আমি আর মায়া দুজনে মিলে শিশুদের গান গাইতাম। সেখানে আমার পছন্দের ছন্দ ছিল ‘ফিল্ড মাই কাপ লর্ড’। আমার মনে পড়ে একবার মা দিবসে আমরা স্থানীয় মায়েদের উদ্দেশ্যে একটি গান পরিবেশন করেছিলাম, সে সময় আমরা একেকজন মাদার শব্দটির প্রত্যেকটি আলাদা অক্ষরের মতো করে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার জন্য নির্ধারিত হয়েছিল ‘টি’ অক্ষর। এ সময় আমি দু’হাত দু’দিকে মেলে দিয়ে গর্বের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলাম। ‘টি’ দিয়ে মূলত মায়েদের সময়কে নির্দেশ করা হতো। যে সময় তিনি শিশুদের ভালোবেসে আগলে রাখতেন।
আমার পছন্দের রাত ছিল বৃহস্পতিবার রাত।
এ সময় আপনি আমাকে সহজেই গ্রোব স্ট্রিট এবং ডারবির মোড়ে একটি বড় ভবনে আমাকে পেতেন। এটি ছিল কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতির চর্চা কেন্দ্র। যার নাম ছিল রেইনবো সাইন সেন্টার। এখানে চলচ্চিত্র, চিত্রকলা প্রদর্শন কেন্দ্র, নাচঘরসহ আরো অনেক কিছুই ছিল। এই কেন্দ্রের রেস্তরাঁ ছিল এবং তার রান্নাঘরটিও ছিল অনেক বড়। সেখানে সবসময় কেউ না কেউ মজাদার কিছু রান্না করতে থাকতেন। যার মধ্যে ছিল স্মোদার্ড চিকেন, মিট বল গ্রেবি, ক্যান্ডিড ইয়ামস, কর্ণ ব্রেড ও পিচ কোবলার।
দিনের বেলায় আপনি চাইলেই সেখানে নৃত্য এবং বিদেশি ভাষার ওপর ক্লাস করতে পারেন। কিংবা নাটক ও চিত্রকলার ওপর প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। তবে রাতের বেলা সেখানে কৃষ্ণাঙ্গ চিন্তাবিদ এবং নেতাদের বক্তব্য শুনতে পারবেন। সেখানে একইসঙ্গে তাদের ছবি ও বক্তৃতা প্রদর্শন করা হতো। এই খ্যাতনামা কৃষ্ণাঙ্গরা ছিলেন সংগীত শিল্পী, চিত্রকর, কবি, লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিক্ষাবিদ, নৃত্যশিল্পী এবং রাজনীতিবিদ। এই নারী ও পুরুষরা ছিলেন আমেরিকান সংস্কৃতি এবং গঠন সমালোচনার অগ্রদূত।
কনসার্ট প্রমোটার মেরি এন পোলার ছিলেন রেইনবো সাইনের প্রতিষ্ঠাতা। যিনি আরো দশজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে নিয়ে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এটি চালু করেন। এর নামটি নেয়া হয়েছিল কৃষ্ণাঙ্গদের সংগীত ‘মেরি ডোন্ট ইউ উইপ’ গান থেকে। এর মধ্যে একটি লাইন ছিল, ‘গড গেব নুয়া দ্য রেইবো সাইন, নো মোর ওয়াটার দ্য ফায়ার নেক্সট টাইম’।
আমাদেরকে যে সদস্য কার্ড দেয়া হতো তার উপরেও এই লাইনটি ছাপার অক্ষরে লেখা থাকতো। জেমস বাল্ড উইন তার বই ‘দ্য ফায়ার নেক্সট টাইম’ এই ছন্দটি থেকেই নেয়া হয়েছে। তিনি নিজেও মেরি অ্যান পোলারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এবং রেইনবো সাইন পাবের নিয়মিত অতিথি ছিলেন। আমি, আমার মা এবং মায়া নিয়মিত রেইনবো সাইন ক্লাবে যেতাম সেখানে সকলেই আমাদেরকে ‘শ্যমালা অ্যান্ড দ্য গার্লস’ বলে চিনতো। আমরা ছিলাম একটি দল, একটি জোট এবং যখন আমাদের কারও সঙ্গে দেখা হতো আমরা মুখে বড় হাসি দেখিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতাম।
রেইনবো সাইনে একটি জাতিগত বৈচিত্র্যতা এবং স্পন্দন ছিল। এটি ছিল জ্ঞানের চর্চা এবং প্রসারের কেন্দ্র। এর উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে ভালোবাসা। যে সব পরিবারের শিশুরা আসতো তাদেরকে বিশেষভাবে অভ্যর্থনা জানাতো। পোলার একদা একজন সাংবাদিককে বলেছিলেন, আমরা এখানে যাই করি না কেন এবং যত বিনোদনের ব্যবস্থাই করি না কেন এর মধ্যে একটি বার্তা লুকিয়ে থাকে, বার্তাটি হচ্ছে নিজের দিকে তাকাও এবং তা নিয়ে চিন্তা কর।
রেইনবো সাইন সেন্টারে হাই স্কুলের বাচ্চাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। সেখানে শুধু চিত্রকলা চর্চাও হতো না এর পাশাপাশি বেশকিছু কার্যক্রম সেখানে পরিচালিত হতো যা ছিল বড়দের অনুষ্ঠানের সমান্তরাল। সেখানে এইসব শিশুরা রেইনবো সাইন সেন্টারে আগত অতিথিদের, শিল্পী কুশলীদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেতেন। এই এলাকাটি ছিল অসাধারণ সব কৃষ্ণাঙ্গদের বসতি এবং সেখানে কৃষ্ণাঙ্গ অনেক গৌরবগাথা রচিত হচ্ছিল। সমগ্র আমেরিকা থেকে অভিবাসীরা এই এলাকায় আসতে শুরু করেছিল। অর্থাৎ আমার মতো শিশুরা যারা রেইনবো সাইনে সময় কাটাতাম তারা এই অসাধারণ কৃষ্ণাঙ্গ নেতাদের সাহচর্য পেয়েছিলাম।
১৯৭১ সালে কংগ্রেস ওম্যান শার্লি কিস হোলম রেইনবো সাইন সেন্টারে বেড়াতে এসেছিলেন। সে সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার চেষ্টায় প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। তার প্রচারণার স্লোগান ছিল, নিজের শক্তির কথা বল এবং ‘আন ভোট এবং আন বস্ট’ থাকো। অর্থাৎ কারও কাছে বিক্রি হইও না এবং নিজস্বতা নিয়ে বাঁচো। পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী লেখিকা অ্যালাইস ওয়াকার তার বই ‘দ্য কালার পারপল’ রেইনবো সাইন সেন্টারে পাঠ করেছিলেন। মায়া অ্যাঙ্গোলো ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের লেখকও। তিনি তার আত্মজীবনী ‘আই নো হোয়াই দ্য কেইসড বার্ডস সিঙ’ বইটি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন।
যখন আমার বয়স সাত তখন নাইনা সিমন রেইনবো সাইনে অভিনয় করেছিলেন। ১৯৭২ সালের ৩১শে মার্চ বার্কলের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ দাবি করা মেয়র ওয়ারেন ওয়াইডনার সিমন যাওয়ার দু’দিনের মাথায়ই রেইনবো সাইন ক্লাবে এসেছিলেন।
রেইনবো সাইন ক্লাবের বৈদ্যুতিক আবহ আমি ভালোবাসতাম। ভালোবাসতাম সেখানকার হাসি, সেখানকার খাবার এবং সেখানকার শক্তিমত্তা। আমি ভালোবাসতাম মঞ্চের বক্তৃতাগুলো এবং দর্শকদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। সেখানেই আমি শিখেছিলাম শৈল্পিক অবিব্যক্তি ও উচ্চকাঙ্ক্ষা। সেখানকার বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রম ছিল দারুণ ব্যাপার।
আমি সেখানেই বুঝতে পেরেছিলাম যে, খাবার, কবিতা, রাজনীতি, সংগীত, নৃত্য এবং শিল্পকলার সমন্বয়ই একজনের মস্তিষ্কের ক্ষুধা দূর করার সবচেয়ে ভালো উপায়। এখানেই আমি আমার মায়ের প্রতিদিনের কার্যক্রম দেখে আমার ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা দেখতে পাচ্ছিলাম।
আমার মা আমাদেরকে বড় করেছেন এটি বিশ্বাস করার মাধ্যমে যে, আমি করতে পারি না- এটা কোনো যুক্তিতেই গ্রহণীয় নয়। ভালো মানুষ হওয়ার মানেই হলো নিজের থেকেও বড় কিছুর জন্য দাঁড়িয়ে যাওয়া। সফলতা হচ্ছে তাই যা অন্যের অর্জনকে সাহায্য করে। কোন পদ্ধতির জন্য লড়তে হবে তাকে আরো শুধরানোর জন্য। এবং আগে থেকেই চলে আসছে এটি ভেবে কখনও থেমে যেও না। রেইনবো সাইনে আমি এই মূল্যবোধগুলো বাস্তবতার নিরিখে উপলব্ধি করতে পেরেছি। এই মূল্যবোধসম্পন্ন ব্যক্তিত্বদের সাহচর্য পেয়েছি সেখানে। আমি তাদের হাতেই লালিত পালিত হয়েছি এবং আমার ধারণা সেখানে যারা আসতেন তাদের অভিজ্ঞতাও একই। আমি যাই ছিলাম তা নিয়ে আমি সুখি ছিলাম।
যখন আমি মিডল স্কুলের তখন আমাদেরকে এই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। আমার মা মন্ট্রিলের ম্যাগগিল ইউনিভার্সিটি থেকে এবং ইহুদিদের একটি সাধারণ হাসপাতালে গবেষণার প্রস্তাব পেয়েছিলেন। এটি ছিল তার ক্যারিয়ারকে এগিয়ে নেয়ার জন্য অসাধারণ পদক্ষেপ।
কমালা হ্যারিসের অটোবায়োগ্রাফি ‘দ্য ট্রুথ উই হোল্ড’ বই থেকে