× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

দক্ষিণ এশিয়ায় সংকটে নতুন মাত্রা

অনলাইন


(৩ বছর আগে) জুলাই ৩, ২০২০, শুক্রবার, ৭:৫৬ পূর্বাহ্ন

চীনের সঙ্গে ভারতের সীমানা ৩ হাজার ৪৪০ কিলোমিটার। দু’দেশের সীমান্ত বিরোধের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। ১৯৬২, ১৯৬৭ এবং ১৯৭৫ সালে সীমান্ত বিরোধ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। ১৯১৪ সালে বৃটিশ কর্তৃক নির্ধারিত সীমানা (ম্যাকমোহন লাইন) চীন আজও মেনে নেয়নি। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পর দু’দেশের সীমান্তে প্রদত্ত ‘লাইন অব এ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল’ (এলএসি) অলিখিত সীমানায় পরিণত হয়। ১৯৯৩ সালে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে দু’দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল লাইন স্বীকার করে নেয়। সর্বশেষ ১৯৭৫ সালে আরুণাচলের গিরিপথে চীনা সেনাদের গুলিতে চার ভারতীয় সেনা নিহত হয়। সম্প্রতি ১৫ই জুন রাতে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় সীমান্ত নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়।
চীন এবং ভারতীয় সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষে একজন কর্নেলসহ ২০ ভারতীয় সেনা নিহত হয়। গত ৪৫ বছরে দু’দেশের মধ্যে এটিই সবচেয়ে সহিংস ঘটনা। চীনা সেনারা গালওয়ান পয়েন্ট-১৪ এর ভারত নিয়ন্ত্রিত ভূমিতে তাঁবু গাড়ে এবং ভারতীয় সেনারা তা সরানোর চেষ্টা করলে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। গত মাসের শুরুতে লাদাখের প্যাংগং লেক এবং সিকিম সীমান্তে দু’দেশের সেনাদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। ঘটনার রেশ এতটাই প্রকট হয় যে, দুই দেশই লাদাখ সীমান্তে যুদ্ধাস্ত্র (অস্ত্র, সেনা, ফাইটার জেট) মোতায়েন করে। সেনা অফিসারদের দীর্ঘ বৈঠকের পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। এই মাসের মাঝামাঝিতে আবারো সীমান্ত উত্তপ্ত হয়। ১৯৯৬ সালে দুই দেশ প্রকৃত নিয়স্ত্রণ রেখার দুই কিলোমিটারের ভেতর গুলাগুলি ও বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার না করার শর্তে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু লাদাখে সহিংসতার পর ভারত এই চুক্তি ভঙ্গ করে সীমান্তে অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। সীমান্তকে ভবিষ্যতে আরো সহিংস করে তুলবে। ভারতের সব থেকে প্রাচীন প্রতিবেশী বন্ধু নেপাল। গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে ইন্ডিয়ান ওয়েল কর্পোরেশনই ছিল নেপালে জ¦ালানি তেল সরবরাহকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান। যার ফলে নেপাল ভারতের তেল-রাজনীতির গ-ি থেকে বের হতে পারেনি এবং নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতো ভারত। ২০১৫ সালে প্রবর্তিত নেপালের সংবিধান ভারতের মনঃপূত না হওয়ায় দেশটি তেল অবরোধ আরোপ করে। নেপালের অর্থনীতি যখন নজিরবিহীন সংকটে ঠিক তখনি এগিয়ে আসে চীন। নতুন তেল চুক্তি স্বাক্ষর হয় দু’দেশের মাঝে। এর ফলে নেপালের তেল বাজারের উপর দীর্ঘদিনের আধিপত্য হারায় ভারত। নেপালের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ক্রমেই নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে দিল্লি। নতুন সংবিধানের অধীনে ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বামজোট ক্ষমতায় এলে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরো দৃঢ় হয়। এই দৃঢ়তাই নেপাল-ভারত সম্পর্ককে আরো সংঘাতময় করে তুলছে। সম্প্রতি সীমান্ত নিয়ে ভারতের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়ায় নেপাল। ১৮ই মে নেপাল সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে কালাপানি, লিপুলেখ ও লিম্পিয়াধুরা ভূখ-কে মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করে। একই ইস্যুতে নেপালী সেনাদের গুলিতে নিহত হয় এক ভারতীয় নাগরিক। উল্লেখ্য, ১৮১৬ সালে স্বাক্ষরিত সুগাওলি চুক্তির মাধ্যমে ভারত ও নেপালের সীমানা নির্ধারিত হয়। ১৯৪৯ সালের ভারত-ভুটান চুক্তি ‘ট্রিটি অব ফ্রেন্ডশিপ’ অনুযায়ী প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য ও বিদেশনীতির ক্ষেত্রে ভুটান ভারতের উপদেশ মেনে চলবে। ভারতের সঙ্গে ৭০ বছরের আধিপত্য বিস্তারকারী সম্পর্ক দিপক্ষীয় ভাবেই স্বীকৃত ছিল। ভুটান ভারতের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘাতে না জড়ালেও সম্প্রতি দু’দেশের সম্পর্ক ক্রমেই শীতল হচ্ছে। এজন্য খোদ সংসদেই বিরোধীদের ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয় ক্ষমতাসীনরা। ভুটান ভ্রমণে পর্যটকদের চড়া কর গুনতে হয়। ভারতীয় পর্যটকরা এতদিন এই করের আওতামুক্ত থাকলেও থিম্পু তা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৭ সালে ভারতীয় সেনারা ডোকালাম উপত্যকায় ভুটানের ভূখ- ব্যবহার করে চীনা ফৌজের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। অথচ চলমান ভারত-চীন