মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা ও প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গতকাল মৃত্যু পরোয়ানা স্বরাষ্ট্র সচিব, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, আইন সচিব ও ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর পাঠানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার সাঈদ আহমেদ গণমাধ্যমকে এই তথ্য নিশ্চিত করেন।
কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষ জানান, পরোয়ানা কারাগারে পৌঁছার পরে তা সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে পড়ে শোনানো হয়। এ সময় রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আবেদন (রিভিউ) করবেন বলে জানিয়েছেন কায়সার। সূত্রমতে, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে এই আবেদন করতে হবে। তা না করলে যেকোনো দিন রায় কার্যকর হতে পারে। চলতি বছরের ১৪ই জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ তার আপিল আংশিক মঞ্জুর করে রায় দেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার সাঈদ আহমেদ জানান, গত বুধবার দুপুরের পর রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি হাতে পেয়েছেন তারা।
এ মামলায় কায়সারের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন এস এম শাহজাহান। এবং রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ছিলেন তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। সূত্র জানায়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজের নামে ‘কায়সার বাহিনী’ গঠন করে যুদ্ধাপরাধ সংঘটন করেন হবিগঞ্জ মহকুমার রাজাকার কমান্ডার ও শান্তি কমিটির সদস্য সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার। তাকে ২০১৪ সালের ২৩শে ডিসেম্বর সর্বোচ্চ সাজাসহ ২২ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৫২ জনকে হত্যা-গণহত্যা, দুই নারীকে ধর্ষণ, পাঁচজনকে আটক, অপহরণ, নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায় এবং দুই শতাধিক বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে ১৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে ১৪টি অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে প্রথমবারের মতো অন্য অপরাধের পাশাপাশি ধর্ষণের দায়ে ফাঁসির আদেশ পান কায়সার। সাঁওতাল নারী হীরামণি ও অপর নারী মাজেদাকে ধর্ষণের অপরাধ দু’টি প্রমাণিত হয় এই রায়ে। এই দুই নারীকে ধর্ষণের ফলে বীরাঙ্গনা মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া যুদ্ধশিশু শামসুন্নাহার প্রথমবারের মতো ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্যও দেন কায়সারের বিরুদ্ধে।
সূত্র আরো জানায়, কায়সার ২০১৫ সালের ১৯শে জানুয়ারি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ফাঁসির সাজা বাতিল ও বেকসুর খালাসের আরজি জানিয়ে আপিল করেন (নম্বর: ০৪/২০১৫)। ট্রাইব্যুনালের রায় বাতিলের পক্ষে মোট ৫৬টি যুক্তি দেখিয়েছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে ৪৮৪ পৃষ্ঠার ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, একাত্তরে সৈয়দ কায়সার প্রথমে হবিগঞ্জ মহকুমার রাজাকার কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ৫শ’ থেকে ৭শ’ স্বাধীনতাবিরোধী লোক নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করেছেন। নিজের নামে ‘কায়সার বাহিনী’ গঠন করেন। তিনি নিজে ওই বাহিনীর প্রধান ছিলেন। ‘কায়সার বাহিনী’ নামাঙ্কিত এ বাহিনীর নিজস্ব ইউনিফর্মও ছিল। কায়সার বাহিনীর মাধ্যমে হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বৃহত্তর কুমিল্লায় হত্যা, গণহত্যা, মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, ধর্ষণ, হামলা, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালান। তিনি পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখিয়ে বিভিন্ন গ্রামে নিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের লোক এবং হিন্দু সমপ্রদায়ের ওপর আক্রমণ চালান। এ ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দেয়ায় যুদ্ধশিশু শামসুন্নাহারকে সাহসিকতার জন্য এবং সব নির্যাতিত নারী ও বীরাঙ্গনাদের স্যালুট জানান ট্রাইব্যুনাল।