× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মন্তব্য কলাম / জনপ্রতিনিধিদের নৈতিকতার পদস্খলন ভাবিয়ে তুলছে

মত-মতান্তর

প্রতীক ওমর
১৭ এপ্রিল ২০২০, শুক্রবার

বাংলাদেশ সৃষ্টির শুরু থেকেই কমবেশি জনপ্রতিনিধিদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন ছিলো। সময় যত যাচ্ছে, দেশের বয়স যত বাড়ছে পাল্লা দিয়ে জনপ্রতিনিধিদের নীতিনৈতিকতা নিয়ে নানা ধরণের কথা উঠছে। সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে আমলাদের তালিকাও। যে যার অবস্থান থেকে পথভ্রষ্ট হচ্ছেন। ক্ষমতা কিংবা দায়িত্বের অপব্যবহার করছেন। সাধারণ মানুষের কাছে আস্থার জায়গা একেবারে নষ্ট করে ফেলছেন। মানুষ এখন আর সহজে জনপ্রতিনিধিদের কথা বিশ্বাস করতে চায় না। এই পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে স্বয়ং তারাই দায়ী।

বঙ্গবন্ধু কন্যা টানা তিন বারের মত দেশ পরিচালনা করছেন। দেশের মানুষের জীবন জীবিকার মান, দেশের চিত্র কোথায় গিয়ে ঠেকেছে সেটা সবার জানা। নতুন করে বলার বা দেখানোর কিছু নেই। দেশের অর্থনীতি ব্যবসা বাণিজ্য কোন পর্যায়ে সেটাও ক্ষুদ্র এবং মাঝারি ব্যবসায়ীদের চেহারাই বলে দেয়। প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদারদের দিকে তাকালেও অনেক কিছু আঁচ করা যায়। এনিয়েও এখন কোন মন্তব্য নেই আমার। আমরা এখন প্রকৃতির সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছি। কঠিন পরিস্থিতি চারদিকে। কোথাও একটু প্রশান্তির দেখা নেই। ধোয়াশা, অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে পৃথিবী। দম বন্ধ হয়ে আসছে সবার। একটু শান্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছে না কেউ। হতাশা গ্রাস করছে। বিপদ পদে পদে। বের হওয়া মানা। এক সঙ্গে ওঠা বসাতেও বারণ। মুখোশে মুখ ঢেকেছে পুরো দুনিয়া। কিসের লজ্জায়? কি অপরাধ ছিলো মানুষের? কিসের শাস্তির সন্মুখীন হয়ে দাঁড়িয়েছি আমরা? এসব প্রশ্নের উত্তর দেবেন কে? কাকেই বা করতে পারি এসব প্রশ্ন?
সারা বিশ্বকে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে ফেলেছে অদৃশ্য শত্রু করোনা ভাইরাস। ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত ২২০ দেশে আঘাত হেনেছে ভাইরাসটি। আক্রান্ত হয়েছে বিশ্বে অন্তত ২১ লাখ ৯০ হাজার ৩০৩ জন মানুষ। মৃত্যু হয়েছে ১লাখ ৪৭ হাজারের বেশী। এমন পরিস্থিতিতে পুরো দুনিয়া প্রায় লকডাউন হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক মন্দা ইতিমধ্যেই চরম আকার ধারণ করেছে। বৈদেশিক ব্যবসায়িক লেনদেন একেবারেই বন্ধ। বন্ধ হয়েছে কল কারখানা। লাখ লাখ মানুষ চাকরিচ্যুত হয়ে পড়েছে। বেকার হয়ে ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে অসংখ্য দিনমজুর। কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষ খাদ্য সংকটে পড়েছে। অনেকের ঘরে খাবার নেই। ত্রাণের প্যাকেট লাইনে দাঁড়িয়ে নেয়ার মানুষিক প্রস্তুতি নেই অনেকের। অথবা ফটোসেশন, ফেসবুক এসবের ভয় আছে বহু মানুষের মধ্যে। কিন্তু খাবার কে দেবে? কোথা থেকে আসবে এখন তাদের খাবার। বাইরে বের হলে জীবনের ঝুঁকি, কাজের ক্ষেত্রগুলো একেবারেই বন্ধ। ঘরের শিশুদের চেহারার দিকে তাকিয়ে গৃহকর্তারা আড়ালে চোখ ভিজাচ্ছেন। পথের মানুষ, ছিন্নমূল মানুষ এদের চিন্তার মাত্রা আরো বেশী। অনেকে বিবেকের তারণায় একবেলা দুই বেলা অথবা এক সপ্তাহের খাবার তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন কিন্তু তার পরে কি হবে এদের ভাগ্যে। তাদের নিয়ে চিন্তা করার মানুষ কত জন আছেন? আমাদের সমাজ কি সেই পরিমাণ মানবিক লোকের জন্ম দিয়েছে? না । দেয়নি। এতেই সমস্যা সমাধানের পথ রুদ্ধ হয়ে আছে।
ভিক্ষুক, দিন মজুর এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে গেল কয়েক দিন খোঁজ নেয়ার সুযোগ হয়েছে। সুযোগ হয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরও। চলমান এই পরিস্তিতি কেটে উঠতে আরো কত দিন লাগবে সেই উত্তর এখনো কারো জানা নেই। এমন পরিস্থিতে এই শ্রেণীর মানুষের অবস্থা ঠিক কোন জায়গাতে গিয়ে থামবে সেই চিন্তা এখন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। তারা যতটা না করোনা ভাইরাসে চিন্তিত তার কয়েকগুণ বেশি চিন্তিত পেটের ক্ষুধা নিয়ে। খাবারের দাবিতে ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় দিন মজুর, গরীব অসহায় মানুষদের বিক্ষোভ, মানববন্ধন করতে দেখা দেছে। এরা কিন্তু এতেবারেই নিরুপায় হয়েই এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে রাস্তায় নামছে।

এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সরকার বিভিন্ন ধরণের পরিকল্পনার কথা ইতিমধ্যেই জাতির সামনে উপস্থান করেছে। চলমান পরিস্থিতি পরবর্তী অর্থনীতি কোন পথে যাবে, কোন কোন ক্ষেত্রে কতটাকা প্রণোদনা দেয়া হবে, কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা। ইত্যাদি আশার বাণী শোনানো হয়েছে। এসবের প্রায় বেশির ভাগই দুর্যোগ পরবর্তী পরিকল্পনা। আর বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার কাজ করছে। সেই কাজের ধরণ হচ্ছে অভাবিদের মাঝে খাদ্য সামগ্রী ত্রাণ হিসেবে বিতরণ, মধ্যবিত্তদের জন্য ১০ টাকা কেজি দরে চালের ব্যবস্থা। টিসিবির পন্য বিতরণ কর্মসূচি।

কিন্তু এসব উদ্যোগ হাতে নেয়ার মাত্র কয়েক দিন যেতে না যেতেই চারিদিকে জনপ্রতিনিধি, দায়িত্বপ্রাপ্তদের গোপন চরিত্র প্রকাশ হতে লাগলো। তাদের ভয়াল থাবা দেখতে পেলো জাতি। দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা যখন চল্লিশের নিচে ছিলো তখন করোনা মোকাবেলায় সরকারের বরাদ্দকৃত চাল চোরের সংখ্যা রোগীর চেয়ে কয়েকগুন বেশী হলো। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা, সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা টেলিভিশনের স্ক্রলে এসব চোরের খবর মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। আর এসব চোরের বেশীর ভাগই সরকার দলের তৃনমূল নেতা। কেউ চেয়ারম্যান, কেউ মেম্বার কেউ সভাপতি কেউ আবার সাধারণ সম্পাদক। পুলিশের হাতেই অধিকাংশ হাতে নাতে ধরা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতু মন্ত্রী এসব চোরের উৎপাত দেখে গণ্যমাধ্যমে বক্তব্য দিলেন, চাল চুরিতে ধরা পড়লে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। এমন টাইপের বক্তব্যের পর কোন চোর চুরি করা থেকে বিরত হলো না। দিন যত গড়াতে লাগলো গরীবের চাল, চোরের কব্জায় যেতে লাগলো। গোটা দেশ জুড়ে এক যোগে মেতে উঠলো দলীয় নেতারা চুরির উৎসবে। পুলিশের গ্রেপ্তার, দুই এক জায়গায় রিমান্ড কোন কিছুই থামাতে পারলো না চাল চোরদের। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী নিজেই থেমে গেলেন। ১০ টাকায় মধ্যবিত্ত এবং গরীবের সরকারি চাল বিতরণ বন্ধ ঘোষণা করলেন। চোরদের কাছে অনেকটা অসহায় আত্মসমার্পন করেই তিনি নিজের থেকে পিছু হটলেন। যদিও এই বন্ধ ঘোষণার তিন দিন পরে আবার ১০ টাকার চাল পথ পরিবর্তন করে জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে বিতরণের উদ্যোগ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কবে শুরু হবে তা এখনো জানা যায়নি।
কিন্তু চোরদের কারণে অসহায় হয়ে পড়া মানুষগুলোর যে ক্ষতি হলো, হচ্ছে সেই কথা কেউ বলছে না। যারা চুরির কারণে ধরা পড়েছেন তাদের জেল হচ্ছে। কয়েক দিন পর আইনের ফাঁকফোঁকর দিয়ে বের হয়ে যাবেন সেটাই স্বাভাবিক। এরচেয়ে বেশি কিছু হতে দেখা যায় না সচরাচর। এরা আবার বেরিয়ে এসে নিজেদের মত করেই চুরিতে হাত দেবেন। মানুষ এমন বিচার আর দেখতে চায় না। শক্ত বিচার হলে চোরের সংখ্যা নিশ্চিৎ কমে যেতো।
চোর কান্ডের মধ্যেই আরেক চেয়ারম্যানের একটি অমানবিক কাণ্ড জাতিকে আরো হতাশ করে তুলেছে। ১২ এপ্রিল নাটোরের লালপুর উপজেলার ৬০ বছর বয়সী কৃষক শহিদুল ইসলাম দরিদ্র প্রতিবেশিদের জন্য ত্রাণ সহায়তা চাইতে সরকারি হটলাইন ৩৩৩ নম্বরে কল করেন। সেই অপরাধে বরমহাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুস সাত্তার তাকে পরিষদে ডেকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে। সেই বৃদ্ধার রক্তমাখা ছবি হৃদয়কে কাঁপিয়ে তুলেছে।

দেশের চলমান এই আপতকালে জনপ্রতিনিধিদের এমন নৈতিকার পদস্খলন নিয়ে বগুড়ার একজন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মান্নান আকন্দ। তিনি বগুড়া আওয়ামী লীগের একজন বড়মাপের ডোনারও। তিনি গত ১৩ এপ্রিল বগুড়ার স্থানীয় একটি অনলাইন টেলিভিশন পুন্ড্র টিভিতে একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে চার দিকে আওয়ামী লীগের নেতা, চেয়ারম্যান মেম্বারদের চাল চুরির প্রসঙ্গে তার কাছে মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে তিনি দলের সেন্ট্রাল নেতাদের কড়া সমালোচনা করে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন জেলা কমিটি করার জন্য কেন্দ্র নেতাদের তৃণমূলে পাঠান তখন তারা শহরের ফাইভ স্টার হোটেল উঠে পিকনিক খেয়ে যান। কার হাতে নেতৃত্ব তুলে দিলেন সেই বিবেচনা তারা কখনোই করেন না। একটি জেলা সম্মেলন করতে ৪০-৪৫ লাখ টাকা খরচ হয়। সেই টাকাগুলো এই নেতারা কোথা থেকে দেয় সেই খোঁজ রাখেন কখনো ওই নেতারা? তিনি বলেন, আজকের চাল চোররাই ওই টাকার জোগান দিয়ে থাকে নেতাদের। তিনি আরো বলেন, আজকের এই চোরতো দলের তৈরি। আপনার চোর তৈরি করে এখন আবার ধরছেন কেন? তিনি এও বলেছেন, আমি জানি এই চোরদের নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিয়ই খুব বিব্রত হয়ে পড়েছেন। খুব কষ্ট পাচ্ছেন। তার এই মন্তব্যের ভিডিওটি এক রাতে কোটি মানুষের নজর কেড়েছে। অনলাইন দুনিয়ায় তার এই বক্তব্য রীতিমত ভাইরাল হয়েছে। এমন দৃঢ় সত্য কথা মানুষ এতো বেশী গ্রহণ করেছেন। লাখো শেয়ার আর কোটি দর্শক তাদের মনের কথা মনে করেই এই বক্তব্যকে গ্রহণ করেছেন। পরের দিন এই নেতার কাছে জানতে চেয়েছিলাম আপনার এই কথাগুলো মানুষ এতো বেশি পছন্দ করলো কেন? তিনি সোজা সাপটা উত্তর দিলেন, যারা দল করে সংসার চালায় তারা নিজের দলের ত্রুটি কখনোই ধরতে আসবে না। আমি দলকে ভালোবাসি তাই দলের ভুলগুলো সব সময়ই ধরে দেয়ার চেষ্টা করবো। তাতে কেউ মানুক আর না মানুক আমি বলেই যাবো। আমার কথাগুলো দলের বেশীর ভাগ নেতা কর্মীরাই পছন্দ করবে। কারণ এই কথাগুলো সবার মনের কথা। তারা কেউ বলতে পারেনি আমি বলেছি।

বঙ্গবন্ধু যখন বাংলাদেশ নামক ভূ-খন্ডের সূচনা করেছিলেন, তখনও তিনি তার আশেপাশের মানুষদের নৈতিক পদস্খলনে বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন। মনে খুব কষ্ট পেয়েছেন। সেই যুগ থেকে এই যুগ। এখনো এমন মানুষ পিছু ছাড়েনি। বরং এখন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েক শ’ গুণ। এখন যদিও প্রধানমন্ত্রী নিয়মিত জেলা প্রশসকদের সাথে কনফারেন্স করছেন, তাদের দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন। জনপ্রতিনিধিদের ব্যপারে শক্ত অবস্থানে যাওয়ার কথাও বলেছেন। যারা গরীবের হকে হাত দেবে তাদের কোন রাজনৈতিক পরিচয় না দেখে বিচারের মুখোমুখি করতে কড়া নিদের্শনাও দিয়েছেন। তার পরেও কিন্তু জনপ্রতিনিধিরা সতর্ক হচ্ছেন না। এখনো বেডের নিচে তেলের খনি আবিষ্কার হচ্ছে। খুবই দু:খজনক। গরীবের খাদ্য, অসহায়ের ত্রাণ, বিপদের পাথেও, দুর্যোগের অনুদান যাই বালি না কেন, এসব কিভাবে চুরি করতে পারেই এই মানুষ নামের প্রাণীগুলো? আমার বোধে আসেনা। বোধে আসে না দেশে এতো চোর সৃষ্টি হলো কি ভাবে? কিসের অভাবে আমাদের জনপ্রতিনিধিদের নীতিনৈতিকতার এতো পদস্খলন হলো?

(লেখক, কবি ও সাংবাদিক)
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর