নদীবন্দর সদরঘাট। নৌপথে দক্ষিণাঞ্চলে লোকজনদের চলাচলের অন্যতম পথ। কিন্তু এখানে নানা কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনার পর কর্তৃপক্ষ নানা উদ্যোগ নিলেও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ সদরঘাট ও তার আশপাশের ঘাটগুলোতে অবৈধভাবে লঞ্চ পার্কিং করা। একটি ঘাটে একটি লঞ্চ পার্কিং করানোর নিয়ম থাকলেও তার পেছনে আরেকটি লঞ্চ নোঙর করে রাখা হয়। যে ঘাটগুলোতে লঞ্চ পার্কিং করানোর কোনো নিয়ম নেই সে ঘাটগুলোতে লঞ্চ পার্কিং করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট খেয়া পারাপারের জন্য রুট থাকলেও যেখান সেখান থেকে খেয়া পারাপার করার কারণে নদীর পথ সরু হচ্ছে।
এতে বাড়ছে লঞ্চ দুর্ঘটনা। গত সোমবার শ্যামবাজার ঘাটে মনিং বার্ড এবং ময়ূর-২-এর সঙ্গে যে দুর্ঘটনা সেখানে একটির পেছেন একটি লঞ্চ পার্কিং করা ছিল। এতে লঞ্চের চালক লঞ্চটিকে গন্তব্য স্থলে ভিড়াতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে ময়ুর পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে লঞ্চটিক ডুবিয়ে দেয়। স্থানীয়রা বলছেন, অবৈধভাবে লঞ্চ পার্কিং থেকে ঢাকা নদীবন্দরের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তারা মাসোয়ারা নিয়ে থাকেন। এরসঙ্গে কিছু শ্রমিক নেতাও জড়িত।
এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদিক মানবজমিনকে জানান, সদরঘাটে লঞ্চ পার্কিংয়ের নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। এর ব্যত্যয় কেউ ঘটালে আমরা বিষয়টি দেখবো। ইতিমধ্যে সদরঘাট এলাকার পরিবেশ উন্নতি করা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। এ বিষয়ে নৌ পুলিশের ডিআইজি আতিকুল ইসলাম জানান, ঢাকা নদীবন্দরে নৌ পুলিশ স্পিড বোর্ড এবং নৌকায় করে সব সময় নজরদারি করে। লঞ্চ পার্কিং অবৈধভাবে করতে দেয়া হয় না। সরজমিনে জানা গেছে, ঢাকা নদীবন্দরে ছোট বড় মিলে ১২টি ঘাট রয়েছে। এতে বড় ও ছোট লঞ্চগুলো নোঙর করা হয়। কোনটিতে যাত্রী উঠানামা করা হয়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘাটগুলো হচ্ছে, সদরঘাটের মূল ৯,১০,১১ নম্বর পল্টুন, কাটপট্টি লঞ্চ ঘাট, শ্যামবাজার ঘাট, ফরাশগঞ্জ ঘাট, ওয়াইজঘাট, সিমসনঘাট, গুদারাঘাট, কাঠালিয়াঘাট ও লালকুটিঘাট। এসব ঘাটে নিয়ম হচ্ছে একটি লঞ্চ যাত্রী তুলে নির্দিষ্ট স্থানে চলে যাবে। যদি যাত্রী না পায় তাহলে অন্যান্য ঘাটে নোঙর করবে। লঞ্চের পেছনে লঞ্চ রাখা যাবে না। নদীর গতিপথ ছোট করা যাবে না। কিন্তু, কোনো ঘাটে এ নিয়মের বালাই নেই। এতে ঘটছে দুর্ঘটনা। অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে অনেক ডকইয়ার্ড কারখানা। কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের বিশাল লঞ্চ ও জাহাজগুলো নদীতে নামিয়ে রেখেছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতি সূত্র জানা গেছে, চলতি বছরেই ঢাকার সদরঘাটের নদী বন্দরে ১২টি ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে লঞ্চে লঞ্চে সংঘর্ষ ছয়টি এবং লঞ্চের সঙ্গে ছোট নৌকার সংঘর্ষ হয়েছে ৬টি। অবৈধ পার্কিং করায় এসব দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে জানা গেছে।
ঘাটে থাকা লোকজন ও শ্রমিকরা জানান, একটি লঞ্চ দুর্ঘটনায় পড়লে অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে লঞ্চটিকে উদ্ধার বা আহত যাত্রীদের উদ্ধার করতে সবাইকে হিমশিম খেতে হয়। কিন্তু একটি অদৃশ্য শক্তির কাছে জিম্মি ঢাকা নদীবন্দর।
শ্যামবাজারের ফল ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম জানান, ঢাকা নদীবন্দরে শৃঙ্খলার বড় অভাব। নদীবন্দরে ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা এলে চেহেরা পরিবর্তন হয়ে যায়। তিনি শুধু যেতে দেরি এরপর আবার আগের চিহারায় ফিরে যায়।
ঢাকা টু চাঁদপুরগামী লঞ্চের চালক সাহাবুল ইসলাম জানান, লঞ্চ নিয়ে যখন চাঁদপুর থেকে আসি তখন কেরানীগঞ্জে ঢোকা মাত্রই লঞ্চের গতি কমে যায়। অবৈধ লঞ্চের পার্কিংয়ের কারণে লঞ্চ আস্তে চালাতে হয়। দেখা গেছে লঞ্চ ঘাটে ভিড়াতেই কোনো কোনো সময় ১ ঘণ্টা লেগে যায়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন চালকরা।
সোনারতরী লঞ্চের চালক আনোয়ার হোসেন জানান, লঞ্চের ডাবল পার্কিংয়ের কারণে একটি লঞ্চের সঙ্গে আরেকটি লঞ্চের ধাক্কা লাগে। এতে দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রাণহানি হচ্ছে। পাশাপাশি যাত্রীরাও অনেক ভীতির মধ্যে থাকেন। অবৈধভাবে খেয়া পারাপারের কারণে ঢাকা সদর ঘাটে দুর্ঘটনা ঘটছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্টরা জানান, পুরো সদরঘাট নিয়ন্ত্রণ করছে কুলির সর্দাররা এবং ক্ষমতাসীন শ্রমিক নেতারা। তারাই মূলত পার্কিংয়ের টাকা পকেট ভরেন। এদের আশ্রয় দেয় বড় বড় নেতারা। এতে তারা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছেন।