‘করোনা’ মহামারি নিয়ে নানা আলোচনা। কোন্ দেশে এটি নিয়ে ছবি নির্মিত হয়েছে। কোন্ দেশে কোন্ লেখক ‘লকডাউন’ শব্দটি আগেই ব্যবহার করেছেন। কোয়ারেন্টিন অথবা আইসোলেসন শব্দটি কার কথায় বা লেখায় এসেছে। এমন এন্তার আলোচনা চলছে জানুয়ারিতে উহানে এ রোগের উদ্ভব থেকেই। অনেক দেশেই মৃত্যুর হিসেব নিয়ে আলোচনার বাইরে এ নিয়েও আলোচনায় হচ্ছে। কিন্তু অবাক বিষ্ময়ে লক্ষ্য করলে দেখা যায় বাংলা সাহিত্যও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। আজ থেকে একশো তিন বছর আগে প্রকাশিত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস শ্রীকান্তের দ্বিতীয় পর্বে ‘কোয়ারেন্টিন’ শব্দটির সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
এতে ‘কোয়ারেন্টিনের’ বাইরে ‘ছোঁয়াচে রোগ’ শব্দটির উপস্থিতি দেখা যায়।
১৯১৭ সালে প্রকাশিত ‘শ্রীকান্ত দ্বিতীয় পর্ব’ উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘পরদিন বেলা এগার-বারটার মধ্যে জাহাজ রেঙ্গুনে পৌঁছিবে; কিন্তু ভোর না হইতেই সমস্ত লোকের মুখচোখে একটা ভয় ও চাঞ্চল্যের চিহ্ন দেখা দিল। চারিদিক হইতে একটা অস্ফুট শব্দ কানে আসিতে লাগিল, কেরেন্টিন্ - কেরেন্টিন্। খবর লইয়া জানিলাম, কথাটা Quarantine: তখন প্লেগের ভয়ে বর্মা গভর্নমেন্ট অত্যন্ত সাবধান। শহর হইতে আট-দশ মাইল দূরে একটা চড়ায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়া খানিকটা স্থান ঘিরিয়া লইয়া অনেকগুলি কুঁড়েঘর তৈয়ারি করা হইয়াছে; ইহারই মধ্যে সমস্ত ডেকের যাত্রীদের নির্বিচারে নামাইয়া দেওয়া হয়। দশদিন বাস করার পর, তবে ইহারা শহরে প্রবেশ করিতে পায়। তবে যদি কাহারও কোন আত্মীয় শহরে থাকে, এবং সে Port Health Officer-এর নিকট হইতে কোন কৌশলে ছাড়পত্র যোগাড় করিতে পারে, তাহা হইলে অবশ্য আলাদা কথা।
ডাক্তারবাবু আমাকে তাঁহার ঘরের মধ্যে ডাকিয়া লইয়া বলিলেন, শ্রীকান্তবাবু, একখানা চিঠি যোগাড় না ক’রে আপনার আসা উচিত ছিল না; Quarantine-এ নিয়ে যেতে এরা মানুষকে এত কষ্ট দেয় যে কসাইখানায় গরু ছাগল- ভেড়াকেও এত কষ্ট সইতে হয় না। তবে ছোটলোকেরা কোন রকমে সইতে পারে, শুধু ভদ্রলোকদেরই মর্মান্তিক ব্যাপার।’
শরৎচন্দ্রের লেখা আজও কতটা প্রাসঙ্গিক। এখনও উহান থেকে শিক্ষার্থীরা ফেরার পর তাদের নিয়ে রাখা হয়েছিল হজ ক্যাম্পে। সমালোচনা হয়েছিল তাদের গাদাগাদি করে থাকা আর খাওয়ার কষ্ট নিয়ে। শতবর্ষ আগের বার্মা বা মিয়ানমার ছিল ইংরেজ কলোনি। সেখানে প্লেগ দেখা দেয়ায় নেয়া হয়েছিল নানা পদক্ষেপ। কিন্তু এই যন্ত্রণার বেশিরভাগটাই সইতে হতো গরিবদের। শরৎচন্দ্রের ভাষায় কেয়ারেন্টিনের যন্ত্রণা পোহাতে হতো মূলত ‘ছোটলোকদের’। যদিও কিছুটা খোল নলছে বদলেছে। এখন শুধু কোয়ারেন্টিনে কাজ হচ্ছে না বলে চালু হয়েছে লকডাউন। তাতেও ধনী, গরিবের মধ্যে ফারাক রয়েছে। যদিও করোনা রাজা থেকে প্রজা কাউকেই ভয় করছে না, ক্ষমার তো প্রশ্নই আসে না। না হলে দুনিয়ার তাবৎ পরাক্রমশালীরাও এ রোগে কাবু হতেন না।
আমাদের কলকাতা প্রতিনিধি পরিতোষ পাল জানালেন মজার তথ্য। সেখানে বড়লোকদের ছেলেমেয়েরা আছেন ‘পেইড কোয়ারেন্টিনে’। শুনে অবাক লাগল। জানতে চাইলাম, দাদা এটা আবার কি? বড়লোকদের ছেলেমেয়েরা এই লকডাউন পিরিয়ডে কোয়ারেন্টিনের জন্য বেছে নিয়েছে তারকা হোটেলগুলো। সেখানে তারা প্লে জোনে খেলছে, সময় করে ভালমন্দ খাচ্ছে আর দিব্যি মউজ মাস্তি করছে। সব যন্ত্রণা দেখা যাচ্ছে গরিবদের বেলায়। দুনিয়ার সব দেশেই দিনমজুর শ্রমিকরা আছে বড় কষ্টে। তাদের খাদ্যে টান পড়েছে। পকেট শূন্য হয়ে যাচ্ছে।
ফিরি সাহিত্যের পাতায়। কোয়ারেন্টিন নিয়ে শরৎচন্দ্র একা নন। বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, নবারুণ ভট্টাচার্যসহ অনেকের লেখায় মহামারি এসেছে নানাভাবে। তা ওলাউটা, বসন্ত, ক্ষয় রোগ, প্লেগ, স্প্যানিশ ফ্লু কিংবা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর।