খুলনায় গণেশ চন্দ্র বণিক (৫৩) নামের আরো এক করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়েছে। শনিবার সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে খুলনার করোনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এ নিয়ে খুলনায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। জেলায় এখন করোনা রোগীর সংখ্যা ৮০৫। করোনা হাসপাতালের মুখপাত্র ডাক্তার ফরিদ উদ্দিন জানান, শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে গণেশ চন্দ্রকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই সকালে তার মৃত্যু হয়। গণেশ চন্দ্র মহানগরীর বড় মির্জাপুর (ইউসুফ রোড) এলাকার বাসিন্দা মৃত চিত্ত রঞ্জন দত্তের ছেলে। এদিকে খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের ফ্লু কর্নারে গত প্রায় তিন মাসে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৫৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
সর্বশেষ ১৯শে জুন শুক্রবার মারা গেছেন সাতজন। এটাই এই কর্নারে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু। মৃতদের মধ্যে মৃত্যুপরবর্তী নমুনা পরীক্ষায় কয়েকজনের করোনা পজেটিভ, কয়েকজনের নেগেটিভ এবং অনেকের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট মেলেনি এখনো। এই কর্নারে চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি এবং চিকিৎসকদের অবহেলার অভিযোগ রয়েছে রোগীর স্বজনদের। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, সর্বোচ্চ চিকিৎসার চেষ্টা করা হচ্ছে। গত ১২ই জুন মারা যাওয়া ব্যবসায়ী শারাফাত হোসেন বাবলুর স্ত্রী জেসমিন সুলতানা অভিযোগ করেন, মুমূর্ষু স্বামীকে হাসপাতালের বেডে রেখে তাকে অক্সিজেন সিলিন্ডারের মিটার এবং ওষুধ কিনে আনতে হয়েছে। ভেতরে একজন ওয়ার্ডবয় বসে থাকেন মাত্র। চিকিৎসক-নার্সকে ডেকেও সময় মতো পাওয়া যায়নি।
মৃত স্কুলছাত্রী মীমের স্বজন আবির হাসান অনিক বলেন, ‘ফ্লু কর্নারে অক্সিজেনের স্বল্পতা রয়েছে। আমি চাইলেও সময় মতো পাইনি। ওয়ার্ডবয় স্যালাইন লাগাতেও পারেন না। কিন্তু চিকিৎসক-নার্স ঠিকমতো রোগীর কাছেও আসেন না।’ খুমেকের ফ্লু কর্নারের ফোকাল পার্সন ও হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মিজানুর রহমান জানান, গত ২৪শে মার্চ ফ্লু কর্নার চালু হয়। শনিবার (২০শে জুন) পর্যন্ত এখানে চিকিৎসা নিয়ে ৩২৯ জন সুস্থ হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে ৫২ জনের। এখনো ভর্তি আছেন ২৯ জন। চিকিৎসাজনিত অবহেলার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘রোগীদের চাহিদা অনেক। কিন্তু আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। চাহিদা শতভাগ পূরণ করা সম্ভব হয় না।’ খুমেক হাসপাতালের পরিচালক ডা. মুন্সি মো. রেজা সেকেন্দার বলেন, ‘রোগীরা অভ্যাস থেকে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ করে থাকেন। এটা আমরা মেনে নিতে রাজি না। ফ্লু কর্নারে রোগীদের সর্বোচ্চ চিকিৎসার চেষ্টা করা হচ্ছে।’ এক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি করা হয় না বলেও জানান তিনি।
অপরদিকে শুক্রবার একদিনেই সাতজনের মৃত্যু হয়েছে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা সাসপেক্টেড আইসোলেশন ওয়ার্ডে। করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে তাদের মৃত্যু হয়। খুমেক হাসপাতালে গত ২৩শে মার্চ ওই ওয়ার্ডটি চালুর পর এটিই ছিল একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা। ওই ওয়ার্ড চালুর আগে খুমেক হাসপাতালে করোনা উপসর্গ নিয়ে দু’জন এবং ওয়ার্ড চালুর পর শুক্রবার পর্যন্ত খুলনায় সর্বমোট ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে তিন জনের কোনো নমুনা পরীক্ষা হয়নি এবং তিনজনের নমুনা পরীক্ষা করা হয় ঢাকাস্থ আইইডিসিআর (রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান) থেকে। তাদের ফলাফল আসে নেগেটিভ। বাকি ৪০ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয় খুলনা মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাব থেকে। এর মধ্যে ৩৪ জনেরই ফলাফল নেগেটিভ এবং বাকি ছয়জনের ফলাফল আসে পজেটিভ। সর্বশেষ শুক্রবার যে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে তাদেরও নমুনা সংগ্রহ করে খুলনা মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। এদিকে, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা সাসপেক্টেড আইসোলেশন ওয়ার্ডে শুক্রবার যেমন করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর রেকর্ড ছিল তেমনি খুলনা মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাবেও শুক্রবার শনাক্তের সংখ্যা ছিল আগের যেকোন দিনের চেয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক। অর্থাৎ শুক্রবার ৩৭৭টি নমুনা পরীক্ষার পর সর্বমোট ১৪০ জনের ফলাফল পজিটিভ হয়। যার মধ্যে শুধুমাত্র খুলনারই ১৩৩ জন। বাকি সাতজনের মধ্যে একজন যশোরের, দু’জন নড়াইলের, তিনজন বাগেরহাটের এবং একজন পিরোজপুরের। এ তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন খুমেক হাসপাতালের করোনা প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা কমিটির সার্বিক সমন্বয়কারী এবং খুলনা মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা. মো. মেহেদী নেওয়াজ।
খুমেক হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) এবং করোনা সাসপেক্টেড আইসোলেশন ওয়ার্ড ও ফ্লু কর্ণারের মুখপাত্র ডা. মিজানুর রহমান বলেন, শুক্রবার একইদিনে করোনার উপসর্গ নিয়ে যে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে তারা হলেন, নগরীর খলিশপুর কাশিপুরের জরিনা বেগম (৬০), রূপসার খাঁজাডাঙ্গা এলাকার মোহাম্মদ আলী (৬০), নড়াইলের কালিয়ার কার্ত্তিক (৪০), যশোরের অভয়নগরের রুমা বেগম (৩৫), নগরীর ৫ নম্বর ঘাটের জামসেদ আলম (৬০), সোনাডাঙ্গার নাসিম আহমেদ (৬০) এবং টুটপাড়ার ফিরোজ আহমেদ (৬৯)। আরএমও বলেন, জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে খালিশপুরের কাশিপুরের জরিনা বেগম বৃহস্পতিবার বিকাল সোয়া পাঁচটায় খুমেক হাসপাতালের করোনা সাসপেক্টেড আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় তিনি মারা যান। তিনি কাশিপুরের মৃত আব্দুল গণি সরদারের স্ত্রী।
মোহাম্মদ আলী (৬০) নামে অপর একজন বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত পৌণে দুইটায় জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ওই ওয়ার্ডে ভর্তি হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার বেলা পৌণে ১১টায় তার মৃত্যু হয়। মৃত মোহাম্মদ আলী রূপসা উপজেলার টিএস বাহিরদিয়া ইউনিয়নের খাঁজাডাঙ্গা গ্রামের মৃত আরশাদ আলীর ছেলে। নড়াইল জেলার কালিয়া থানার পুরুলিয়া গ্রামের মৃত নিতাই’র ছেলে কার্ত্তিক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ভর্তি হন। তিনি শুক্রবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় মারা যান। খুলনা মহানগরীর সদর থানার ৫নং ঘাট এলাকার মো. আহমেদের ছেলে জামশেদ আলম শুক্রবার দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে ভর্তি হন। তিনি মৃত্যুবরণ করেন সন্ধ্যা ৬টা ১৫ মিনিটে। যশোরের অভয়নগরের বাবুল ফরাজির স্ত্রী রুমা বেগম বৃহস্পতিবার ভর্তি হন করোনা উপসর্গ নিয়ে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শুক্রবার দুপুরে মারা যান। খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা মফিজ উদ্দিন আহমেদের ছেলে নাসিম আহমেদ নিউমোনিয়া ও স্ট্রোকজনিত সমস্যা নিয়ে শুক্রবার দুপুরে মেডিসিন ৭-৮ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি হন। সেখান থেকে তাকে করোনা সন্দেহ করোনা ওয়ার্ডে রেফার্ড করা হয়। পরবর্তীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ৩টার দিকে মৃত্যুবরণ করেন। নগরীর টুটপাড়া এলাকার তৃত. মৌলভী আহমেদ হোসেনের ছেলে ফিরোজ আহমেদ শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টায় ভর্তি হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি রাত সাড়ে ৮টায় মৃত্যুবরণ করেন। খুমেক হাসপাতালের আরএমও বলেন, শুক্রবার যে ৭ জন করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন তাদের সকলেরই নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।
এর আগে গত ১৯শে মার্চ খুমেক হাসপাতালে মোংলার বাবুল চৌধুরী নামে একজন করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তিনিই খুলনার প্রথম করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তি। তবে তার নমুনা পরীক্ষা করা হয়নি। ১৯শে মার্চ নড়াইলের শেখ রবিউল ইসলাম নামের একজনের মৃত্যু হলে তারও নমুনা পরীক্ষা হয়নি। ২৬শে মার্চ মারা যান নগরীর হেলাতলার মোস্তাহিদুর রহমান রুবেল। ঢাকাস্থ আইইডিসিআর থেকে তার নমুনা পরীক্ষা করা হয়। ফলাফল আসে নেগেটিভ। নড়াইলের কালিয়ার পুরুলিয়া এলাকার সুলতান শেখের মৃত্যু হয় ২৯শে মার্চ। চিকিৎসকরা বলেন, তার নমুনা পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। কেন না করোনার উপসর্গের বাইরে তার অন্যরোগ ছিল। ২রা এপ্রিল মোংলার সিগনাল টাওয়ারের হুমায়ুন কবির নামে একজনের মৃত্যু হয়। তার নমুনা পরীক্ষা হয়েছিল কি না জানা যায়নি। রূপসার দেবীপুরের সালেহা বেগমের মৃত্যু হয় ৬ই এপ্রিল। তার নমুনাও পরীক্ষা করা হয় আইইডিসিআর থেকে। ফলাফল আসে নেগেটিভ। এরপর ৭ই এপ্রিল থেকে খুলনা মেডিকেল কলেজে পিসিআর ল্যাব চালু হলে করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবারণকারীদের নমুনা এখানেই পরীক্ষা হয়। এমন ব্যক্তিদের তালিকায় রয়েছেন ১০ই এপ্রিল খালিশপুর ক্রিসেন্ট গেটের মো. রাকাব (৬ মাস), ১৭ই এপ্রিল রূপসার কাজদিয়ার মিতু (১০) ও নগরীর লবণচরার মো. আসাদুজ্জামান (২৪), ১৯শে এপ্রিল পিরোজপুরের ইন্দুরকানির মাসুমা বেগম ও ডুমুরিয়ার ইকরামুল মোল্লা (নিজ বাড়িতে), ২১শে এপ্রিল ফুলতলার মিজানুর রহমান ও লবণচরার ফেরদৌসী আরা, ২৫শে এপ্রিল বাগেরহাটের কচুয়ার ফাতেমা (১৬ মাস), আড়ংঘাটার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি (৬০) ও কেসিসি’র গাড়িচালক কাজী শরিফুল ইসলাম মুক্তার (৪৫), ২৮শে এপ্রিল পিরোজপুরের লিমা খাতুন (২৪), ১লা মে বটিয়াঘাটার ফাতেমা (১), ২রা মে দিঘলিয়ার ইসউসুফ আলী খান (৬০), ৫ই মে মোংলার কবির আহমেদ (৭০), ১০ই মে টুটপাড়ার খাদিজা (৬৫), ১৩ই মে ডুমুরিয়ার রাজিয়া (৬৫), ১৮ই মে বটিয়াঘাটার কবিতা মন্ডল (৫৫), ৩০শে মে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের আশরাফুর রহমান (৫৫) ও পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার সোহাগ হোসেন (২৫), ২রা জুন যশোরের ঝিকরগাছার ফারুক হোসেন (৫২), শেখপাড়া বাগানবাড়ির নজরুল ইসলাম (৩৯) ও যশোরের মনিরামপুরের তহমিনা (৩৬), ৮ই জুন দৌলতপুরের মিম (১২) ও সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটার রিপন (২২), ৯ই জুন রায়ের মহলের দেলোয়ার হোসেন (৬৫), ১১ই জুন খালিশপুর বঙ্গবাসী মোড়ের জান মোহাম্মদ (৮০), ১২ জুন দৌলতপুর কবির বটতলার শারাফাত হোসেন (৫০), খালিশপুর ক্রিসেন্ট বাজারের রাবেয়া (৫৯) ও যশোরের বেনাপোল পোর্ট থানার শাহারান (৬০), ১৩ জুন নগরীর ২৪/২, দেবেন বাবু রোডের এক নারী, ১৪ জুন খালিশপুর হাউজিংয়ের অবসরপ্রাপ্ত এসআই আবুল হোসেন (৭০), ১৬ জুন ফুলবাড়িগেটের রওশন মোল্লা (৮৫) এবং ১৭ জুন খুলনা সদরের মনিকা বেগম (৬৫)। এদের সকলেরই নমুনা পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ আসে।
তবে মৃত্যুর পর যে ছয়জনের ফলাফল পজেটিভ হয় তারা হলেন, ২১ এপ্রিল রূপসার রাজাপুরের নূর আলম খান ওরফে নূরুজ্জামান, ২০ মে দিঘলিয়ার সেনহাটির নজরুল ইসলাম (৫৫), ৫ জুন খালিশপুর ক্রিসেন্ট কলোনীর মুন্না আক্তার (৪০), ১৩ জুন নগরীর বাগমারার মনোয়ারা বেগম (৪৫), ১৪ জুন শেখপাড়ার নূর ইসলাম ব্যাপারী (৭২) এবং ১৭ জুন রূপসার নৈহাটি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান খান বজলুর রহমান(৬০)।