করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবকে ঘিরে পঞ্চগড় জেলার হাসপাতালগুলোতে রোগীদের উপস্থিতি অনেক কমে গেছে। জেলা শহরে অবস্থিত পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের আওতাধীন জনগুরুত্বপূর্ণ মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রটি ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতাল করা হয়েছে। এ অবস্থায় সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের রোগীদের এখন স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মীরা। জেলার ৫টি উপজেলায় মোট ১১১টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এ ক্লিনিকগুলো বেশির ভাগই প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত। প্রতি ক্লিনিকে নিরাপত্তা সামগ্রী পিপিই মাস্ক, সেনিটাইজার, হ্যান্ড গ্লোভস দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। রোগীদের জন্য ওষুধ সরবরাহ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশ মতে সপ্তাহে ৬ দিন ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) নিয়মিত সেবা দিচ্ছেন রোগীদের।
এছাড়া একজন স্বাস্থ্য সহকারী ও মাঠ পর্যায়ে কাজের জন্য নিযুক্ত ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার অ্যাসিসটেন্ট সপ্তাহে তিনদিন করে ক্লিনিকগুলোতে সেবা দিচ্ছেন। ক্লিনিকের সামনেই পানি ও সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সদর উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী রতনীবাড়ী কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়। সেখানে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার, স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারী ক্লিনিকে আসা রোগীদের নানান সেবা দিচ্ছেন। ক্লিনিকের সেবা সম্পর্কে একাধিক রোগী জানান, কমিউনিটি ক্লিনিক না থাকলে স্বাস্থ্যসেবা পেতে তাদের অনেক দূরে যেতে হত, যাতে সময় ও অর্থ ব্যয়সহ দুর্ভোগ বাড়তো। অনেকেই নানা ধরনের সাধারণ অসুখের চিকিৎসা নিতে এসেছেন। ক্লিনিক চত্বরেই পাঞ্জিয়ারপাড়া গ্রামের জমিলা (৫৫) বলেন, শরীর ব্যথা জ্বর। ওষুধ নিতে আইসছি। ওষুধ দিচ্ছে। এখান থেকে ওষুধ খেয়ে উপকার পেয়েছি। রতনীবাড়ী গ্রামের ফেরদৌসী আক্তার (৩০) বলেন, পাতলাপায়খানার জন্য এসেছি। ওষুধ দিছে। সিপাইপাড়া গ্রামের সোয়েব রানা (২৫) বলেন, এই ক্লিনিক থেকে আশপাশের ২২ গ্রামের মানুষ চিকিৎসা ও বিনামূল্যে ওষুধ পাচ্ছে। অসহায় ও গরিব মানুষের জন্য এই ক্লিনিকটি খুবই উপকারে এসেছে। সেলিনা বেগম (৩২) বলেন, পরিবার পরিকল্পনার সেবা নিতে এসেছি। এখানে গর্ভবতী মহিলা, নারী ও শিশুদের নিয়মিত চিকিৎসা ও পরামর্শ দেয়া হয়। কিশোর কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয়। মাসে একটি স্যাটেলাইট ক্লিনিকের আয়োজন করা হয়।
পঞ্চগড় সদর উপজেলার ভারতীয় সামান্তবর্তী রতনীবাড়ী কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার মো. ফারুক হাসান বলেন, করোনা সংক্রমণের আশঙ্কার মাঝেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তৃণমূল জনসাধারণকে নিয়মিত সেবা প্রদান করছি। প্রায়ই কিছু রোগী আসেন যাদের সমস্যার সঙ্গে করোনা সংক্রমণের উপসর্গের অনেকটা মিল থাকে। যার ফলে করোনা আক্রান্ত রোগী হলেও তা নির্ধারণ করা আমাদের পক্ষে কঠিন হয়। ক্লিনিকে আসা রোগীদের কাছ থেকে তাদের শারীরিক সমস্যার তথ্য জেনে তাদের সচেতনতামূলক পরামর্শ প্রদান করে থাকি। সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহারের মাধ্যমে যতটা সম্ভব নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সেবা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এখন আগের থেকে রোগীও বৃদ্ধি পেয়েছে।
স্বাস্থ্য সহকারী মোছা. মনিরা বেগম বলেন, সপ্তাহে তিনদিন এই ক্লিনিক থেকে মায়েদের গর্ভ-পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও টিকা দেয়া নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পরামর্শ, ওষুধ ও সেবা প্রদান করে থাকি।
পরিবার কল্যাণ সহকারী (এফডব্লিউএ) মোছা. নূর নাহার বলেন, সপ্তাহে তিনদিন এই ক্লিনিক থেকে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে সেবা প্রদান করে থাকি। যে যে পদ্ধতি ব্যবহার করে সেটা তার জন্য ব্যবস্থা করে দেই। এছাড়া মাসে একদিন স্যাটেলাইট ক্লিনিক পরিচালনা করা হয়। কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করে থাকি।
বোদা উপজেলার আমজানীপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার আরজিনা পারভীন বলেন, করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর থেকে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। সাধারণ মৌসুমি জ্বর, সর্দি, কাশি, গলাব্যথা, পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা, বমি ও পাতলা পায়খানা এ ধরনের সমস্যা নিয়ে রোগীরা আসেন আমাদের কাছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি তাদের সেবা দেয়ার। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও আমাদের ক্লিনিকে রোগী বৃদ্ধি পাচ্ছে। পঞ্চগড় সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আফরোজা বেগম রীনা বলেন, উপজেলার ২৫টি কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপিকে করোনা সংক্রমণের সুরক্ষার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও উপজেলা পরিষদ থেকে প্রাপ্ত পিপিই, মাস্ক, হ্যান্ডগ্লোভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার প্রদান করা হয়েছে। শরীর থেকে স্যাম্পল গ্রহণের ওপর ১ দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে সিএইচসিপিদের। করোনাভাইরাসের এই সংকটময় মুহূর্তে সদর উপজেলার কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো নিরবিচ্ছিন্নভাবে তৃণমূল মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছে। সিএইচসিপিদের সাহসী ভূমিকার জন্য যা সম্ভব হচ্ছে।
পঞ্চগড় সিভিল সার্জন ডা. ফজলুর রহমান বলেন, করোনাকালে কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মীরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে প্রতি মাসে ৫ থেকে ৮ হাজার রোগী বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে সিএইচসিপিদের সুরক্ষা সরঞ্জাম দেয়া হয়েছে। আমরাও কমিউনিটি ক্লিনিকের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করছি।