স্কুলছাত্র শিশু বায়েজিদের (৮) লাশ দাফনের ৭৯ দিন পর হত্যা মামলা দায়ের করেছেন পিতা হেলাল মিয়া। মামলার প্রধান আসামি প্রতিবেশী মাসুক (৪২) ও তার পরিবারের আরো ৯ জন। বায়েজিদ ও আসামিদের বাড়ি সরাইল উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের আইরল (পূর্বপাড়া) গ্রামে। হেলালের অভিযোগ পূর্বশত্রুতার জেরে পরিকল্পিকভাবে বায়েজিদকে হত্যা করে করোনার ভয় দেখিয়ে কৌশলে তড়িঘড়ি করে লাশ দাফন করিয়েছেন মাসুক ও তার পরিবারের লোকজন। বিষয়টি কাউকে জানাতেও নিষেধ করেছিলেন তারা। এখন মাসুকের স্বজনরাই হত্যার কথা বিভিন্ন জায়গায় বলাবলি করছে। মামলা প্রত্যাহার করতে দেয়া হচ্ছে হুমকি। আর মাসুক বলছে হত্যা নয়, বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে শিশু বায়েজিদের মৃত্যু হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছেন নিহত শিশুর লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করার প্রক্রিয়া চলছে।
পুলিশ, নিহতের পরিবার ও মামলা সূত্র জানায়, আইরল গ্রামের পূর্বপাড়ার বাসিন্দা খলিল মিয়ার ছেলে হেলাল (৩২) ও মাজু মিয়ার ছেলে মাসুক মিয়া। ছোট বাচ্চাদের খেলাধুলা ও বনের কুঞ্জিতে আগুন দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে উভয় পরিবারের মধ্যে বিরোধ জন্মে। হেলালের ছেলে বায়েজিদ আইরল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্র। গত ১৩ই মে সকালে বায়েজিদ হাত-মুখ ধুতে মাসুকদের বাড়ির পুকুরে যায়। মাজু মিয়া, মাসুক ও তার পরিবারের লোকজন বায়েজিদকে ডেকে ঘরে নেয়। টাকা দেয়ার লোভ দেখিয়ে তাদের নির্মাণ কাজের ইট বহন করায়। দুই ঘণ্টা পর বায়েজিদ বাড়িতে যেতে চাইলে তারা দেননি। জোরপূর্বক আটক করে পরিবারের সকলে মিলে মারধর করতে থাকে। মিস্ত্রির বাসল্লা দিয়েও আঘাত করে। বাসল্লার চোখা অংশের আঘাত বায়েজিদের কপালের ডান পাশের নিচের অংশে প্রায় ৫ ইঞ্চি গভীর হয়। কেউ কেউ গলায় ও বুকে পা দিয়ে চেপে ধরে। বায়েজিদের মৃত্যু নিশ্চিত হলে তারা মরদেহ পাশের পুকুরে ফেলতে যায়। দীর্ঘ সময় নিখোঁজ বায়েজিদকে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজির পর মাসুকদের বাড়ির পুকুর পাড়ে তাদের সন্তানকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখে চিৎকার করতে থাকেন মা-বাবা। কীভাবে ব্যথা পেয়েছে বায়েজিদ? এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি প্রতিবেশী মাসুক ও তার পরিবারের লোকজন। বায়েজিদকে দ্রুত জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা (রেজি: নং-৩০৭২৪, তাং-১৩.০৫.২০ খ্রি.) হয়। বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষার পর চিকিৎসক বায়েজিদকে মৃত ঘোষণা করেন। মাজু মিয়া, মাসুক ও তার লোকজন বায়েজিদের বাবা হেলালকে করোনার ভয় দেখিয়ে বিষয়টি কাউকে না জানিয়ে দ্রুত দাফন কাজ সম্পন্ন করতে উঠেপড়ে লেগে যান। এমনকি লাশ ঠিকমতো কাউকে দেখতেও দেননি। পুলিশকে জানালে জানাজা ও লাশ দাফনে বাধা দিবে। অনেক হয়রানি করবে। এমন সব ভয়ভীতি দেখিয়ে নামমাত্র কয়েকজন জানাজা করে শিশুর লাশটি দাফন করেন। মাজু মিয়ার পরিবারের লোকজন মাথায় আঘাত পেয়ে বায়েজিদ মারা যাওয়ার বিষয়টি প্রচার করেন। যদিও এক্সরেতেও আঘাতের আলামত এসেছিল। সেটিও গোপন করেছে। দাফনের দুই মাসেরও অধিক সময় পর অতি সম্প্রতি মাসুকের পরিবারের জনৈক শিশু বিভিন্ন জায়গায় বলছে, বায়েজিদকে চাচা গাই দিয়া মারছে। আমডারে রাও করতে নিষেধ করছে। বলছে রাও করলে পুলিশ দইরা নিবগা। বায়েজিদের পিতামাতা এই ধরনের কথাবার্তা শুনেছেন। বিষয়টি তারা স্থানীয় একাধিক সর্দার মাতব্বরকে জানিয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন, তারা (মাসুকরা) অনেক প্রভাবশালী। কিছু বলতে গেলে, করতে গেলে বিপদে পড়বা। অনেকে বলছেন রাখ দেখি কিছু করা যায় কি-না। অবশেষে বায়েজিদের বাবা হেলাল মামলা করতে সরাইল থানায় এসেছেন। থানা সেই মামলা নেয়নি। হেলাল চলে গেছেন আদালতে। গত ১৯শে মে বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সরাইল আদালতে মামলাটি (সিআর-১৪৬/২০) জমা দেন। আদালত মামলাটি নথিভুক্ত করার নির্দেশ (স্মারক নং-৩৬০, তাং-২১.০৭.২০২০ খ্রি.) দিয়ে সরাইল থানায় প্রেরণ করেন। এরপর আরো ১০ দিন পর গত ৩১শে জুলাই মামলাটি নথিভুক্ত (মামলা নং-৩৫) হয়। হেলাল মিয়া বলেন, মাজু মিয়া অনেক আগেই বলেছিল আমার ছেলেকে পুড়ে মারবে। তাই তারা সকলে মিলে হত্যা করেছে। আগেও হুমকি দিয়েছে। এখনো মামলা তুলে নিতে নানা হুমকি দিচ্ছে। জনৈক ব্যক্তি আমাকে গতকাল বলেছেন মামলা প্রত্যাহার না করলে তারা আমার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিবে। মামলার প্রধান আসামি মো. মাসুক মিয়া বলেন, মামলার এজাহারে আমার ও আমার পরিবারের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ মিথ্যা বানোয়াট। আমাদের বাড়ি থেকে ১০০ হাত দূরে পুকুরের পাড়ে বায়েজিদ আহত হয়ে পড়েছিল। আমরা দেখে তার বাবাকে খবর দেয়। সে এসে নিয়ে যায়। হেলাল হাসপাতালে চিকিৎসকের কাছে বলেছে তার ছেলে আম খেতে গিয়ে পড়ে ব্যথা পেয়েছিল। কারো ওপর তার কোনো অভিযোগ নেই। লাশ দাফনের ৩ মাস পর কিছু লোকের পরামর্শে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মো. মিজানুর রহমান বলেন, সরজমিনে তদন্ত করেছি। লাশের ময়নাতদন্ত ছাড়া হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে না। তাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ময়নাতদন্তে করতে লাশ উত্তোলনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছি।