সকাল সাড়ে ৯টা। রাজধানীর উত্তর বাড্ডা ফুট ওভারব্রিজের নিচে আকাশ এন্টারপ্রাইজের একটি যাত্রীবাহী বাস বাঁকা অবস্থায় দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলছে। এর পেছনে ভিক্টর, রইস, বৈশাখী, রাইদা ও উইনারসহ বেশকিছু বাস হর্ন বাজাচ্ছে। তাতেও কর্ণপাত করেননি আকাশের চালক। প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে এক জায়গায় অবস্থানের ফলে পেছন থেকে আসা সব যানবাহনের জট বেঁধে যায়। কিছুক্ষণ পর ট্রাফিক পুলিশের হস্তক্ষেপে সেখান থেকে সরে যায় আকাশ এন্টারপ্রাইজের বাসটি। কয়েকশ’ গজ দূরে গিয়ে আবারো যাত্রীর জন্য দাঁড়াতে দেখা যায়। যে দুই স্থানে বাসটি দাঁড়িয়েছে এর কোনোটি উত্তর বাড্ডার নির্ধারিত বাস স্ট্যান্ড নয়।
সকাল ১০টায় রামপুরা ব্রিজের গোড়ায় বাস স্টপে গিয়ে দেখা মিললো একই চিত্র। এটি আরো ভয়াবহ। ব্রিজ থেকে নামলেই পথচারী পারাপারের জন্য নির্ধারিত জেব্রা ক্রসিং। আর তার ওপরই বাসগুলো এসে দাঁড়িয়ে আছে। একাধিক পথচারী প্রায় পাঁচ মিনিট অপেক্ষার পর রাস্তা পার হতে পারছেন না। দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক পুলিশ এসে বারবার বলা সত্ত্বেও ওই স্থানটি ছাড়েনি বাসচালক। যাত্রী ওঠানোর জন্য আঁকাবাঁকা অবস্থায় একেকটি বাস একেকভাবে দাঁড়িয়ে থাকে।
এই চিত্র শুধু বাড্ডা রামপুরায়ই নয়। ঢাকা শহরের প্রায় সবক’টি সড়কেই টালমাটাল অবস্থা। যত্রতত্র দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করা, প্রতিযোগিতা করাসহ নানা অনিয়ম রাজধানীর সড়কে চলছেই। শুধু ঢাকাতেই নয়। সারা দেশের সড়ক মহাসড়কে চলছে এমন অস্থিরতা। ফলে দুর্ঘটনাও বাড়ছে ব্যাপক হারে। সে সঙ্গে সড়কে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।
সরজমিন দেখা যায়, রাজধানীর কোনো ট্রাফিক পয়েন্টেই আইন মানার বালাই নেই। যেখানেই যাত্রী হাত তুলছে সেখানেই বাস থামিয়ে ওঠানো হচ্ছে। নির্ধারিত স্থানে বাস থামানোর কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। এমনকি বেপরোয়া গতিতে এক বাস অন্য বাসকে টপকে সামনে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। কিছু কিছু জায়গায় দেখা গেছে দুই বাসের পাল্লা দেয়ার কারণে একটি অপরটির সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। এ নিয়ে বাসের ভেতর থাকা যাত্রীরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।
রাজধানীর কাকরাইলের ট্রাফিক সিগন্যাল অতিক্রম করলেই বাস স্টপেজ। নিয়ম অনুযায়ী রামপুরা বাড্ডাগামী বাসগুলো সেখানেই থামার কথা। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশ থাকা সত্ত্বেও নির্ধারিত স্থানের বাইরে বাসগুলো থামতে দেখা গেছে। একই চিত্র শাহবাগ এলাকায় গিয়েও দেখা মেলে। সড়কের মাঝ বরাবর এলোপাতাড়ি বাসগুলো দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলছে। পেছন থেকে আসা অন্য যানবাহনগুলো আটকে আছে। এ ছাড়া মানিকনগর, সায়েদাবাদ, খিলগাঁও, মালিবাগ, চৌধুরীপাড়াসহ একাধিক স্থানে ঘুরে এমন অনিয়ম লক্ষ্য করা গেছে। সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে দীর্ঘদিন ধরেই নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ২০১৮ সালের ২৯শে জুলাই রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থীর বাস চাপায় মৃত্যুর ঘটনায় সড়ক নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছিল দেশ। সারা দেশের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে। কিন্তু এরপরও টনক নড়েনি। অবশ্য সে বছরই সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ পাস হয়। এরইমধ্যে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালের শিক্ষার্থী আবরারের মৃত্যুর ঘটনায় আবারো শিক্ষার্থীরা সড়কে নামেন। সে সময় সরকারের দেয়া নানা আশ্বাস বাস্তবে প্রতিফলন হতে দেখা যায়নি। সে বছর নভেম্বর মাসে নতুন সড়ক আইনটির কার্যকর ঘোষণা করে সরকার। কিন্তু প্রস্তুতির অভাবে আইন প্রয়োগ করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অন্যদিকে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর চাপের মুখে কিছুদিন স্থগিত করা হয় আইন প্রয়োগের কার্যক্রম। এরপর ২০২০ সাল কেটে গেল করোনাতেই। ভাইরাস সংক্রমণের কারণে মার্চ থেকে ৬৬ দিন যান চলাচল বন্ধই থাকে। পরবর্তীতে সড়কে আবার যানবাহন নামলেও আইনের কোনো প্রয়োগ দেখা যায়নি। ঢাকার সড়কে আগের চিত্রই স্বরূপে ফিরে এসেছে। এর পাশাপাশি মহাসড়কেও চলে মৃত্যুর মিছিল।
বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বরে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪০২টি। তাতে মৃত্যু হয়েছে ৪৬৪ জনের। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, এককভাবে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বেশি প্রাণহানি ঘটেছে। ১৩৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৪৭ জন, যা মোট নিহতের ৩১.৬৮ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৪.৩২ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১২৮ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ২৭.৫৮ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৪৪ জন, অর্থাৎ ৯.৪৮ শতাংশ। এই সময়ে ৫টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১৭ জন নিহত হয়েছেন। ১২টি রেলপথ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৯ জন, আহত ৪ জন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১২৪টি জাতীয় মহাসড়কে, ১২৯টি আঞ্চলিক সড়কে, ১০৪টি গ্রামীণ সড়কে, ৪২টি শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে (ফেরিঘাট, নদীর তীর) তিনটি সংঘটিত হয়েছে।
সড়কে মৃত্যুর মিছিল বৃদ্ধি ও শৃঙ্খলা না ফেরার পেছনে সরকারের আন্তরিকতার অভাব বলে মনে করছেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি মানবজমিনকে বলেন, আইনের সঠিক প্রয়োগ না হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না। মৃত্যুর মিছিলও থামবে না। এক্ষেত্রে পরিবহন মালিক শ্রমিকদেরও সহযোগিতা করতে হবে। তিনি আরো বলেন, সরকার আইন পাস করেছে। ১১১ দফা সুপারিশ প্রণয়ন করেছে। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। তাতে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে কি করে। আইনের কঠোর প্রয়োগ প্রয়োজন বলেও মনে করেন মোজাম্মেল হক চৌধুরী।