গতকাল দুপুরে জাফরুল্লাহ ভাই এর সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। পরম করুণাময়ের দয়ায় তিনি ভালো আছেন। গণস্বাস্হ্য হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। তাঁর মনোবল বেশ শক্ত। স্ত্রী ও পুত্র করোনা আক্রান্ত হয়ে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। উনাকে বললাম, আমরা সবাই আপনার রোগমুক্তির জন্য দোয়া করছি। এদেশের গণমানুষের দোয়ায় আপনি সেরে উঠবেন ইনশাআল্লাহ। বললাম, আপনাকে বাঁচতে হবে এদেশের জন্যে, এদেশের গণমানুষের জন্য, অসচ্ছল জনগোষ্ঠীর জন্য।
উনি ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, ‘আমি একা বেঁচে থেকে লাভ কি? বিনা চিকিৎসায় রোজ মানুষ মারা যাচ্ছে, হাসপাতালে মানুষ সেবা পাচ্ছেনা। কেন চট্টগ্রাম থেকে করোনা রোগীদের দলে দলে ঢাকা আসতে হচ্ছে? একটু অক্সিজেন দেবার ব্যবস্থা করা গেলে বহু রোগী বাঁচানো যেত। চট্টগ্রামে হাসপাতালে এ ব্যবস্থাটুকু কর্তৃপক্ষ করতে পারল না?’ যোগ করলেন তিনি।
জাফরুল্লাহ ভাই এর সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৯১ সালে। বিগত কয়েক বছর ‘হেলদি বাংলাদেশ’ প্লাটফর্মের বিভিন্ন কর্মসূচিতে একসাথে কাজ করতে গিয়ে ঘনিষ্ঠতা আরো বেড়েছে। একত্রে একাধিক টিভি টকশোতেও অংশ নিয়েছি। তাঁর সাথে প্রথম পরিচয়ের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। ১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিল ঘুর্ণিঝড়ে আমার নিজ দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়া ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তিনি ত্রাণ নিয়ে লোকজনসহ ছুটে যান। আমার মরহুম পিতার (যিনি কুতুবদিয়া মডেল হাইস্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক) সাথে তাঁর দেখা হয়। আমার আব্বা গণস্বাস্হ্য কেন্দ্রের ত্রাণ কর্মীদের থাকা ও ত্রাণ বিতরণে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ওই সময় থেকেই আমার আব্বার প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধাবোধ। আমিও তাঁর সাথে বেশ পরিচিত হয়ে উঠলাম। দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দেয়া অকুতোভয় ও স্পষ্টভাষী এ লড়াকু ব্যক্তিত্ব, কথা বলেন সোজা সাপ্টা। মোনাফেকি তাঁর মধ্যে নেই। একদিন করোনা নিয়ে এক টিভি টকশোতে দেখা হলে কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই বলে উঠলেন, ভালো আর থাকি কিভাবে? সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালিসিস করি, দু’দিন কোর্ট কাচারী করতে হয়। কাজ করার সময়ই পাচ্ছিনা। দেশে করোনা মহামারি দেখা দিলে গত মার্চ মাসেই আকিজ গ্রুপের সহযোগিতায় বিনামুল্যে করোনা রোগীর চিকিৎসার জন্য ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় একটা হাসপাতাল করতে চেয়েছিলেন। নানা কারণে একাজে সফল হননি। আর তাঁর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত করোনা শনাক্তকরণ কিট এর অনুমোদন এখনো ঝুলে আছে। এনিয়ে তিনি বহু ঘুরাঘুরি করেছেন।
২০০৮ সালে আমি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব নেবার পর জাফরুল্লাহ ভাইকে একদিন সচিবালয়ে আমার দপ্তরে চায়ের দাওয়াত দিলাম এবং বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের জন্যে আশু করণীয় সম্পর্কে তাঁর মতামত চাইলাম। অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিলেন তিনি। কয়েকটি আমার মনে রেখাপাত করল এবং জরুরি ভিত্তিতে ওগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলাম। তাঁর একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ ছিল, দেশে এনাস্থেশিয়লজিস্ট এর সংখ্যা দ্রুত বাড়ানো সম্পর্কিত। ওই সময়ে দেশে ডিপ্লোমা, গ্রাজুয়েট, পোস্ট গ্রাজুয়েট মিলিয়ে এনাস্থেশিয়লজিস্ট এর সংখ্যা ছিলো প্রায় এক হাজার। এর মধ্যে ৭০০-৭৫০ জন ঢাকা ও চট্টগ্রামে এবং বাকিরা সারা দেশে। প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতিতে এ সংখ্যা দ্রুত বাড়ানো সম্ভব ছিল না। জাফরুল্লাহ ভাই পরামর্শ দিলেন তিন মাসের স্বল্প মেয়াদি কোর্সের মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে প্রশিক্ষিত এনাস্থেশিয়লজিস্ট তৈরীর। বিভিন্ন মহল থেকে বিরোধিতার সম্মুখীন হলাম। সব বিরোধিতা ও প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে সবদিক বিবেচনা করে ছয় মাসের স্বল্প মেয়াদি কোর্সের ব্যবস্থা নিলাম। ১৬২ জন পুরুষ ও ১৬২ জন মহিলা নতুন ডাক্তার নিয়ে সারা দেশে ২২ টি ট্রেনিং সেন্টারের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিলাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কেন্দ্রে ট্রেনিং কোর্স আমি নিজে উদ্বোধন করলাম। ছয় মাসের মধ্যে এনাস্থেশিয়লজিস্ট এর সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়ে ১৩০০ জনের বেশি হয়ে গেল। আমার বদলির পর দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওই একটা কোর্সের পরই স্বল্প মেয়াদি কোর্স কর্মসূচিটি বন্ধ করে দেয়া হয়। আজ করোনা মহামারির এ দূর্যোগে আমরা আইসিইউ এর অভাবে রোগীর চিকিৎসা দিতে পারছিনা। আইসিইউ চালাতে এনাস্থেশিয়লজিস্ট লাগে এবং আমাদের পর্যাপ্ত এনাস্থেশিয়লজিস্ট নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব জেলার সদর হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা সৃষ্টির আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু এতো এনাস্থেশিয়লজিস্ট পাওয়া যাবে কি? রাতারাতি এনাস্থেশিয়লজিস্ট তৈরিও করা যায় না। জাফরুল্লাহ ভাই এর পরামর্শে যে স্বল্প মেয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্স শুরু করেছিলাম তা চালু থাকলে বা অন্তত আর কয়েকটা ব্যাচকে প্রশিক্ষণ দেয়া হলে আজ আমরা এ দুর্দশার সম্মুখীন হতাম না। করোনা যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হবে। আমাদের অনেক আইসিইউ এর প্রয়োজন হবে। ওই ধরনের স্বল্প মেয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত এনাস্থেশিয়লজিস্ট তৈরীর কর্মসূচিটি জরুরি ভিত্তিতে পুনরায় চালু করা প্রয়োজন মনে করছি।
লেখক: সাবেক সচিব