করোনা মোকাবিলায় সরকারের ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে কুটির, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীদের বঞ্চিত না করার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা।
রোববার (২৯ নভেম্বর) ঢাকা চেম্বার আয়োজিত ‘শিল্পনীতির সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে তারা এ আহ্বান জানান।
ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান এবং পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশ নেন। অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. মো. মাসুদুর রহমান।
নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন বলেন, ‘অর্থনীতির শিল্প খাতের অধিকাংশ উদ্যোক্তারাই কুটির, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার মধ্যে অর্ন্তভুক্ত। এদের উন্নয়ন করা গেলেই দেশে কর্মসংস্থান বাড়বে, অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও বিনিয়োগ বাড়বে এবং সচল হবে দেশের অর্থনীতি।’
মন্ত্রী জানান, সরকারি প্রণোদনা পাওয়ার ক্ষেত্রে ২০ হাজার কোটি টাকা সিএমএসই খাতের জন্য বরাদ্দ দেয়া হলেও ১৫ই অক্টোবর পর্যন্ত বরাদ্দ ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৭০ কোটি টাকা, যা এ খাতে ঘোষিত মোট প্রণোদনার ৩৫.৩৫%। যেখানে তৈরি পোশাক ছাড়া প্রায় সব শিল্প খাতে প্রণোদনা বণ্টনে ব্যাংকগুলো পিছিয়ে রয়েছে। সরকারের ঘোষিত নীতিগত ও আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে যেন কুটির, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বঞ্চিত না হন, সে বিষয়টি লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
শিল্পমন্ত্রী জানান, সিএমএসএমই-তে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের মাধ্যমে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, বৃহত্তর শিল্পের ব্যক ওয়ার্ড লিঙ্কেজকে বলিষ্ঠ করা, কর্মসংস্থান সহায়ক প্রবৃদ্ধি এবং গ্রাম ও শহরে বসবাসকরীদের মাঝে বৈষম্য হ্রাস করার লক্ষ্যে আসন্ন শিল্পনীতি প্রণয়ন করা হবে।
তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের আলোচনার ভিত্তিত্তে যে শিল্পনীতি প্রণয়ন করা হবে, তা ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়ন এবং ব্যবসা পরিচালনার সূচকসহ অন্যান্য সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান আরো উন্নত করবে। যা দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আর্কষণে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।
ড. আতিউর রহমান বলেন, করোনো মহামারির কারণে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের অর্থনৈতির গতিধারায় একটি মন্থরভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং এ অবস্থা উত্তরণে একটি টেকসই ও বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে, এটির যথাযথ বস্তবায়ন করা আবশ্যক।
তিনি মনে করেন, বর্তমান সময়ে বেঁচে থাকাই সবচেয়ে বড় চাওয়া। তবে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কীভাবে চাঙ্গা রাখা যায়, সেটার দিকে নজর দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
আতিউর রহমান বলেন, রপ্তানিমুখী পণ্যের বহুমুখীকরণ ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির বিষয়টি এখন বেশ প্রকট হয়েছে এবং এ অবস্থা উত্তরণে বিশেষ করে কৃষি খাত ও এসএমই খাতের উদ্যোক্তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। তিনি বলেন, এসএমইদের সংজ্ঞায়নে বেশ সমস্যা রয়েছে, যা নিরসন করা একান্ত আবশ্যক। তিনি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে ছোট এবং মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা অঞ্চল স্থাপন করার প্রস্তাব করেন। ড. আতিউর রহমান প্রণোদনার টাকা ফেরত দেয়ার সময়সীমা অন্তত দুই বছর বাড়ানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান এবং বিশেষ করে এসএমইদের জন্য প্রণোদনার প্যাকেজে বরাদ্দের পরিমাণ আরো বাড়ানোর প্রস্তাব করেন। এ ছাড়া প্রণোদনা প্যাকেজ বিতরণে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন কাজ করছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণের ওপর জোরারোপ করেন। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে, বাংলাদেশ এলসি ড্যাশবোর্ডের ন্যায় প্রণোদনা প্যাকেজ হতে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ওয়েবসাইটে একটি ড্যাশবোর্ড তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যেটা বাস্তবায়িত হলে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম আরো সফল হবে। তিনি ই-কমার্স ও এফ-কমার্স-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত উদ্যোক্তাদের জন্য নীতিমালা সহজীকরণের মাধ্যমে প্রণোদনা সহযোগিতা প্রদানের আহ্বান জানান।
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ বলেন, দক্ষ মানবসম্পদের জন্য শিক্ষা ও শিল্প ব্যবস্থার সমন্বয় বাড়াতে হবে এবং শিল্প খাতের জন্য কী ধরনের দক্ষ মানবসম্পদের প্রয়োজন, তা নিরূপণ করে দক্ষতা বৃদ্ধিতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শিল্পনীতিতে টেকসই উন্নয়নকে প্রাধান্য দেয়ার পাশাপাশি কোন শিল্প খাতকে কতটা গুরুত্ব দেয়া দরকার, সেটা চিহ্নিত করার প্রস্তাব করেন খলীকুজ্জামান। শিল্পের মালিক ও শ্রমিকদের সম্পর্ক উন্নয়নে একযোগে কাজ করার প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা শিল্পনীতিতে থাকা প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. মো. মাসুদুর রহমান জানান, আমাদের অর্থনীতিতে এসএমই খাতের অবদান প্রায় ২৫%, যেখানে প্রতিবেশী ভারতে এর পরিমাণ প্রায় ৬০% এবং সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এসএমই খাতের উন্নয়নে সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়নের কোনও বিকল্প নেই।
ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ-এর অধ্যাপক ড. মো. আবু ইউসুফ।
মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে টেকসই উন্নয়ন হলেও কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়নি। তিনি বলেন, করোনা মহামারি মোকাবিলায় সরকার কর্তৃক প্রণোদনা প্যাকেজ দেয়ার ফলে দেশের অর্থনীতি ঘুড়ে দাঁড়াতে শুরু করেছে। তবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উদ্যোক্তারা যেন প্যাকেজের সুবিধা পেতে পারেন, তা নিয়ে সকলকে ভাবতে হবে। শিল্পনীতির বাস্তবায়ন পর্যালোচনার জন্য একটি অ্যাকশন প্ল্যান থাকা প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রাম বিভাগের মহাব্যবস্থাপক হোসনে আরা শিখা বলেন, চলতি মূলধন ক্যাটাগরিতে ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক এক লক্ষ ৯০ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রদান করেছে এবং করোনা মেকাবিলায় বেশকিছু নীতি সহায়তা প্রদান করেছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, আগামী এক বছরের মধ্যে প্রণোদনার প্যাকেজের প্রায় ৭৫% উদ্যোক্তাদের মাঝে বিতরণ করা সম্ভব হবে। তিনি জানান, ই-কমার্স ও এফ-কমার্স খাতের উদ্যোক্তাদের অনেকেরই ট্রেড লাইসেন্স নেই, যার ফলে তাদের ঋণ সহায়তা প্রদান করাসম্ভব হচ্ছে না। এমতাবস্থায় এ খাতের উদ্যোক্তাদের ট্রেড লাইসেন্স ব্যতিরেকে ঋণ সহায়তা প্রদান করা যায় কিনা, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
বিল্ডের চেয়ারপারসন ও ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান মনে করেন, শিল্পনীতিতে সকল খাতকে সুনির্দিষ্টভাবে গুরুত্ব প্রদান ও সংজ্ঞায়ন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি শিল্পনীতি প্রণয়নে একটি সুনির্দিষ্ট ডাটা বেইজ যেন প্রণয়ন করা হয় বলে মত প্রকাশ করেন।
বিসিকের চেয়ারম্যান মো. মোস্তাক হাসান বলেন, বর্তমানে বিসিকের ২ হাজার একর জমিতে ৭৬টি শিল্প পার্ক রয়েছে, যেখানে ৮ লাখ ৫০ হাজার লোক কাজ করেন। তিনি জানান, ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ হাজার একর জমিতে বিসিক ১০০টি শিল্প পার্ক স্থাপন করবে, যেখানে ২ কোটি লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।