বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পালস সার্ভে অনুযায়ী পৃথিবীর ৯০ শতাংশ দেশে করোনা মহামারির কারণে স্বাভাবিক স্বাস্থ্য সেবায় কমবেশি বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এ বছর মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত সার্ভেটি সর্বমোট ১০৫ টি দেশে করা হয়েছে এবং দেখা গিয়েছে যে, বাংলাদেশসহ মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিপর্যয়ের চিত্র অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। প্রায় প্রতিটি দেশেই প্রয়োজনীয় রুটিন স্বাস্থ্যসেবা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং বিশেষ করে কম আয়ের দেশগুলোতে ক্যান্সারসহ মারাত্মক ব্যাধির শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসা উভয়েই দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সব চেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে অথবা কমেছে এমন স্বাস্থ্য সেবার অন্যতম হচ্ছে: নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি (৭১ শতাংশ), নন সংক্রামক ব্যাধি যেমন ডায়াবেটিস ও কার্ডিওভাসকুলার রোগের সনাক্তকরণ এবং চিকিৎসা (৬৯ শতাংশ), পরিবার পরিকল্পনা এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম (৬৮ শতাংশ), মানসিক রোগের চিকিৎসা (৬১ শতাংশ) এবং ক্যান্সার রোগের সনাক্তকরণ এবং চিকৎসা (৫৫ শতাংশ)। এছাড়াও অন্যান্য যেসকল রোগের চিকিৎসা মারাত্মক বাধার সম্মুখীন হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো: ম্যালেরিয়ার সনাক্তকরণ ও চিকিৎসা (৪৬ শতাংশ), এবং যক্ষার সনাক্তকরণ এবং চিকিৎসা (৪২ শতাংশ)। এই সকল রোগের স্বাভাবিক চিকিৎসা ব্যাহত হওয়ার কারণে স্বভাবতই জনস্বাস্থ্য এখন থেকেই মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে যার কুফল আমাদের সবাইকেই ভোগ করতে হচ্ছে এবং এর প্রভাব কাটাতে হয়তো অনেক বছর অপেক্ষা করতে হবে।
দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশে মার্চ মাসের শুরু থেকেই সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চরম বিপর্যয় শুরু হয়। এ ব্যাপারে সরকারি হাসপাতালগুলো যেমন দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেয়, তেমনি বেসরকারি হাসপাতালগুলোও সমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাতের দায়িত্বহীনতা আর অব্যবস্থাপনার কথা আর নাই বা বললাম।
হাসপাতালে ডাক্তার সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত জ্যেষ্ঠ ডাক্তারবৃন্দ নানা অযুহাতে গণহারে ছুটিতে চলে যান। যার অনেকেই এখনো নিয়মিত ভাবে কর্মস্হলে আসছেন না। অনেককে কোয়ারেন্টিনে চলে যেতে হয়, আবার অনেকেই সেবা দিতে গিয়ে সুরক্ষা সামগ্রী এবং তদসংক্রান্ত জ্ঞানের অভাবে নিজেরাই করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন। করোনা চিকিৎসায় পর্যাপ্ত জ্ঞান, অভিজ্ঞতার, ব্যবস্থাপনা আর চিকৎসা সামগ্রীর স্বল্পতা তো আছেই, জ্যেষ্ঠ এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অভূতপূর্ব স্বল্পতার কারণে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা যেমন ব্যহত হয়েছে তেমনি করোনায় সংক্রমিত নয় কিন্তু অন্যান্য মারাত্মক রোগে আক্রান্ত রোগীরা বিনা চিকিৎসায় এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটে বেরিয়েছে। এবং অনেকেই চিকিৎসার চরম অবহেলায় শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে। তাই বিগত মাসগুলোতে বাংলাদেশে মৃত্যুহারের উপর করোনার প্রভাব নিরুপণ করা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। মাত্রাতিরিক্ত হারে কোন রোগে কতজন মারা যাচ্ছে, মৃত্যুর সঠিক কারণ, ইত্যাদি সঠিক ভাবে বিশ্লেষণ করে বর্তমান কর্মপদ্ধতি আশু সংস্কার করা না গেলে বর্তমান চিকিৎসা বিপর্যয় এবং অতিরিক্ত মৃত্যুহার কখনোই কমানো সম্ভব হবে না। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ আর মৃত্যু পরবর্তী হাহাকার ক্রমেই বাড়বে বৈ কমবে না।
বিপর্যস্থ চিকৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বেশ কিছু সুপারিশমালা প্রণয়ন করেছে। বাংলাদেশ সহ সকল সদস্য রাষ্ট্র সুপারিশ সমূহ দ্রুত বাস্তবায়ন করবে সেটাই আন্তর্জাতিক মহলের সকলের আকাংখা। সুপারিশমালার অন্যতম হলো: ১) জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসার গুরুত্ব পুনঃনির্ধারণ করা এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসা সামগ্রীসহ জনবল পুনঃবিন্যাস করা, ২) করোনা টেস্ট সহ চিকিৎসার সমস্ত খরচ রাষ্ট্রীয়ভাবে বহন করা যাতে করে অর্থনৈতিক কারণে কেউ চিকিৎসা নিতে অনাগ্রহী না হয়, ৩) অনলাইন চিকিৎসার উপর ডাক্তার সহ সকল স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্রুত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যাতে করে হাসপাতালের ভিতরে এবং বাইরে যে কোনো রোগীর চিকিৎসা দ্রুততম সময়ের মধ্যে শুরু করা যায়, ৪) চিকিৎসাপত্র প্রদানের এবং জীবন রক্ষাকারী ঔষধের সরবরাহে গদবাধা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা, এবং ৫) জনস্বাস্থ্য বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যবিনিময় সহজবোধ্য, দ্রুত এবং সময়োপযোগী করা|
লেখকঃ বিশ্ব ব্যাংকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মকর্তা।