পারে তার উপর নির্ভর করে। প্রতিটি দেশের ভবিষ্যত সরকার এবং নাগরিকরা যেপদক্ষেপ নেয় তার উপর নির্ভর করে।