সড়ক-মহাসড়কে গমগম করছে মানুষ। যানবাহনও ফাঁকা নেই। হাট-বাজারও ফিরেছে সেই পূরণো চেহারায়। খাবারের দোকানগুলোতে চলছে দেদারছে বেচাকেনা। শিল্প-কারখানায়ও শ্রমিকদের জটলা। সবকিছুই মনে করিয়ে দেয় ৪/৫ মাস আগের ব্যস্ততম বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, নগরবাসীর কাছে করোনাভাইরাস এখন ড্যামকেয়ার। তাই চলাফেরায়ও ডোন্ট কেয়ার।
মানে করোনাভীতি তেমন নেই বললেই চলে। যদিও এর ফল প্রতিদিন আড়াইশ’ বা তারও বেশি করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ছে নমুনা পরীক্ষায়। চট্টগ্রাম সিভিল সার্জনের তথ্য মতে, বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে চট্টগ্রামের ৭টি ল্যাবে ৭৮১টি নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে ১৬২ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। বুধবার রাতে ১২৬৫ জনের নমুনা পরীক্ষায় ২৫৯ জন এবং মঙ্গলবার রাতে ১৪৭১ জনের নমুনা পরীক্ষায় ২৯৫ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। সেই সাথে মৃত্যুও কম নয়। চট্টগ্রামে করোনায় এখন মৃতের সংখ্যা ২১৩ জন। উপসর্গ নিয়ে মৃত রয়েছে ৫ শতাধিক। তথ্যানুযায়ী, করোনাসংক্রমণ রোধে গত ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম লকডাউন করা হয়। সেই সাথে করোনা সংক্রমণের ভয়ে সচেতন মহল ঘরবন্দি হয়ে পড়ে। শ্রমজীবি মানুষকে ঘরে রাখতে প্রশাসন উঠে পড়ে লাগে। কিন্তু মে মাসের শুরুর দিকে রাস্তায় নেমে পড়ে পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। যাদের মধ্যে শুরু হয় সংক্রমণ। শুধু তাই নয়, চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমণ। এরমধ্যে শিল্পজোন হিসেবে খ্যাত নগরীর উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ড অন্যতম।
উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু বলেন, মে মাসের মাঝামাঝিতে এই ওয়ার্ডে সর্বপ্রথম একজন পোশাককর্মীর শরীরে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সেই থেকে ওই মাসের মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার দাড়ায় ১৪৫.৫ শতাংশ। শেষ পর্যন্ত জুন মাসের শেষের দিকে এই ওয়ার্ডকে রোডজোন ঘোষণা করে ২১ দিনের লকডাউন করা হয়। এতে সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর শুরু হয় সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচল। ব্যস, বন্দরনগরী হয়ে উঠে করোনাভাইরাসের তীর্থস্থান। মে মাসে যেখানে করোনা শনাক্তের সংখ্যা ২ হাজারের একটু বেশি ছিল। সেখানে জুন মাসে করোনা শনাক্তের সংখ্যা ৯ হাজারের কাছাকাছি পৌছে যায়। আর জুলাই মাসের এই কয়দিনে করোনা শনাক্তের সংখ্যা দাড়ায় ১১ হাজার ১৯৩ জনে। তার মানে যত ডোন্ট কেয়ার তত সংক্রমণ। করোনাভাইরাসকে ডোন্ট কেয়ার করার কথা উঠে আসে নগরীর বিভিন্ন শ্রম ও পেশাজীবি মানুষের মুখেও। শুক্রবার সকাল ১১ টায় নগরীর ১০নং রোড কালুরঘাট-পতেঙ্গা সড়কে চলমান একটি বাসের যাত্রী আরিয়ান রহমান আরমান (৩৭) বলেন, করোনা তো মানুষকে ফানা করে দিয়েছে। করোনা এমনকি, যার ভয়ে গুটিয়ে থাকতে হবে। করোনার ভয়ে ব্যবসা-বানিজ্য বন্ধ। এ অবস্থায় করোনা সংক্রমণের আগেই মানুষ তো না খেয়ে মারা যাবে।
শফিউল মওলা (৫১) নামে একজন নগরীর বহদ্দারহাটে কেনাকাটা করার সময় বলেন, করোনা ছাড়া মানুষ মরে না? করোনার চেয়ে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে বেশি। খুন হচ্ছে বেশি। আর করোনা কি? করোনা সুখী মানুষদের জন্য ভয়ঙ্কর। করোনা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলেই সেটা বুঝা যায়। বরং করোনার নামে কতিপয় সুবিধাবাদী নানা কুট-কৌশলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। নমুনা পরীক্ষার নামে প্রহসন চলছে। চিকিৎসা ছাড়াই পকেট শূন্য করছে। এদের যেখানে ভয় নেই, সেখানে ভয় করে হাত গুটিয়ে রাখার কোন সুযোগ নেই আমাদের। তিনি বলেন, করোনায় সরকার প্রণোদনা দিয়েছে। কিন্তু তার ছিটেফোটাও পায়নি। আশপাশের কেউ পেয়েছে বলেও শুনিনি। কোনো আত্নীয় স্বজন পেয়েছে বলেও শুনিনি। যারা পেয়েছে তারা সরকারি দলের মানুষ। গত ১০-১২ বছরে তাদের অনেকে এখন পাকাদালান ও কোটি টাকার মালিক। আমাদের খাওয়ানোর তো কেউ নেই। তাছাড়া সর্দি-কাশির মতো চিকিৎসা নিলে করোনায়ও সুস্থ হওয়া যায়। সুতরাং করোনা ভয় তেমন আগের মতো নেই।
চট্টগ্রামের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. প্রশান্ত চৌধুরী বলেন, করোনা সংক্রমণের শুরুতে মানুষের মাঝে যে ভীতি কাজ করেছিল, তা অনেকটা কমে গেছে। এর কারণ হচ্ছে-মূলত খেটে খাওয়া মানুষ খাবার জোগাতে উপার্জনে নেমে গেছে। এটা করতে গিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। সামাজিক দুরত্বেরও বালাই নেই। সেই সাথে করোনা চিকিৎসায় হাসপাতালগুলোর নানা অব্যবস্থাপনা, নমুনা পরীক্ষায় দীর্ঘসূত্রিতা এসব থেকে মানুষের মাঝে ক্ষোভ সঞ্চার হয়েছে। যা মৃত্যু ভীতির চেয়েও কষ্টকর হয়ে জমে রয়েছে। ফলে মানুষ করোনা সংক্রমণকে ডেম কেয়ার করছে। ডোন্ট কেয়ার করে আগের মতো কাজকর্মে ঝাপিয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, মানুষ কতক্ষণ না খেয়ে থাকবে। না খেলে যেখানে মারা যাবে, সেখানে খেলে বাচার আশা তো পাচ্ছে। সংক্রমিত হলে চিকিৎসা পরের বিষয়। এমন একটা মনোকষ্ঠ মানুষের মাঝে কাজ করছে। ফলে মানুষের মনে করোনাভীতি অনেকটা কমে গেছে। তিনি বলেন, ভয় থাকলেও মানুষের করার কিছুই নেই। সিস্টেমের কাছে মানুষ বন্দি। যানবাহনের চেয়ে সড়কে মানুষ বেশি থাকলে বাদুরঝোলা হয়ে আসা যাওয়া তো করবেই। হাট-বাজার সবই ফুটপাতে। সড়কের উপর। দোকানগুলো তো আর সুপারশপ নয়। এত জনসংখ্যার দেশে মানুষ তো গিজগিজ করবেই। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, পোশাক কারখানা থেকে সব শিল্প কারখানা যেখানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পারত সেখানে তা মানা হচ্ছে না। যানবাহন আর হাটবাজারের মতো জনসমাগমের জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি মানার কোন সুযোগই নেই। আর সামাজিক দুরত্ব মেনে চলা তো স্বপ্নের ব্যাপার। এ অবস্থায় করোনা সংক্রমণ তো বাড়বেই। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখাও সম্ভব নয়। এরমধ্যে আসন্ন কোরবানির বাজারের কারনে এ সংক্রমণ আরো বাড়বে। এ কারনে এ মাসেই চট্টগ্রাম করোনা সংক্রমণের চুড়ায় উঠার আশঙ্কা রয়েছে।