× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার , ১৯ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৩ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

লেবাননে ১৫ বছরের গৃহযুদ্ধের ইতি ঘটিয়েছিলেন রফিক হারিরি

বিশ্বজমিন

মানবজমিন ডেস্ক
(৩ বছর আগে) আগস্ট ৫, ২০২০, বুধবার, ১:১১ পূর্বাহ্ন

১৫ বছর ধরে চলা লেবানন গৃহযুদ্ধের ইতি ঘটিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরি। তায়েফ এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। এই চুক্তির জন্য ব্যাপকভাবে কৃতীত্ব দেয়া হয় রফিক হারিরিকে। তিনি ওই গৃহযুদ্ধের পর রাজধানী বৈরুত পুনর্গঠন করেন। গৃহযুদ্ধ পরবর্তী প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু তাকে বাঁচতে দেয়নি ঘাতকরা। ২০০৫ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি বৈরুতেই আত্মঘাতী ট্রাকবোমা হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। এর আগে তিনি পাঁচটি মন্ত্রীপরিষদের প্রধান ছিলেন।
তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে লেবাননে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। হারিরি হত্যার জন্য যোদ্ধা গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর চারজন সদস্যকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল ফর লেবাননে তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার কাজ চলছে। কিন্তু হারিরি হত্যায় অন্যদের সঙ্গে সিরিয়া সরকারের যোগসূত্র রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
হারিরি হত্যায় লেবাননের রাজনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তনে অনুঘটকের মতো কাজ করেছে। সিডার বিপ্লবে ভয়াবহ প্রতিবাদ বিক্ষোভের ফলে সিরিয়ান সেনা সদস্য ও নিরাপত্তা রক্ষীদের লেবানন থেকে প্রত্যাহার করা হয়। একই সঙ্গে সরকারে ঘটে বড় পরিবর্তন। এক পর্যায়ে বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী ১০০ মানুষের মধ্যে হারিরি একজন হন। একই সঙ্গে বিশ্বের চতুর্থ ধনী রাজনীতিক হন তিনি। রফিক হারিরির জন্ম ১৯৪৪ সালের ১লা নভেম্বরে। তিনি একজন সুন্নি মুসলিম। তার জন্ম লেবাননের বন্দরনগরী সিডনে। তিনি বৈরুত আরব ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যবসায় প্রশাসনের গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি কাজের জন্য যান সৌদি আরবে। সেখানে অল্প কিছু সময় তিনি শিক্ষাদান করেন। এরপর যুক্ত হন নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে। ১৯৭৮ সালে সৌদি আরবের নাগরিকত্ব পান। একই সঙ্গে রয়ে যায় তার লেবাননের নাগরিকত্ব। এরপর তিনি বিভিন্ন রকম ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। এক পর্যায়ে সৌদি আরবের তায়েফে সময়মতো একটি হোটেল নির্মাণ করার জন্য বাদশা খালেদের পক্ষ থেকে তিনি ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন। এর কয়েক বছরের মধ্যে মাল্টি-বিলিয়নিয়ারে পরিণত হন। এরপরই তিনি লেবাননে নানা রকম জনহিতৈষী কাজে যুক্ত হন। ১৯৮২ সালে দক্ষিণ লেবাননে ১৯৭৮ সালের সংঘাতে হতাহতদের জন্য তিনি দান করেন এক কোটি ২০ লাখ ডলার। একই সঙ্গে তার কোম্পানির অর্থ দিয়ে বৈরুতের রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেন। সংস্কারে হাত দেন। গৃহযুদ্ধের সময় বিদ্রোহী মিলিশিয়াদের খুব বেশি আর্থিক সুবিধা দেয়া তার সাবেক ডেপুটি নাজাহ ওয়াকিম তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, তিনি বৈরুতকে ধ্বংস করে দিচ্ছেন, যাতে বৈরুতকে পুনর্গঠন করতে পারে। গৃহযুদ্ধের পর তিনি লেবাননে সৌদি আরবের রাজপরিবারের দূত হিসেবে কাজ করেন। তিনি এমন গ্রাউন্ডওয়ার্ক শুরু করেন যা থেকে ১৯৮৯ সালে তায়েফ একর্ড বা তায়েফ চুক্তি হয়। এই চুক্তির অধীনে লেবাননে যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে একত্রিত করতে সক্ষম হয় সৌদি আরব। এতে গৃহযুদ্ধের অবসান হয়। হারিরি রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে।
১৯৮০র দশকের শুরুতে লেবাননে ফিরে যান রফিক হারিরি। বিপুল পরিমাণ অর্থ দান করে এবং বিভিন্ন গ্রুপের সহায়তা দিয়ে নিজের নামকে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে থাকেন। ১৯৮৩ সালে তিনি প্রিন্স বন্দর বিন সুলতানের রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পিএলও’র পতনের পর তিনি সৌদি আরবের কাছে শক্তিশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। ১৯৯২ সালে তিনি লেবাননে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এ সময় প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইলিয়াস রাবি। বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে তিনি দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার চেষ্টা চালান। প্রথম দফার প্রধানমন্ত্রিত্ব স্থায়ী হয় ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। এরপর প্রধানমন্ত্রী হন সেলিম হোস। প্রকৃতপক্ষে নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইমিলি লাহুদের সঙ্গে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় রফিক হারিরি। এ জন্য তাকে দায়িত্ব ছাড়তে হয়। ২০০০ সালের অক্টোবরে তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী হন। বিদায় নেন সেলিম হোস। গঠন করেন মন্ত্রীপরিষদ। ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে রফিক হারিরি পক্ষ নেন ইউএন সিকিউরিটি কাউন্সিল রেজ্যুলেশন ১৫৫৯-এর। এতে লেবাননে অবস্থানরত সব বিদেশি সেনাদের প্রত্যাহারের কথা বলা হয়। ২০০৪ সালের ২০ শে অক্টোবর রফিক হারিরির দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হয়। তিনি পদত্যাগ করেন।
তবে সিরিয়ার দখলদারিত্বের সময় লেবাননকে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরেছিল দুর্নীতি। এ জন্য রফিক হারিরিকে দায়ী করা হয়। অভিযোগ করা হয়, ১৯৯২ সালে তিনি যখন প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তখন তার সম্পদ ছিল ১০০ কোটি ডলারেরও কম। কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার সময় সেই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬০০ কোটি ডলার। ক্রমবর্ধনাম সমালোচনা ও হারিরির নীতির বিরুদ্ধে জনঅসন্তোষের প্রেক্ষাপটে তার সরকার ১৯৯৪ সালে বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করে।
২০০৫ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি রফিক হারিরিকে হত্যা করা হয়। এদিন বৈরুতের সেইন্ট জর্জ হোটেলের কাছ দিয়ে তার গাড়িবহর যাওয়ার সময় পার্ক করে রাখা একটি মিৎসুবিশি ভ্যান থেকে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে রাখা ছিল প্রায় ১৮০০ কিলোগ্রাম টিএনটি (ট্রাই নাইট্রো টলুইন)। এতে রফিক হারিরি সহ কমপক্ষে ২৩ জন মারা যান। নিহতদের মধ্যে ছিলেন তার দেহরক্ষী, ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু ও সাবেক অর্থনীতি বিষয়ক মন্ত্রী বাসেল ফ্লোইহান। ২০০৬ সালে এ নিয়ে সের্গে ব্রামারটজ রিপোর্টে ইঙ্গিত দেয়া হয় যে, ঘটনাস্থল থেকে যেসব ডিএনএ প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে, তাতে দেখা যায় এই আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছে এক যুবক। ২০১৪ সালে এ নিয়ে দুটি রিপোর্ট দেয় জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইনভেস্টিগেশন কমিশন। তাতে ইঙ্গিত করা হয় যে, এই হত্যার সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে সিরিয়া সরকারের। এই বোমা হামলার জন্য যারা দায়ী তাদের বিচারের দায়িত্বে আছেন এমন আইনজীবীরা বলেছেন, এই ঘটনার সঙ্গে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের ফোনের যোগাযোগ থাকার প্রমাণ আছে।
কানাডার সিবিসি এক রিপোর্টে বলে রফিক হারিরি হত্যায় হিজবুল্লাহ দায়ী এমন তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘের বিশেষ তদন্তকারী দল। জাতিসংঘ সমর্থিত একটি ট্রাইব্যুনাল হিজবুল্লাহর চারজন সদস্যের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি ওয়ারেন্ট হাজির করে। কিন্তু এ হামলার জন্য হিজবুল্লাহ দায়ী করে ইসরাইলকে। অভিযুক্ত করা হয় হিজবুল্লাহ সমর্থক সেলিম জামিল আয়াশ, হাসান হাবিব মেরহি, হুসেইন হাসান ওনেসিস এবং আসাদ হাসান সাব্রাকে। বর্তমানে তাদের অনুপস্থিতিতে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল ফর লেবাননে তাদের বিচার চলছে।
ওদিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নেতাদের কাছে রফিক হারিরি ছিলেন প্রশংসিত, যেমন- তিনি ফরাসি সাবেক প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। বিদেশি নেতাদের মধ্যে বৈরুতের বাড়িতে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে রফিক হারিরি বিধবা স্ত্রীকে শান্তনা দিয়েছিলেন জ্যাক শিরাক। ওদিকে হত্যাকাণ্ডের জন্য সিরিয়াকেও প্রাথমিকভাবে দায়ী করা হয়। জার্মান প্রসিকিউটর ডেটলেভ মেহলিসের অনুরোধে ২০০৫ সালের আগস্টে গ্রেপ্তার করা হয় তখনকার লেবাননের জেনারেল সিকিউরিটির প্রধান মেজর জেনারেল জামিল আল সাঈদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুস্তাফা হামদান, মেজর জেনারেল আলি হাজ এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেমন্ড আজারকে। মেহলিসের রিপোর্ট ফাঁস হয়ে যায়। তাতে দেখা যায়, এর মধ্যে রফিক হারিরিকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জামিল আল সাঈদ। তার সঙ্গে সিরিয়ার উচ্চ পদস্থ গোয়েন্দা, নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের যোগ দেয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে রয়েছেন আসেফ শওকত, মাহের আসাদ, হাসান খলিল এবং বাহজাত সুলেইমান। কিন্তু পরের রিপোর্টে তাদের নাম করা হয় নি। এই চার জেনারেলকে ২০০৫ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বৈরুতের উত্তর-পূর্বে রুমেই কারাগারে আটকে রাখা হয়। কিন্তু তথ্যপ্রমাণের ঘাটতি থাকার অভিযোগে তাদেরকে জেল থেকে ছেড়ে দেয়া হয় ২০০৯ সালে। রফিক হারিরিকে হত্যার পর লেবাননে অনেক বোমা হামলা ও হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে। এসব চালানো হয়েছে সিরিয়া বিরোধী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে রযেছেন সমীর কাসির, জর্জ হাবি, জিব্রান তুয়েনি, পিয়েরে আমিন গামায়েল, অ্যান্টোইন ঘানেম এবং ওয়ালিদ ইদো। হত্যা চেষ্টা করা হয়েছিল ইলিয়াস মার, মে চিদিয়াক এবং সমির শিহাদের বিরুদ্ধে। এই হত্যাকাণ্ডে হিজবুল্লাহর সদস্য সেলিম জামিল আয়াশ, মুস্তাফা আমিন বেদ্রেদ্দিন, হুসেইন হাসান ওনেইসি এবং আসাদ হাসান সাব্রার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয় ২০১১ সালে।    
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর