× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

পুকুর চুরি ও প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ

মত-মতান্তর

ডা. ওয়াজেদ খান
১০ জুলাই ২০২০, শুক্রবার

‘পুকুর চুরি’ একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ। কোন প্রকল্প বা প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের দুর্নীতি হলেই আমরা উপমা টানি পুকুর চুরির। কিন্তু আসলেই কি পুকুর চুরি করা যায়? পুকুরের মাছ,পানি, শাপলা, কচুরিপানা এসব চুরি হতে পারে। তারপরও আমরা মোটাদাগে দুর্নীতির কথা বুঝাতে উদাহরণ দেই। তুলনা করি পুকুর চুরির সাথে। অথচ আমরা অনেকেই শানে নজুল জানিনা ‘পুকুর চুরি’র। শুধু বাংলা সংবাদমাধ্যম বা দেশের বিরোধী শিবিরেই এ প্রবাদ উচ্চারিত হয় না। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের মুখেও শোনা যায় পুকুর চুরির কথা।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী প্রায়শই এমন অপ্রিয় সত্য কথা বলে থাকেন।

গত ২২ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের কার্যনির্বাহী কমিটির (একনেক) নিয়মিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। গণভবন থেকে এই সভায় টেলিকনফারেন্সে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সভায় ১০টি প্রকল্পের বাজেট অনুমোদিত হয়। জলাশয় সংস্কারের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পও এর অন্তর্ভুক্ত। প্রসঙ্গটি আলোচনায় এলে অভিযোগের সুর ঝরে পড়ে প্রধানমন্ত্রীর কন্ঠ থেকে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, পুকুর খনন না করে শুধু পাড় কেটে বা পরিষ্কার করেই বিল নেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর এ অভিযোগ গুরুতর। নিশ্চয়ই তার কাছে তথ্য আছে। কারা পুকুর চুরির সাথে জড়িত। দেশের অসংখ্য খাল, বিল, জলাশয় কারা দখল করছে। জীবন্ত নদীর নাব্যতা ধ্বংস করে কারা গড়ছে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বসতি। মৎস চাষ প্রকল্পের অর্থ পুকুর খননের নামে নয় ছয় করছে কারা। মিথ্যে বেসাতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ হাতিয়ে নেয়ার কারা নিপুণ কারিগর। যারা এসব অপকর্ম অপরাধে জড়িত তারা কোন ছিচকে বা সিধেল চোর এমনটি ভাবার অবকাশ নেই। এরাই পুকুর চোর। এদের খুঁটির জোর মজবুত। কখনো আবার আইনের চেয়ে অধিক লম্বা এদের হাত। তারপরও প্রধানমন্ত্রী যখন তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেন, দেশের মানুষ তখন কিছুটা হলেও আশার আলো দেখতে পায়।

আসুন আমরা জেনে নিই পুকুর চুরির শানে নজুল। দুর্নীতি-অনিয়ম, চুরি-বাটপারি আজকের বাংলাদেশে যতোটা অবাধ ও ব্যাপক, ব্রিটিশ বঙ্গে ততোটা ছিল না। তারপরও সে আমলের অনেক এমন ঘটনা এখনো কাহিনী হয়ে আছে। পুকুর চুরির ঘটনাও সেই বৃটিশ আমলের। পূর্ব বাংলার কোন এক মহুকুমা প্রশাসনের দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে। চৈত্রের প্রচন্ড খরদাহে মাঠ-ঘাট চৌচির। খাবার ও গোসলের পানির অভাবে চারদিকে হাহাকার। ফলে শহরতলীর একটি গ্রামের দিশেহারা মানুষ দ্বারস্থ হয় মহুকুমা প্রশাসনের। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীকে তলব করেন মহুকুমা হাকিম। নির্দেশ দেন পানি সমস্যা সমাধান করার। সাত দিনের মাথায় প্রকৌশলী প্রস্তাব দেন নতুন একটি পুকুর খননের। এজন্য সরকারি একটি জমির খতিয়ান নাম্বারও উল্লেখ করেন প্রকৌশলী। জনস্বার্থে গৃহীত পুকুর খননের প্রস্তাবটি উচ্চ পর্যায়ে প্রেরণ করা হয় আর্থিক বরাদ্দের জন্য। প্রায় তিন মাস পর আর্থিক অনুমোদন মিলে পুকুর খননের। ততদিনে বর্ষাকাল এসে গেছে। পুকুরের জন্য নির্ধারিত জায়গায় থৈ থৈ করছে পানি। ভেস্তে যায় পুকুর খননের পরিকল্পনা। খনন কাজের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ভাগ বাটোয়ারা করে নেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ও মহুকুমা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। পুকুর খনন প্রকল্প পড়ে যায় ফাইল চাপা। সরকারের উচ্চপর্যায় ও গ্রামবাসীদের নিকট অজানাই থেকে রায় বিষয়টি।

কেটে যায় বছর কয়েক। মহুকুমা ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসে যোগ দেন নতুন কর্মকর্তা। শহরতলীর একই গ্রামে আবার দেখা দেয় ভিন্ন সমস্যা। কার্তিক মাসে মশার উপদ্রব বেড়ে যায়। প্রকোপ দেখা দেয় ম্যালেরিয়ার। গ্রামবাসী ছুটে যায় মহুকুমা প্রশাসনে। ডাকপড়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর। নির্দেশ দেয়া হয় মজা পঁচা পুকুর ভরাট করে মশক নিধনের। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসের কেরানি নথিপত্র ঘেঁটে প্রস্তাবিত পুকুর খননের চাপা দেয়া ফাইলটি বের করেন। প্রকৌশলী সরজমিনে অবস্থা দেখতে গিয়ে পুকুরটির কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাননি। পুকুর খননের গায়েবী বিষয়টি জানতে পেরে নতুন ফন্দি আঁটেন তিনি। উচ্চ মহলে প্রস্তাব দেন কয়েক বছর আগে চৈত্রের খরায় খননকৃত পুকুরটির পানি পচে গেছে। আর এখান থেকেই ঘটছে মশার বিস্তার। ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ করতে হলে জরুরি ভিত্তিতে পুকুরটি ভরাটের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। প্রস্তাব দ্রুত চলে যায় উচ্চ মহলে। ভরাট কাজের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ পৌঁছে যায় মহুকুমা প্রশাসনে। এতদিনে মাঠ ঘাট সব শুকিয়ে গেছে। এ চালানেও সমুদয় অর্থ হাতিয়ে নেন কর্মকর্তারা। একবার পুকুর খনন ও আরেকবার পুকুর ভরাট করার নামে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ লোপাট হয়ে যায়। আর এই চুরির নাম হচ্ছে ‘পুকুর চুরি’। সমাজ ও রাষ্ট্রে যুগ যুগ ধরে এভাবেই চলছে পুকুর চুরি। কোথায় নেই পুকুর চুরি। রাষ্ট্রের সর্বত্র এদের অবাধ বিচরণ। এদের কারণ সরকারের অনেক উন্নয়ন প্রকল্প দেখছে না আলোর মুখ।

দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত এদের কারণেই। করোনাকালে সাধারণ মানুষ চিকিৎসা বঞ্চিত। জীবন হাতের মুঠোয় পুরে ছুটছেন হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। প্রতিদিন মরছে মানুষ। চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয় করার নামে শত শত কোটি টাকা কারা হাতিয়ে নিয়েছে। কারা স্বাস্থ্য কর্মীদের হাতে তুলে দিয়েছে নকল সুরক্ষা সামগ্রী? এখন তারা কোথায়? স্বাভাবিকভাবেই এসব প্রশ্ন চলে আসছে সামনে। সময় এসেছে এদেরকে চিহ্নিত করার। এসব চোরদের আমি, আপনি, আমরা সবাই চিনি। কিন্তু আমাদের করার কিছু নেই। সমাজে দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করার দায়িত্ব যাদের তারা নির্বিকার। আর যারা দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেন উল্টো খড়গ নেমে আসে তাদের উপর। নিরুৎসাহিত করা হয় তাদেরকে। প্রধানমন্ত্রীও পুকুর চোরদের চেনেন। একনেকে’র সভায় দেয়া বক্তব্যে পুকুর চুরির ইঙ্গিতই দিয়েছেন তিনি। অভিযোগ করেছেন মনের অজান্তে। কিন্তু প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রীর এ অভিযোগ কার কাছে? অভিযোগ তো করবে জনগণ। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী। দিন শেষে সব প্রশ্নের জবাব তাঁকেই দিতে হবে।

লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ।
নিউ ইয়র্ক।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর