× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার , ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

‘অটোপাস’ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষা ভাবনা

মত-মতান্তর

শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন
৩ নভেম্বর ২০২০, মঙ্গলবার

বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখন সবচেয়ে আলোচিত শব্দ ‘অটোপাস’।  শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে না, সেই সঙ্গে জেএসসি ও এসএসসি’র ফলাফল গড় করে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ফলাফল ঘোষণা করবেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে ইতিমধ্যে নানা মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ ও অভিভাবকরা। এই অটোপাস সিদ্ধান্ত প্রশ্নতীত নয় কিন্তু এর কোন যৌক্তিক বিকল্পও নেই। এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশে পরীক্ষার হলে এইচএসসি’র মতো এক মিলিয়নের বেশি পরীক্ষার্থীর পাবলিক পরীক্ষা নেয়ার পরিস্থিতি তৈরী হয়নি।

তবে কয়েকটি বিষয়কে সামনে নিয়ে অটোপাসের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রথমত অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা এসএসসিতে বিজ্ঞান বা বাণিজ্যিক বিভাগ নিয়ে পড়ে এইচএসসি পর্যায়ে বিভাগ পরিবর্তন করেছে। ধরেন, একজন শিক্ষার্থী এসএসসিতে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে এইচএসসিতে মানবিক বিভাগ নিয়েছে। কিন্তু এখন তার এসএসসির বিজ্ঞানের ফলাফল এইচএসসির মানবিক পড়াশোনার মূল্যায়নের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা বিভাগ পরিবর্তন করে অপেক্ষাকৃত সহজতর বিভাগে যায় পরবর্তীতে ভাল ফলের আশায়। কিন্তু অটোপাস ধারণা এই ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক মূল্যায়নকে ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত করবে।

সেক্ষেত্রে একটি বিকল্প হতে পারে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের সর্বশেষ নির্বাচনী পরীক্ষার ফলাফলকে আমলে নেয়া। আরেকটা বিকল্প হতে পারে সকল পরীক্ষার্থীদের জন্য স্কাইপিতে তিন সদস্যদের একটি শিক্ষক প্যানেল দিয়ে ভাইভা’র ব্যবস্থা করা। পর্যায়ক্রমে সপ্তাহব্যাপী একটি ভাইভা চালাতে ৪০-৫০ হাজার শিক্ষকই যথেষ্ট। এটা মূল্যায়নে সবচেয়ে সঠিক পদ্ধতি নয়, তবু তিনজন শিক্ষক একজন শিক্ষার্থীকে অন্তত ৩০ মিনিট কিছু প্রশ্ন করলে তাকে মূল্যায়নের একটা ধারণা পেতে পারে। জেএসসি, এসএসসি, সর্বশেষ নির্বাচনী পরীক্ষার সঙ্গে এই স্কাইপি ভাইভাকে মূল্যায়নের একটা মানদ- হিসাবে ধরা যেত। সেক্ষেত্রে অটোপাস বা পরীক্ষা ছাড়া পাসের কথা আসবে না। একেবারে না হওয়ার চেয়ে কিছুটা হওয়া ভাল। ভাইভাতে পাস করার জন্য শিক্ষার্থীরা বাড়িতে পড়াশোনাও করবে। স্কাইপিতে ভাইভা নিতে বিশেষ কারিগরি ত্রুটিতে পড়তে হবে বলে মনে হয়। কোন পরীক্ষার্থীর ডিভাইস না থাকলে সে একদিনের জন্য তার আত্মীয়, পাড়া প্রতিবেশীর ডিভাইসের সাহায্য নিতে পারে। নেটওয়ার্ক প্রবলেম বিশেষ আলোচ্য নয়, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামেও বেশ ভাল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। এরপরও কোন অঞ্চলে বিশেষ সমস্যা থাকলে ভাইভা উপলক্ষে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অপেক্ষাকৃত ভাল নেটওয়ার্ক অঞ্চল থেকে সে যুক্ত হতে পারে।

এই বছরে এইচএসসি’র পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৬৫ হাজারের বেশি। তার মধ্যে অনিয়মিত শিক্ষার্থী আছে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৫০০ জন। যারা এক-তিন বা ততোধিক বিষয়ে ফেল করেছে। এক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন এই অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের তো বিষয়ভিত্তিক মূল্যায়ন করা হবে। সেক্ষেত্রে জেএসসি বা এসএসসিতে সংশিষ্ট শিক্ষার্থীর এইচএসসিতে ফেল করা বিষয়টি না থাকলে তবে তাকে কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে সেটাও প্রশ্ন।

এখানে আরেকটি বিষয় আমলে নেয়া উচিত- সরাসরি জেএসসি, এসএসসি ও নির্বাচনী পরীক্ষার মোট ফলাফলের গড় না করে বিষয়ভিত্তিক গড় করলে শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক মানও প্রকাশ করা যাবে। যেটা পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষকে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীকে সাবজেক্ট অফার করার সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে।

এইচএসসি’র অটোপাস ধারণার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি নিয়ে এখন বেশ শোরগোল চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলের জন্য নির্ধারিত নাম্বার ৮০ থেকে কমিয়ে ২০ নামিয়ে নিয়ে এসেছে। নামিয়ে নিয়ে আসা নয় বরং এসএসসির-এইচএসসি’র জিপিএ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার মতো প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষার ফলাফল মূল্যায়ন বা প্রভাবিত করার সিদ্ধান্তই বাদ দেয়া উচিত। ঢাবিসহ প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগভিত্তিক সেন্টারে পরীক্ষা নেয়ার দিকে ঝুঁকছে। সেক্ষেত্রে  পরীক্ষা নিতে গিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়। কাজটি করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা না থাকায় এই আশঙ্কা। তবে আলোচিত হয়েছে অনলাইনে পরীক্ষা নিয়ে। এটা নিয়ে অনেকেই হাসাহাসি করছে। কিন্তু এটা কী অবাস্তব কিছু!  নিচের কোনটি ফল- আম/জবা/তিমি/ কুকুর, এই ধরনের প্রশ্ন না করলে অবশ্যই অনলাইনে পরীক্ষা পদ্ধতির একটা বাস্তবতা আছে।

আমি নিজে দিল্লির সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি। ডিভাইসে প্রশ্নপত্র দেয়ার সঙ্গে একটি সফটওয়ারের মাধ্যমে তারা ডিভাইসকে মনিটরে রেখেছে। এছাড়া মোবাইল/ল্যাপটপ ফ্রন্ট ক্যামেরার মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের গতিবিধি নজরে রেখেছে। একটি প্রশ্নের উত্তরের পর আরেকটি প্রশ্ন এসেছে। পুরা প্রশ্নপত্র একসঙ্গে দেয়া হয়নি। কোন কারণে ইন্টারনেট ডাউন হওয়ার পর রিকানেক্ট হলে উত্তর দেয়া প্রশ্নের উত্তর পাল্টানোর সুযোগ রাখা হয়নি। এছাড়া প্রশ্নপত্র এমনভাবে তৈরী করা হয়েছে পরীক্ষার্থীদের ভেবেচিন্তে প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে। গুগল করে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া দুরূহ ছিলো। কিন্তু অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার কারিগরি প্রস্তুতির চেয়ে মানসিক প্রস্তুতির অভাব রয়েছে আমাদের দেশে। কেন দ্বাদশ শ্রেণি পাস করা একজন শিক্ষার্থীর মেইল আইডি থাকবে না। একদিনের জন্য কেন কারো কাছে ডিভাইস ধার করতে পারবে না!

কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ আজ সাত মাস। প্রধানমন্ত্রী করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ফলে আরও ৩-৪ মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হতে পারে। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন এখনও সকল শিক্ষার্থীকে অনলাইন ক্লাসের আওতায় আনতে পারেনি। শিক্ষাঋণ পুরো বিশ্বে প্রচলিত। ঋণ বা অনুদানে শিক্ষার্থীদের হাতে ডিভাইস তুলে দিতে পারেনি। এখানে প্রশাসনের আর্থিক অক্ষমতার চেয়ে মানসিক অক্ষমতা দায়ি। এখনো পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের জন্য স্বল্পমূল্যে ডাটা প্যাকের ব্যবস্থা করতে পারেনি।
যে কয়েকটি ভ্যাকসিন ট্রায়ালে আছে তা পুরোপুরি অনুমোদন নিয়ে বাজারে আসতে ফেব্রুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত সময় লাগবে। এরপর আন্তজার্তিক রাজনীতি আর বাণিজ্য স্বার্থ পেরিয়ে এই ভ্যাকসিন মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে সময় লেগে যাবে আরও ২-১ মাস। এছাড়া ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নেয়ার ২৮ দিন পর নেয়া যাবে পরবর্তী ডোজ। আগামী এপ্রিলে শুরু হতে যাচ্ছে পবিত্র মাহে রমজান। তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুনরায় পরিপূর্ণ স্বাভাবিক হতে মে/জুন ২০২১ পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। ইতিমধ্যে অক্সফোর্ড বিশে^র প্রথম সারির অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ২০২১ সাল পর্যন্ত তাদের শিক্ষা কার্যক্রম অনলাইনে চালিয়ে  নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। টেক হোম এক্সাম ও সিটিং এক্সামের বদলে টার্ম পেপার জমা নেয়া পুরো বিশ্বব্যাপী চলছে। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এসব নিয়ে দূরদর্শী চিন্তা-ভাবনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তারা চেয়ে আছে অনন্তকালের দিকে। কখন সবকিছু আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে ওঠবে। এদিকে শিক্ষার্থীদের এক-দেড় বছর নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে তাদের কোন ভাবনা নেই।

শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রযুক্তির ছোঁয়া ও পুঁথিগত ধ্যান ধারণার মূল্যায়ন পদ্ধতি থেকে সরে আসার একটা সুযোগ তৈরি করেছে কোভিড-১৯। কিন্তু সেকেলে ধ্যান ধারণাকে আঁকড়ে ধরার মানসিকতা ও প্রযুক্তি ফোবিয়ার কারণে সারাবিশ্ব যখন এগিয়ে যাচ্ছে আমরা আকাশের তারা দেখছি আর ভাবছি কোন অনন্তকালে শেষ হবে এই করোনা পরিস্থিতি।

লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর