× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ধর্ষণ বন্ধে সবার আগে রুখতে হবে ‘ধর্ষণের সংস্কৃতি’

মত-মতান্তর

মো. মিজানুর রহমান
৯ অক্টোবর ২০২০, শুক্রবার

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষকদের একটি বর্গ হিসেবে শুধুমাত্র দলীয় রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে ফেলতে দেখছি অনেককেই। কোন সন্দেহ নেই যে দুর্নীতিগ্রস্ত, অস্বচ্ছ এবং যেকোন মূল্যে ক্ষমতাই শেষ কথা- এমন এক অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ধর্ষকদের রাজনৈতিক ক্ষমতার পাঠাতন তাদের ধর্ষণকামকে আরো উস্কে দেয়, তারা বেপরোয়া করে তোলে। ক্ষমতার দাপটে তারা কোন কিছুই পরোয়া করে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই প্রবণতাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু দলীয় ক্ষমতাই কী ধর্ষণের একমাত্র কারণ বা অনুঘটক? যদি তাই হতো, তবে ধর্ষক শুধুমাত্র তারাই হতো যারা রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। রাজনৈতিক ক্ষমতার বাইরে আছে, এমন ধর্ষকের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। ধর্ষণের সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতার সম্পর্ক থাকলেও তা একমাত্র কারণ নয়।
বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে নির্মিত লিঙ্গীয় ক্ষমতার প্রভাবও অনেকাংশে দায়ী। মনে রাখা জরুরি, রাজনৈতিক ক্ষমতার বলয়ে থাকা ধর্ষকও আদতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে বেড়ে ওঠা একজন ব্যক্তি। তাই ধর্ষণ প্রতিরোধে সবার আগে এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিসরের দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরের দিক দিয়ে ধর্ষণের ঘটনাগুলোকে বিশ্লেষণ করা জরুরি বলছি- কেননা ধর্ষক হিসেবে নিকট অতীতে কাকে দেখা যায়নি? বাবা, চাচা, মামা, খালু, ফুপা, বন্ধু, স্বামী, প্রেমিকসহ চেনা-অচেনা সকল বর্গের পুরুষ কর্তৃক নারী ও শিশু ধর্ষণের খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ মিডিয়াগুলোতে এত বেশি দেখা যাচ্ছে যে, (অপ্রকাশিত ধর্ষণের সংখ্যা বাদ দিয়ে) অনেকেই প্রত্যেক পুরুষকে সম্ভাব্য ধর্ষক হিসেবে দেখার জন্য বলছেন। আমরা দেখেছি, ২০১৭ সালে ধর্ষকরা রূপাকে ধর্ষণ করে হত্যা করার পর যে যার পরিবারে গিয়ে খুবই স্বাভাবিক আচরণ করেছে, প্রাত্যহিক সংসার ধর্ম পালন করেছে, কর্তব্যনিষ্ঠ ব্যক্তি সেজে থেকেছে। তাদের কোন বিকার ছিল না, আচরণে ছিল না কোন অস্বাভাবিকতা! অর্থাৎ, ঘটনা প্রকাশের আগে সম্ভাব্য ধর্ষক হিসেবে সব পুরুষকে সন্দেহ করা যেতেই পারে। এই পরিস্থিতির দায় কী আমরা এড়াতে পারি? উত্তর পেতে ‘রেপ কালচার’ ধারণাটি সম্পর্কে জানা জরুরি।

‘রেপ কালচার’ বা ‘ধর্ষণের সংস্কৃতি’ ধারণাটি ১৯৭০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে নারীবাদী চিন্তকগণ কোন সমাজে বিদ্যমান এমন পরিবেশকে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করেছিলেন যেখানে যৌন নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিকেই দোষারোপ করা হয় এবং পুরুষ কর্তৃক ঘটিত যৌন সহিংসতাকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখা হয়। Emilie Buchwald তার Transforming a Rape Culture গ্রন্থে বলেন, যখন কোন সমাজ যৌন সহিংসতাকে স্বাভাবিক করে দেখে, তখন এটি রেপ কালচারকে গ্রহণ ও সৃষ্টি করে। তিনি বলেন, ‘এটা হচ্ছে এমন কতগুলো জটিল বিশ্বাসের সমাহার, যা পরুষ কর্তৃক যৌন আক্রমণকে এবং নারীর প্রতি যৌন সহিংসতাকে সমর্থন করে। এটা এমন এক সমাজ যেখানে যৌন সহিংসতাকে কামোদ্দীপক হিসেবে বিবেচনা করে।’ একটা ধর্ষণের সংস্কৃতিতে নারী ক্রমাগত যৌন হুমকির মধ্যে থাকে, যৌন ইঙ্গিত, মন্তব্য, স্পর্শ থেকে ধর্ষণের শিকার পর্যন্ত হয়। এরকম সংস্কৃতিতে নারী-পুরুষ উভয়েই নারীর প্রতি শারীরিক ও মানসিক সন্ত্রাসকে জীবনের বাস্তবতা (Fact of life) বলে মনে করে।

এবার দেখা যাক, কী বা কোন বিষয়সমূহ একটা সমাজে বিদ্যমান থাকলে ধর্ষণের সংস্কৃতি স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়। Southern Connecticut State University এই ‘ধর্ষণের সংস্কৃতি’ ধারণাকে তুলে ধরার জন্য এক গবেষণার মাধ্যমে কতকগুলো বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করে। আমাদের সমাজের প্রেক্ষিতে এসব  বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে প্রসঙ্গক্রমে কিছু কথা যোগ করে নিম্নে উপস্থাপন করছি:

১. ভিক্টিমকে দোষারোপ করা (আমরা দেখি যে ধর্ষক বলছে, ধর্ষিতা যৌন সম্পর্ক স্থানে সম্মত ছিল, কিংবা ‘অশালীন’ পোষাক ধর্ষণের জন্য দায়ী)

২. যৌন সন্ত্রাসকে তুচ্ছ করে দেখা (আমরা শুনে থাকি ‘ছেলেদের এমন একটু-আধটু দোষ থাকে’, ‘জোয়ান পোলা বয়সের দোষে কইরা ফালাইছে’। আপন জুয়েলার্সের মালিক তার ধর্ষক ছেলে সম্পর্কে এমনটাই বলেছিল।)

৩. যৌনতাকে ইঙ্গিত করে হাস্যরস করা।

৪. যৌন হয়রানিকে সহ্য করে যাওয়া (আমাদের সমাজে কয়জন নারী প্রতিবাদ করেন? ওড়না ধরে টান দিলে ওড়না বাঁচাতে বাঁচাতেই উনারা তটস্থ হয়ে পড়েন। কারণটা অবশ্যই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক। ইজ্জত ও লজ্জার ধারণা নারীদের মানসপটে গেঁথে থাকে, প্রতিবাদ করতে তো শেখানোই হয় না।)

৫. ধর্ষণের মিথ্যা প্রতিবেদন তৈরি করা।

৬. প্রকাশ্যে ভিক্টিমের পোষাক, মানসিকতা, উদ্দেশ্য ও চারিত্রিক ইতিহাস নিয়ে সূক্ষ্ম/স্থূলভাবে হাসি-তামাশা করা বা বিচার-বিশ্লেষণ করা।

৭. চলচ্চিত্রে/টেলিভিশনে ভিত্তিহীন বা আজগুবি লিঙ্গীয় সহিংসতা প্রদর্শন।

৮. ‘পুরষত্ব’ কে আধিপত্যশীল, যৌন আক্রমণাত্মক এবং এর বিপরীতে ‘নারীত্ব’ কে নমনীয় এবং যৌন নিস্ক্রিয়রূপে সঙ্গায়িত করা।

৯. যত বেশি সংখ্যক নারীর সঙ্গে পুরুষ যৌন সম্পর্কে জড়াতে পারবে, ততই পরিচিত/বন্ধু মহলে তার কদর বাড়বে।

১০. নারীকে আবেদনময়ী হয়ে ওঠার চাপ প্রদান।

১১. ধরেই নেয়া যে, শুধুমাত্র ‘নষ্ট/খারাপ’ নারীরাই ধর্ষিত হয়।

১২. ধরেই নেয়া যে, পুরুষরা ধর্ষিত হয় না। কিংবা শুধু ‘দূর্বল’ পুরুষরাই ধর্ষিত হয়।

১৩. ধর্ষণের অভিযোগকে গুরুত্ব না দেয়া।

১৪. নারীকে ধর্ষণের শিকার না হওয়ার বা এড়িয়ে যাবার শিক্ষা প্রদান করা  (যেনো ধর্ষণ এমন এক বাস্তবতা তা থেকে লুকিয়ে বেঁচে থাকতে হবে)।

১৫. বিদ্যমান আইনী ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় ধর্ষিত নারীর আরো বেশি হেনস্থার শিকার হওয়া।

মোটা দাগে বলা যায়, যখন কোন সমাজে এমন সব বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তাহলে বুঝতে হবে সে সমাজে ‘ধর্ষণের সংস্কৃতি’ বিরাজমান। খুব চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই বলে দেয়া যায় যে, উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যাবলীর প্রায় সবগুলোই আমাদের সমাজে বিদ্যমান। এখন প্রশ্ন হলো- এই ধারা বদলানোর উপায় কী, যখন কিনা বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের সমাজে এক প্রকার ‘ঘড়ৎস’ হয়ে আছে! প্রয়োজন ধর্ষণের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলা, মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো পর্যায়ে, পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত। এটা কারো একার লড়াই নয়। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কেউ-ই এই লড়াইয়ের বাইরে নয় এবং একমাত্র সম্মিলিত প্রয়াসই পারবে বিষাক্ত ভাইরাসের মত দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকা এই ‘ধর্ষণের সংস্কৃতি’কে থামিয়ে দিতে, সমূলে উৎপাটন করতে। ধর্ষণের রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে বোঝা-পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিসরে নির্মিত ‘ধর্ষণের সংস্কৃতি’কেও পরিবর্তনের চেষ্টা করতে হবে।

লেখক: সহকারি অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর