× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ধর্ষণতন্ত্র ও ক্ষমতার দাপট

মত-মতান্তর

শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন
৬ অক্টোবর ২০২০, মঙ্গলবার

করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত দেশের মানুষের জীবন। অর্থনৈতিক সংকট যাচ্ছে প্রায় সবার। সবাই এভাবে-সেভাবে বাঁচার লড়াই করছে। কিন্তু করোনার চেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেছে ধর্ষণ মহামারি। পত্রিকা পাতা খুললেই ধর্ষণ, গণধর্ষণ, পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ধর্ষণের ঘটনা চাপা দেয়া, ৫ বছরের শিশু থেকে ৭২ বছরের বৃদ্ধার ধর্ষণের খবর বেরুচ্ছে। সমাজের রন্ধে রন্ধে অসুস্থতা ভর করেছে। একেকটা ঘটনা যেন জাতিকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে এই প্রশ্নের উত্তর নেই কারো কাছে।
রাগে, ক্ষোভে, ঘৃণায় ফুঁসে উঠেছে দেশ।

সিলেটে এমসি কলেজে ছাত্রলীগকর্মীদের গণধর্ষণের ঘটনায় পুরা দেশ যখন স্তব্ধ তখন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ধর্ষণ চেষ্টার খবরে পুরো জাতি হতবাক হয়ে গেছে।। এই খবর যারা জেনেছেন, শুনেছেন সবাই স্তব্ধ হয়ে পড়েছেন। এইও সম্ভব!

সিলেটে এমসি কলেজ ও নোয়াখালীর ঘটনায় দেখা গেছে স্বামীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নারীকে ধর্ষণ ও নির্যাতন করা হচ্ছে। দুই ঘটনার সাথেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা জড়িত। দুই ঘটনায় ক্ষমতার কাঠামোর একটা সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। শুধু মনোদৈহিক কারণে ধর্ষণ ঘটছে তা নয় বরং এর সঙ্গে ক্ষমতার দাপট, রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণ জড়িত।

সিলেটে এমসি কলেজে ধর্ষণকারীরা ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের কর্মী ও স্থানীয়ভাবে ক্ষমতার কাঠামোতে ব্যাপক প্রভাবশালী। নোয়াখালীর ঘটনায় জড়িতরা স্থানীয় মাদক কারবারী, সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত। তারা সবাই যুবলীগ ও ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এছাড়া এই ঘটনার মূলহোতা দেলোয়ার বাহিনীর দেলোয়ার স্থানীয় সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ট বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে এতটা প্রভাবশালী যে ভিকটিম প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করবে তো দূরে থাক বরং সন্ত্রাসীদের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।

পরবর্তীতে সে নারীকে নানা কুপ্রস্তাব দেয়া হয়, তাতে রাজি না হওয়ায়  ফেসবুকে ভিডিও ছেড়ে দেয়া হয়।  ঘটনার ৩২ দিন পর ফেসবুকের মাধ্যমে তা জানা গেছে। আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে, ফেসবুকেই জানা যাচ্ছে। ফেসবুকে ভিডিওটি প্রকাশ না হলে হয়তো কেউই জানতে পারত না- এই বর্বোচিত ঘটনার কথা। হয়তো এভাবে আরো শতশত ঘটনা থেকে যাচ্ছে আড়ালে। এর আগে নোয়াখালীর সুবর্ণচরের ধর্ষণের ঘটনা দেশ-বিদেশে আলোচিত হলেও শেষ পর্যন্ত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা যায়নি। দীর্ঘদিন ধরে বিচারহীনতার  যে সংস্কৃতি দাঁড় হয়েছে তার চর্চা পরোক্ষভাবে ধর্ষণকে লালন করছে।

সিলেট ও নোয়াখালীর দুই ঘটনায় স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে কেড়ে নিয়ে ধর্ষণ ও নির্যাতন করা হয়। অনেকে ভাবছেন একটি প্রজন্ম ‘সেক্সুয়ালি ফ্রাস্টেডেট’ হয়ে উঠেছে। পর্ণোগ্রাফি ও মাদকের বিস্তার একটি প্রজন্মকে যৌন আগ্রাসী করে তুলেছে।

আসলে একটি প্রজন্ম বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। স্থানীয় ক্ষমতার কাঠামো ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগশাজোস তাদের এতটাই বেপরোয়া করেছে যে, তারা কাউকে পরোয়া করে না। তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে আঙুল তোলার সাহস কারো নেই। মামলা, পুলিশ এদের কাছে ‘ডাল-ভাত’। এই নিরুঙ্কুশ আধিপত্য ও বিচারের মুখোমুখি না দাঁড়াতে হওয়ার স্পর্ধা তাদের এতটাই বেপরোয়া করেছে যে, তারা যেকোন অন্যায় করতে ভয় পাচ্ছে না।

এছাড়া স্থানীয় ক্ষমতার কাঠামোতে নারীর নিচু অবস্থানের কারণে অনেক ধর্ষণের ঘটনায় ধামাচাপা দিয়ে দেয়া হচ্ছে সহজে। শুধু একটি-দুইটি ঘটনার বিচারের দাবিতে সোচ্চার হলেই হবে না। ধর্ষণ থামাতে চাইলে ধর্ষণের সঙ্গে যে ক্ষমতার কাঠামো জড়িত তাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। ক্ষমতাসীন হলেই, ক্ষমতা কাঠামোতে আরোহণ করলেই যে কেউ যেকোন অন্যায় করতে পারবে না, তাকে জবাবদিহিতা ও বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে- তা নিশ্চিত করতে হবে।

অনেকে বলছেন, পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো ধর্ষণতন্ত্র কায়েম করছে। ঠিক, পুরুষতান্ত্রিকতার আধিপত্যের কারণে খুব সহজেই নারী ভিকটিম হচ্ছে। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়ন তো হচ্ছে, হচ্ছে না তাতো নয়। নারীর ক্ষমতানের বিপরীতে যে ‘গুন্ডাতন্ত্র’ তৈরী হচ্ছে তা নারীকে টার্গেট করছে। ফলে নিরাপদ সমাজের জন্য আমাদের পুরো সিস্টেমটাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি রুখে দিতে হবে। প্রতিবাদ, প্রতিরোধে ভাঙতে নিপীড়কদের ক্ষমতার কাঠামো।

হয়তো এই ঘটনার বিচার হবে, হয়তো হবে না। কিন্তু একটি প্রজন্ম যে বেপরোয়া হয়ে ওঠছে তার দায় কে নিবে? দেশের যেখানেই যান একটাই আলাপ। অমুক ভাই, তমুক ভাই, ওর ম্যান, এর ম্যান, কমিটি দিবে, কমিটি নিবে এসব গল্প। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বা যেকোন লীগ অথবা তাদের ভূঁইফোড় সংগঠনে যোগ দেয়ার জন্য, পদ-পদবির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেছে একটা প্রজন্ম। যেন এই পদপ্রাপ্তিই তার জীবনের স্বার্থকতা। ক্ষমতাসীন দলের আস্থাভাজন হওয়ার জন্য অন্ধের মতে ছুটছে তারা। তার একটাই কারণ, ক্ষমতাসীনদের পদায়ন তার যেকোন কাজকে লেজিটিমেইট করবে, করছে। ভয়ের রাজত্ব কায়েম করার জন্য ক্ষমতাসীন দলের আশ্রয় তার দরকার। কোনরকম পদপ্রাপ্তি বা  নেতার সান্নিধ্য পেলে সে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সে বিশ^াস করে ফেলে তাকে ছুঁতে পারবে না কোন কাঠগড়া। রাজনীতির এই নিরুঙ্কুশ ক্ষমতার চর্চা পুরো একটি প্রজন্মকে বিপদগ্রস্ত করছে। এখন ফুটবল মাঠে খেলতে গেলেও সেখানেও পার্টি, দল মেনে খেলতে হয়। রাজনীতির এই অসুস্থ চর্চা সমাজের প্রতিটি অঙ্গনকে কুলুষিত করছে। আমরা তলিয়ে যাচ্ছি, বেশ অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি। গোপনে প্রকাশ্যে অন্যায়কে বৈধতা দিয়ে দিচ্ছি। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে যে জায়গায় যাচ্ছে, জাতি হিসাবে আমাদের যে পরিচয় দাঁড়াচ্ছে, তা ভীষণ লজ্জার। অর্থনৈতিক অগ্রগতি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন একটি জাতির জাতিতাত্ত্বিক পরিচয় নয়। জাতির পরিচয় তার মননে, শিল্পে, সাহিত্যে, সংস্কৃতি, আচরণ ও  সামাজিক শৃঙ্খলায়। কিন্তু এসব সুস্থ চর্চা না করে কুলুষিত ও অসহিঞ্চ রাজনীতির কারণে জাতি হিসাবে আমরা অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি।

রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতার নিরুঙ্কুশ চর্চা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, বিকৃত যৌনশিক্ষা বন্ধ করতে না পারলে, সামাজিক শৃঙ্খলাবোধ ও সহনশীলতা তৈরী করতে না পারলে সামাজিক যে চিত্র সামনের দিনে দাঁড় হবে তাতে আমরা কেউ নিরাপদ নই।

লেখক: সাংবাদিক ও ¯œাতকোত্তর শিক্ষার্থী,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর