চট্টগ্রামে করোনা চিকিৎসায় বিশেষায়িত হাসপাতাল এখন চারটি। যেখানে কোন শয্যা খালি নেই। ফলে করোনা চিকিৎসায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ছুটছে আক্রান্ত রোগীরা। চট্টগ্রাম থেকে সহস্রাধিক করোনা আক্রান্ত রোগী বর্তমানে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এরমধ্যে দেশের প্রখ্যাত শিল্পগ্রুপ এস আলম পরিবারের করোনা আক্রান্ত ৯ সদস্য ঢাকার ধানমন্ডি আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এর আগে শয্যা না পেয়ে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ছোট ভাইয়ের চিকিৎসাধীন আইসিইউ শয্যায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এ পরিবারের অন্যতম সদস্য ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের পরিচালক মোরশেদুল আলম।
অভিযোগ উঠে, সময়মতো আইসিইউ শয্যা পেলে হয়তো বেঁচে যেতেন মোরশেদুল আলম। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পরিবারের করোনা আক্রান্ত সব সদস্য চিকিৎসার জন্য চলে যান ঢাকায়।
সেখানে আইসিইউর জন্য তারা দুই কোটি টাকা অনুদানও দেন পরিবারের পক্ষ থেকে। কিন্তু চরম অসন্তুষ্ট হওয়ায় চট্টগ্রামের কোন হাসপাতালে শয্যা কিংবা করোনা চিকিৎসার জন্য কোন অনুদান দেননি এখনো পর্যন্ত।
আইসিইউ শয্যা না পেয়ে মৃত্যুর ঘটনা শুধু এটি নয়, শয্যা না পেয়ে ঢাকায় আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর পূর্ব মাদারবাড়ি ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাজহারুল ইসলাম চৌধুরীও। গত মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এর আগে করোনা উপসর্গ দেখা দিলে শয্যার অভাবে তাকে হোম আইসোলেশনে রাখা হয়। রিপোর্ট পাওয়ার দিনে তিনি সংকটাপন্ন অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালসহ নগরীর কয়েকটি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রাণপণ লড়াই করেন। শেষ পর্যন্ত ক্ষোভ নিয়ে স্বজনরা তাকে ঢাকায় নিয়ে যান।
শুধু তাই নয়, কিডনী ডায়ালাইসিস করার মতো আইসিইউ শয্যা না পেয়ে মাকে নিয়ে খোদ চট্টগ্রাম ছেড়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির। তিনি এবং তাঁর মা দু‘জনেই করোনা শনাক্ত হন শুক্রবার রাতে। এ সময় হোম আইসোলেশনে ছিলেন দু‘জনেই। এ অবস্থায় নিজের ফেসবুক পেইজে মায়ের কিডনি ডায়ালাইসিস করানোর মতো শয্যা না পাওয়ার কথা জানিয়ে শনিবার ঢাকার পথে রওনা দেন তারা।
এভাবে শয্যা না পেয়ে গত ১৫-২০ দিন ধরে চট্টগ্রাম থেকে শত শত করোনা আক্রান্ত রোগী ঢাকায় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। করোনা আক্রান্তের সংখ্যা চট্টগ্রামে যতই বাড়ছে। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ছুটে যাওয়া করোনা রোগীর সংখ্যা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা স্বীকার করেছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি।
সিভিল সার্জনের তথ্যমতে, চট্টগ্রামে রোববার রাতের ফলাফলে আরও ১১৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এ নিয়ে ২৯৮৫ জনে দাঁড়িয়েছে করোনা রোগীর সংখ্যা। অথচ এর বিপরীতে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত বিআইটিআইডি হাসপাতাল ও বেসরকারি ফিল্ড হাসপাতাল মিলে করোনা রোগীর চিকিৎসায় শয্যা রয়েছে ৪২০টি। যা এখন পরিপুর্ণ।
ফলে আক্রান্ত কোন রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত শয্যা খালী হচ্ছে না। এতে নতুন আক্রান্ত কোন রোগীও হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। যার ফলে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর বাইরে করোনা আক্রান্ত সকল রোগীকে হোম আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এরমধ্যে সংকটাপন্ন রোগীদের কেউ কেউ ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছে। তবে এরমধ্যে অনেকে মারা গেছেন বলেও জানা গেছে।
ভুক্তভোগীদের তথ্যমতে, রোববার দিবাগত রাতে করোনা আক্রান্ত হয়ে অনেক অনুনয় করে চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন হাসপাতালে ভর্তি হন কন্টেইনার ডিপো এছহাক ব্রাদার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাজী মোহাম্মদ ইউনুছ। তাকে বাঁচাতে স্বজনরা নগরীর সবকটি হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে একটি আইসিইউ শয্যা ভিক্ষা চেয়েও পাননি। ফলে আইসিইউ সাপোর্ট না পেয়ে রাত সাড়ে ৯টায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।
এর আগে রোববার ভোরে করোনা উপসর্গ নিয়ে একই হাসপাতালে মারা যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক নাম সাবরিনা ইসলাম সুইটি। তার নিকটাত্নিয়ের অভিযোগ, জ্বর ও শ্বাসকষ্ট থাকায় তাকে ভর্তি করায়নি কয়েকটি হাসপাতাল। পায়ে ধরে মেট্টোপলিটন হাসপাতালে ভর্তি করালেও তাকে আইসিইউ শয্যা দেওয়া হয়নি। এসময় তার আইসিইউর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আইসিইউ শয্যা কোথাও খালি ছিল না। পরে শ্বাসকষ্ট নিয়ে মারা যান তিনি।
শয্যা না পেয়ে এভাবে চট্টগ্রামে প্রতিদিনই কোন না কোন করোনা রোগী প্রাণ হারাচ্ছে।
এ নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজনও। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে করোনা চিকিৎসায় অব্যবস্থাপনা লেগেই আছে। চিকিৎসা না পেয়ে মানুষের মধ্যে হাহাকার চলছে। হাসপাতালগুলোতে শুধু নেই আর নেই। বেসরকারি হাসপাতালগুলো শুধু প্রস্তুতির গল্প শুনাচ্ছে, দুয়ার খুলছে না। বিনা চিকিৎসায় প্রতিদিন মানুষ মরছে।
এ নিয়ে ক্ষেপেছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলও। তিনি করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবায় অনিয়ম অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। করোনা রোগীদের চিকিৎসায় নগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলো অধিগ্রহণে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি।