ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটার ঘর ছুঁতেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠল ২০২০'র কুশপুতুল। পার্ক স্ট্রিটের বর্ষবরণের রাতের আলো ম্লান হল এই লেলিহান শিখায়। পুড়ে ছাই হল কি ফেলে আসা বছরের নিরাশা, হতাশা, প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা? কোভিড ভাইরাস এর দাপট? বাংলা করোনার প্রথম চেহারা দেখে সেই কবে এক স্বাস্থ্য আধিকারিকের ছেলে যখন করোনার বীজ নিয়ে মহানগরী কলকাতায় পৌছায়। এরপর তো ইতিহাস। এক থেকে হাজার, হাজার থেকে লক্ষ, লক্ষ থেকে কোটি। গোটা ভারতেই ছড়িয়ে পরে করোনা। সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শুরু হয় মৃত্যুমিছিল। প্রিয়জন চলে যান, বিদ্দ্বজন চলে যান।
শুরু হয় লকডাউন। জীবনযাপন দুর্বিষহ হয় এই বাংলায়, ভারতে। আর দুর্ভোগ তো কখনও একা আসেনা। এই বঙ্গে আছড়ে পড়ে মেগা সাইক্লোন আমফান। প্রবল ঝড় মুহূর্তের জন্যে ভুলিয়ে দেয় কালান্তক করোনাকেও। বহু মানুষ গৃহহীন হয়, আহত হয় বহু। মৃত্যুর নিরিখে আমফান করোনার কাছে কুড়ি গোল খেলেও বিদ্যুৎহীন জলহীন জীবন দুর্বিষহ ছিল বাংলার। আমফানের রেশ কাটতে না কাটতেই বঙ্গে বেজে উঠল ভোটের বাজনা। একুশে নির্বাচন বাংলায়। দশ বছরের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস এই প্রথম চ্যালেঞ্জ এ পড়ল। নতুন শক্তি হিসেবে বিজেপির আত্মপ্রকাশ এই ফেলে আসা বছরেই। ততদিনে বাংলা সহ ভারতের অর্থনীতি বিপন্ন। কাজ হারালেন, ওয়েজ কাট এর সম্মুখীন হলেন অনেকে। বাদ গেলোনা মিডিয়াও। ভারত সহ বাংলার সংবাদমাধ্যমের বহু মানুষের চাকরি গেল। ঘরবন্দি মানুষের তখন একমাত্র অবলম্বন টেলিভিশন এর খবর আর বিনোদন। ডিজিটাল মিডিয়ার প্রতি আকর্ষণ বাড়লো। নামী সংবাদপত্র গুলোও মন দিল ডিজিট্যাল সংস্করণে। করোনা আমূল পরিবর্তন আনলো সংবাদ মাধ্যমেও। বাংলায় তখন রাজনৈতিক সংঘাতের বাতাবরণ। তৃণমূলের হেভিওয়েট দলছুট হয়ে বিজেপিতে। দিল্লিতেও তাই। বছরের গোড়ার দিকে নাগরিকত্ব বিল নিয়ে দিল্লি দেখেছে ভয়াবহ দাঙ্গা। নিহত হয়েছে পঞ্চাশ জন, আহত দুশো। মুম্বাইয়ের পালঘরে তিন সন্ন্যাসীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, চোদ্দ জুন বলিউড তারকা সুশান্ত সিং রাজপুতের অস্বাভাবিক মৃত্যু দেশে ঝড় তুললো, পনেরো জুন লাদাখে চিনা সেনারা হত্যা করল কুড়ি ভারতীয় সেনাকে, অযোধ্যায় বহু প্রতীক্ষিত রামমন্দিরের শিল্যান্যাস করলেন প্রধানমন্ত্রী, হাতরাসে দলিত রমণীর ধর্ষণে গোটা দেশ গর্জে উঠল, বছরের শেষদিকে কৃষি বিল প্রত্যাহারের দাবিতে কৃষকদের গণ আন্দোলনে মুখরিত দিল্লি। এরই মধ্যে কোভিড আক্রমণে ভারত বিশ্বে দ্বিতীয়, আমেরিকার পরেই।
নৈরাশ্য আর যন্ত্রনাবিধুর এইরকম বছর দেখেনি বাংলা, দেখেনি ভারত। দুহাজার বিশ সত্যিই যেন বিষ এর স্বাদ এনে দিল। তবু, কখনও কখনও অমৃত আসে বিষের পাত্রে। যখন দেখি এই দুহাজার কুড়িতেই মুম্বাইয়ের সবজি বিক্রেতার পসরা যখন নিদারুন বৃষ্টিতে ধংস হয়ে যায়, সবজি বিক্রেতার চোখের জল আর বৃষ্টি একাকার হয়ে যায়, তখন ফেসবুকে সেই ছবি দেখে ভারতীয়রাই এগিয়ে এসে চাঁদা তুলে দু লক্ষ টাকা দান করেন ওই সবজি বিক্রেতাকে। কিংবা দিল্লির বাবা কে ধাবার মালিক সেই বৃদ্ধ করোনার কারণে যখন ধাবা বন্ধ করে নিরন্ন দিন কাটাচ্ছেন, তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় এই খবর দেখে এগিয়ে আসেন নেটিজেনরা। তাঁদের সাহায্য নিয়ে বাবা কি ধাবা এখন রমরমা করে চলছে দিল্লির মালব্যনগরে, দাপটের সঙ্গে। এগুলোতো এই দুহাজার কুড়িরই ফসল। তাই, দুহাজার একুশের অঙ্গীকার, এগিয়ে চলার। গরল ভুলে অমৃতকুম্ভের সন্ধানে যাত্রা শুরু হল.... চরৈবতি !