সংঘাতে চীনা ফৌজ ভুটানের ওয়াচ টাওয়ার ব্যবহার করে। যা কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করে। ভুটানের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক স্থাপনের এই আগ্রহ ভারতের জন্য যথেষ্ট দুশ্চিন্তার কারণ। বৃটিশ কর্তৃক ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত নির্ধারণের সময় কাশ্মীর অমীমাংসিত থেকে যায়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের দুই মাসের মাথায় কাশ্মীর ইস্যুতে সংঘাতে জড়ায় দুই দেশ। তখন জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয়। এরপর একই ইস্যুতে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় বহুবার। ১৯৬৫ সালে দেশ-দুটি বড় ধরনের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। ধর্ম ও রাজনীতির বিভিন্ন ইস্যুতে পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী দুই দেশের সীমান্তে বরাবরই যুদ্ধংদেহী অবস্থা বিরাজ করে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে উত্তপ্ত হয় ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত। ভারতীয় একটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে পাকিস্তানি সেনারা। অপরদিকে পাকিস্তান চীনের বিশ^স্ত বন্ধু। গোয়াদর বন্দরের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ৪০ বছরের জন্য পাকিস্তান চীনের হাতে হস্তান্তর করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার জন্য ভারত বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৭৪ সালে দুই দেশের মধ্যে ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ দক্ষিণ বেরুবাড়ী হস্তান্তর করে। কাজী মোখলেসুর রহমান বনাম বাংলাদেশ (২৬ ডিএলআর এডি-৪৪) মামলার রায় অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশ চুক্তি বাস্তবায়ন করে। অপরদিকে ভারতের পক্ষ থেকে তিন বিঘা করিডোর চুক্তি বাস্তবায়ন করতে সময় লাগে দীর্ঘ ৪৫ বছর। ১৯৭৫ সালে ভারত গঙ্গা নদীর উজানে ফারাক্কা বাঁধ চালু করে। যার ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জীব বৈচিত্র্য, কৃষি, নৌ পরিবহন, মৎস্য, মারাত্মক হুমকির মুখে পরে এবং জনজীবন বিপর্যস্ত হয়। সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশের বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। জাতীয় সংসদে উত্থাপিত সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত এক দশকে (২০০৯-২০১৯) ২৯৪ জন বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার স্বীকার হোন। ভারত যখন প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত, চীন তখন তাদের পাশে পেতে অর্থনৈতিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার অবকাঠামো উন্নয়নে সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করেছে চীন। মিয়নমার, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন খাতে বড় অঙ্কের আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে। ২০১৬ সালে চীনের রাষ্ট্রপতি শি-জিনপিং বাংলাদেশ সফরে এসে ২৪ বিলিয়ন ডলার সহায়তার ঘোষণা দেন। সম্প্রতি চীনের বাজারে আরো ৫ হাজার ১৬১ পণ্যের ৯৭ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা লাভ করে বাংলাদেশ। এই সুবিধা ১লা জুলাই থেকে শুরু হয়ে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। দেশটি কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় মেডিকেল ইকুইপমেন্ট ও বিশেষজ্ঞ টিম প্রেরণ করে। ভারত মহাসাগরে ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ (মুক্তার মালা) পরিকল্পনার আওতায় চীন তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে। এরই অংশ হিসেবে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, মিয়ানমারের সমুদ্র বন্দরগুলোতে উন্নয়ন কার্যক্রম চালাচ্ছে। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরের ৮০ শতাংশ মালিকানা ৯৯ বছরের জন্য ইজারা পেয়েছে চীন। একই সঙ্গে পাশর্^বর্তী এলাকায় ১৫ হাজার একর জমি ইজারা পায় দেশটি। জায়গাটিতে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব চীনের হাতে হস্তান্তর একই পরিকল্পনার অংশ। ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভারত মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত জিবুতিতে চীন সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করেছে। গত এক দশকে জলে ও স্থলে চীনের এই আধিপত্য বিস্তার ভারতের দুশ্চিন্তার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত ও চীনের এই দ্বন্দ্ব যখন ক্রমেই বাড়ছে তখন বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দু’দেশের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ।

[লেখক: মোহাম্মদ শিশির মনির আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সঙ্গে যায়েদ বিন আমজাদ শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।]
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর