বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের ২০০ বছরের পুরনো চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি থানার রহমতগঞ্জের এলাকার স্মৃতি বিজড়িত ভবন ভাঙার বিষয়ে স্থিতাবস্থাসহ রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। আদালতের এই আদেশের ফলে আপাতত বাড়িটি যে অবস্থায় আছে, ঠিক সে অবস্থাতেই থাকবে। অর্থাৎ পুরনো এই ভবনটি আপাতত ভাঙতে পারবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা। গতকাল বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এ ছাড়া, আদালত প্রাচীন পুরাকীর্তির এ ঐতিহাসিক যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ভবন বর্তমানে শিশুবাগ স্কুল ভবন রক্ষায় বিবাদীদের ব্যর্থতা কেন অবৈধ হবে না এবং ওই ভবন পুরাকীর্তির তালিকায় কেন অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশনা দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে চার সপ্তাহের রুল জারি করেছেন।
আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজিম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়। পরে রিটকারী আইনজীবী এডভোকেট এম. মাসুদ আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, আদালত রুল জারি করে ভবনটির দখল ও অবস্থানের ওপর এক মাসের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
একইসঙ্গে, প্রাচীন পুরাকীর্তির ঐতিহাসিক যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ভবন রক্ষায় বিবাদীদের ব্যর্থতা কেন অবৈধ হবে না এবং ওই ভবন পুরাকীর্তির তালিকায় কেন অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশনা দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনারসহ ছয় বিবাদীকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ৮ই ফেব্রুয়ারি মামলাটি (কজলিস্ট) কার্যতালিকায় থাকবে।
এর আগে, গত ৫ই জানুয়ারি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন সংযুক্ত করে রিট আবেদন করা হয়। রিটে সংস্কৃতি সচিব, প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনারসহ ছয়জনকে বিবাদী করা হয়। প্রতিবেদনে স্থানীয়দের দাবি, স্কুলটি বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি। যা ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। ভারতীয় কংগ্রেসের নেতা যাত্রামোহন সেনগুপ্ত এই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। চট্টগ্রামের এই আইনজীবীর ছেলে হলেন দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত। ব্যারিস্টার যতীন্দ্রমোহনও ছিলেন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের নেতা। তিনি কলকাতার মেয়রও হয়েছিলেন। ইংরেজ স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তাকে নিয়ে কিছুদিন ভবনটিতে ছিলেন তিনি। মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র বসু, শরৎ বসু, মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীসহ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন সময় এই বাড়িতে এসেছিলেন। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবীরাও এই বাড়ির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সূর্য সেন, অনন্ত সিংহ, অম্বিকা চক্রবর্তীর হয়ে মামলা লড়েছিলেন যতীন্দ্রমোহন। এতে বৃটিশ শাসকদের রোষানলে পড়ে ১৯৩৩ সালে কারাগারে মৃত্যু হয়েছিল যতীন্দ্রমোহনের। এরপর নেলী সেনগুপ্তা ১৯৭০ সাল পর্যন্ত রহমতগঞ্জের বাড়িটিতে ছিলেন। ১৯ গ-া এক কড়া পরিমাণ জমিটি পরে শত্রু সম্পত্তি ঘোষিত হয়। এরপর জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে শামসুদ্দিন মো. ইছহাক নামে এক ব্যক্তি জমিটি লিজ বা ইজারা নিয়ে ‘বাংলা কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন সেখানে। পরে নাম বদলে সেই ভবনে ‘শিশুবাগ স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইছহাকের সন্তানরা স্কুলটি পরিচালনা করছেন। প্লে থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বর্তমানে প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী স্কুলটিতে অধ্যয়ন করছে বলে জানিয়েছেন শিশুবাগ স্কুলের পরিচালক আবু নাসের টিপু। কর্মরত শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ২০ জন বলেও জানান তিনি। গত ৪ঠা জানুয়ারি দুপুরে ভবন ভাঙাকালীন দুই পক্ষকে মুখোমুখি অবস্থান নিতে দেখা যায়। পরে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট রানা দাশগুপ্তসহ বিভিন্ন জনের হস্তক্ষেপে ভবন ভাঙা স্থগিত রাখা হয়। যদিও এর আগেই স্কুলের বেঞ্চ-টেবিলসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি বের করে ভবনের উপরের একাংশ বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। দুপুরের পর থেকে ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।