করোনার ছোবলে রংপুর অঞ্চলের প্রায় ৩ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। চাকরি না থাকায় তারা দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। দেখা দিয়েছে অভাবের হাতছানি। বাঁচার তাগিদে কেউ কেউ অসৎ পথ বেছে নিয়ে অপরাধের দিকে পা বাড়াচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, পরিবারে সচ্ছলতা আনতে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাড়ি দিয়েছিল অনগ্রসর রংপুর বিভাগের লাখ লাখ মানুষ।
করোনাক্রান্তিতে চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে তারা আবার ফিরে এসেছেন নিজ গ্রামে। তাদের একজন রংপুর নগরীর মাহিগঞ্জের গোলাপ হোসেন (৫৭)। গোলাপ হোসেন বলেন, ঢাকা ওয়ারী রোডে একটি প্রেসে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতাম। ঠিক-ঠাক বেতনও পেতাম।
প্রতি মাসে মাসে বাড়িতে টাকা পাঠাতাম। দুই ছেলে, স্ত্রীকে নিয়ে ভালোই সংসার চলছিলো। কিন্তু করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর বাড়িতে ফিরে আসি। সেই থেকে আমাকে ছাটাই করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এখন খুব কষ্টে জীবন যাপন করছি।
একই এলাকার নীলু (৪২) ঢাকায় একটি বাসাবাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন। করোনা আতঙ্কে বাড়িওয়ালা তাকে কাজ থেকে বাদ দেয়ায় নিজ এলাকায় ফিরে এসেছেন। স্বামী পরিত্যক্তা, ভিটে-মাটি হীন এ নারী এক সন্তান নিয়ে এখন দিশেহারা। চোখের জল ছেড়ে তিনি জানালেন তার কষ্টের কথা। তিনি বলেন, করোনাকালে ঘরে কেউ আর কাজে নিতে চায় না। কাজ না পেয়ে অনেক কষ্টে দিন যাচ্ছে। তিস্তার চরের আব্দুর মতিন ঢাকার শাহবাগে একটি ছোট্ট গার্মেন্টেসে কাজ করতেন। করোনায় ওই প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় বাড়িতে ফিরে এসেছেন।
তিনি বলেন, হাতে যা সঞ্চয় ছিল তা শেষ হওয়ার পথে। এরপর সংসার চালাবো কিভাবে তা নিয়ে চিন্তায় রয়েছি। গঙ্গাচড়া লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চরগ্রাম জয়রাম ওঝা ইউপি সদস্য দুলাল মিয়া বলেন, এই চরে ৮শ পরিবারের বসবাস। জীবিকার তাগিদে ৬শ পরিবারের প্রধানই বছরের বেশির ভাগ সময় কাজের সন্ধানে ছুটে যান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। কাজ না থাকায় বর্তমানে তারা সবাই বাড়িতে ফিরে এসেছেন। বেকার হয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন পার করছেন।
চাকরি হারা মিঠাপুকুর উপজেলার ১৭নং ইমাদপুর ইউনিয়নের সামসুল আলম বলেন (৩২) বলেন, ঢাকার শাহবাগে একটি প্রতিষ্ঠানে সেলস ম্যানের চাকরি করতেন। করোনার কারণে তাকে চাকরি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। এখন বাড়িতে ফিরে এসেছি। এখন কি করবো এটি ভেবে পাচ্ছি না। পীরগঞ্জ উপজেলার ভেন্ডবাড়ি এলাকার আব্দুর রহমান বলেন, চট্টগ্রামে শ্রমিকের কাজ করতো। করোনার কারণে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমার মত অবস্থা এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষের। উন্নয়ন গবেষকরা বলছেন, করোনাক্রান্তিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে চাকরি করা রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় ৩ লক্ষাধিক মানুষ চাকরি হারিয়েছে। চাকরিহারা মানুষেরা এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এতে করে দেশের দারিদ্রতার মানচিত্রে উত্তরাঞ্চলে আর নতুন করে দারিদ্রতার হার বাড়ছে। শহর থেকে কর্মহারিয়ে গ্রামে ফিরে আসা মানুষদের নতুন করে কর্মসংস্থানের অভাব সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে কর্মহীনদের মাঝে হতাশাসহ অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। এসব মানুষদের কর্মে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত গ্রামেই কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকারী সুযোগ-সুবিধার বৃদ্ধি দাবি জানিয়েছেন সচেতনরা।
রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, উন্নয়ন গবেষক উমর ফারুক বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এখন সরকারি কর্মচারী ছাড়া কেউ ভালো নেই। গবেষণা বলছে, প্রায় দুই কোটি মানুষ চাকরি হারিয়ে গ্রামে ছুটে এসেছেন। এর আগে দেশে ৪ কোটি মানুষ অসহায় ছিল। তাই আমরা বলছি এখন ৩৫০ শতাংশ মানুষ দেশে দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করছে। কর্মহীন মানুষদের মূল স্রোতধারায় আনতে না পারলে দেশের দারিদ্র মানচিত্রে বড় ক্ষতি হবে। সেজন্য গ্রামীন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। ব্যাপকভাবে গ্রামীন কর্মংস্থান যেমন হাঁস-মুরগি পালন, মৎস চাষ, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান তৈরী করা যেতে পারে। সেই সাথে সামাজিক নিরাপত্তা বলয় আরও প্রশস্ত করে কর্মহীন মানুষদেরকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিনা সুদে ঋণ দিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহযোগিতা করতে হবে। তাহলে তারা আবার সময় করে তাদের কর্মস্থলে ফিরে যেতে পারবে, যদিও এখন তাদের যাবার কোন সুযোগ নেই।
রংপুরের রাজনীতিবিদ আরশাদ হারুন বলেন, করোনার ছোবলে রংপুর অঞ্চলে অভাবের হাতছানি দেখা দিয়েছে। চাকরি হারিয়ে জেলার ৮ উপজেলায় প্রায় ৩ লাখ মানুষ গ্রামে এসে ধারদেনা সংসার চালাচ্ছে। তাদের পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে খাবার সংকটের মুখোমুখি হবে এ অঞ্চলের মানুষ। উপায় না পেয়ে বেছে নেবে অসৎ পথ। এতে করে অপরাধ প্রবণতা বাড়তে পারে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
রংপুর বিভাগীয় কমিশনার কেএম তারিকুল ইসলাম বলেন, শিল্প-কলকারখানার মালিকরা যেন তাদের প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে পারেন সেজন্য সরকার প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছে। কর্মহীনদের জন্য ত্রাণ বিতরন অব্যহত রেখেছে। এছাড়া অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করা হয়েছে। ব্যাংক খুলে দেয়া হয়েছে, আমদানি-রপ্তানি শুরু হয়েছে। রংপুর বিভাগ থেকে একটি বড় অংশ দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজ করে। যেহেতু শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলো চালু হয়েছে, তাদের তো শ্রমিক প্রয়োজন পড়বে। তাই আমার আহ্বান থাকবে ওইসব শিল্প মালিকদের প্রতি, যেন পূণরায় তাদের চাকুরীহারা শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তাদের প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেন এবং তাদের যেন অগ্রাধিকার দেয়া হয়। রংপুর অঞ্চল এমনিতেই অনগ্রসর এলাকা। যদি ওই ব্যক্তিরা কাজ পায় তবে তাদের পরিবার বেঁচে থাকবে। রংপুর বিভাগের শ্রমিকদের কাজ করার স্পৃহা আছে, সক্ষমতা আছে।