× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার , ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৪ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

বাঙালনামা

মত-মতান্তর

ড. শরীফ আস্‌-সাবের
১৫ জানুয়ারি ২০২১, শুক্রবার

আমরা বাঙাল! বড়াই করাটাই আমদের স্বভাব। আমাদের ধারণ করিয়া পৃথিবী ধন্য হইয়াছে, ধন্য হইয়াছে মানবকুল! কারণ, আমরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্তান। আমরা বুদ্ধির ঢেঁকি এবং বিশ্বসংসারে আমাদের সমকক্ষ কেহই নাই।

আমরা অন্যের প্রশংসা করি না, কারন উহারা প্রশংসার যোগ্য নহে। বরঞ্চ, অন্যরা আমাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হইবে এবং উহাতে আমরা সন্তুষ্টচিত্তে হাত নাড়াইয়া কেতাদুরস্ত কায়দায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিব, ইহাই আমাদের একান্ত মনোবাঞ্ছা।  

শিক্ষা? কাহার কাছে শিখিব? আমরা তো সবজান্তা হইয়াই ধরায় ভুমিস্ট হইয়াছি। লজ্জা? লজ্জা তো মূর্খ, অপগন্ডের ভূষণ! উহা আমাদের মজ্জায় নাই! আমরা সবকিছুতেই প্রথম! দ্বিতীয় স্থান আমাদিগের জন্য নিতান্তই বেমানান। ইহা অর্জন করিবার মানসে আমরা ভালো মন্দ, ঠিক বেঠিক কিংবা ন্যায় অন্যায়ের তোয়াক্কা করি না এবং অন্যরা শত দোষে আমাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করিলেও আমরা উহাদের ধার ধারি না।

আমরা কখনো মিথ্যা বলি না, কারন মিথ্যাকে সত্যিতে পরিনত করিবার পদ্ধতি আমরা বেশ ভালো করিয়াই রপ্ত করিয়াছি। আমাদের এই জাতীয় সদাচরণ অপরের মনোবেদনার কারণ হইলে আমরা কীইবা করিতে পারি - নিজের কষ্টে আমাদের কষ্ট হইলেও অপরের অহেতুক কষ্টকে তো আমরা কষ্ট বলিয়া গণ্য করিতে পারি না!  

আমরা বাঙাল, কাঙ্গাল নহি! আমরা আপন অবস্থান এবং মর্যাদা কোন ভাবেই ক্ষুন্ন হইতে দেই না।
তাই আমরা নিজেদের দারিদ্র জাহির করিয়া অপরের করুণা ভিক্ষা করি না। আমাদেরই এক পূর্বসূরি মহাবাঙাল মরহুম এক লাটসাহেব এই প্রসঙ্গে এক সময় বলিয়াছিলেন, ‘ভাত না মিলিলে তোমরা তো পোলাও খাইতে পারো’! তাই আমরা প্রয়োজন হইলে হাতে ঘিয়ের গন্ধ মাখিয়া খালি পেটে পোলাও বিরিয়ানি খাইবার গল্প বলিতে বলিতে তৃপ্তির ঢেঁকুর পর্যন্ত তুলিতে পারি।    

আমরা সকলেই মনে মনে আঙ্গুল ফুলিয়া কলা গাছ হইবার খায়েস পোষণ করি। তবে চোখের উপর অন্য কাহারও আয় উন্নতি আমাদের সহ্য হয় না – একেবারে মাথা খারাপ করিয়া দেয়। তাই, আমরা নিজের নাক কাটিয়া পরের যাত্রা ভঙ্গে পিছপা হই না। ইদানিং ইহাতে তেমন কাজ হইতেছে  না - নিজের নাক কর্তিত হইতেছে ঠিকই, কিন্তু অপরের যাত্রায় অগ্রগতি তেমন থামিতেছে না। তাহাতে কি? আমাদের বাঙাল চরিত্র তো তাই বলিয়া জলাঞ্জলি দেওয়া যাইবে না?

আমরা বুদ্ধির ঢেঁকি। নিজের বুদ্ধি আমরা অপরের কাছে বন্ধক দিয়াছি আর অপরের বুদ্ধি ধার করিয়া আমরা বাবুয়ানা হালে চলাফেরা করি। ইহাতে সুবিধা হইল, আমাদের বুদ্ধিটা বাঁচিয়া গেল, খরচ হইল না! সেই ক্ষেত্রে, পরের বুদ্ধিতে কাজ করিবার ফলাফল ভাল না হইলে সহজেই নন্দ ঘোষের উপর উহার দায় দায়িত্ব, দোষ ত্রুটি চাপাইয়া দেওয়ার সুযোগটিও বহাল থাকিয়া যায়।

আমরা বিশুদ্ধ বাঙাল। আমরা স্বার্থপর নই, স্বার্থসচেতন। আত্মস্বার্থের বিনিময়ে অপরের কাছে নতি স্বীকার করিতে আমাদের সময় লাগে না - এমন কি দেশ বিকাইয়া দিতেও আমরা দ্বিধান্বিত হই না! মীর জাফর, রায় দুর্লভ তো আমাদেরই লোক ছিলেন! এ বিষয়ে অবশ্য উপরওয়ালাই ভালো জানেন - আমরা কতটুকুই বা করিতে পারি? ইহা ছাড়া, খাল কাটিয়া  কুমির লইয়া আসাটাও আমাদের খান্দানি স্বভাব। ঘরের আঙ্গিনায় কুমিরকে আদর করিয়া নিজ হাতে ছাগল হরিন খাওয়াইব না, ইহা দেখিয়া সবাই হাত তালি দিবে না – তাহাই বা কি করিয়া সম্ভব? বাঙাল হিসাবে প্রবাদকুমীর লালন করিবার গুরুদায়িত্বটি তো আমাদের উপরেই বর্তায়।  

কোথাকার কোন কিসিঞ্জার সাহেব আমদের দেশকে একবার ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলিয়াছিলেন। কত বড় কথা - ধৃষ্টতার একটা সীমা তো থাকা উচিত! আমাদের ঝুড়ির তলা এখন যারপরনাই শক্ত। তবে ঝুড়িখানা বুদ্ধি করিয়া উল্টাইয়া রাখিয়াছি যাহাতে আমাদের কাজ আমরা যথাপূর্ব করিতে পারি এবং দুষ্ট কিসিঞ্জারি সমালোচনা কোন কাজে না লাগে। মোদ্দা কথায়, আমরা অপরের কথায় পরিবর্তন হইতে রাজি নহি। ইহা ছাড়া, কেহ আমাদের সমালোচনা করুক তাহাও আমরা পছন্দ করি না। তবে, অপরের ছিদ্রান্বেষণ করাকে আমরা আমাদের একটি পবিত্র দায়িত্ব বলিয়া জ্ঞান করি। আমরা ভূরিভোজনে সুপক্ক আর পরনিন্দা ভোজনের ইচ্ছাকে সর্বতোভাবে জাগ্রত করে।
আমরা কেহ দলান্ধ, কেহ ধর্মান্ধ, কেহ বা মতান্ধ। ইহার ফলে কষ্ট করিয়া যুক্তির ধার ধারিতে হয় না – কিছু একটা অকাট্য জ্ঞান করিয়া বসিয়া থাকিলেই চলে। তথাকথিত ‘সুসম’, সজ্ঞান’  কিংবা ‘সুষ্ঠু’ চিন্তাধারা শুনি‍য়া সময় নষ্ট করিতে আমরা আগ্রহী নহি। তাই বলিয়া ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ মনে করিয়া আমরা তো হাত পা গুটাইয়া বসিয়াও থকিতে পারি না! আমাদের অবস্থান পাকাপোক্ত এবং যুক্তিযুক্ত করিবার মানসে তাই আমরা ধোপদুরস্ত পোশাকে প্রগতিশীল সাজিয়া নানা বিতর্কে সুবিধামাফিক অংশ লইলেও সর্বশেষে ‘তাল গাছটি আমার’ বলিয়া দাবী করাটাই আমরা যথার্থ মনে করি। তাহা না হইলে বাঙাল হিসাবে আমাদের আভিজাত্য হানির সম্যক সম্ভাবনা বিদ্যমনা থাকে।   

আমরা সময়ের সহিত তাল মিলাইয়া চলিতে পছন্দ করি। সেই সুবাদে, যে কোন ধরনের পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমরা আমদের চেহারা ও লেবাস দ্রুততার সহিত পাল্‌টাইয়া এক শিবির হইতে অন্য শিবিরে চলিয়া যাই। আমদের নিজেদের লেজ না থাকায় এই ভাবেই আমরা অপরের লেজে চড়াও হইয়া লেজুড়বৃত্তি এবং সময় ও সুবিধামাফিক লম্ফ দিয়া লেজ পরিবর্তন করি। এক কথায়, আমাদের খান্দানি উদ্দেশ্য চরতার্থ করিবার মানসে আমরা পৃথিবীর আদি ও অকৃত্রিম ‘যখন যাহার তখন তাহার’ নীতিটি অভিনিবেশ সহকারে পালন করিয়া থাকি।  

বর্তমান সময়ে উৎকোচ, দুর্নীতি, অপরাধ, স্বজনপ্রীতিসহ ইত্যকার বিষয়গুলি সমাজের পরিবর্তন ও উন্নয়নের অপরিহার্য সহযোগী অংশ হইয়া গিয়াছে বিধায় আমরা এই জাতীয় শব্দের উত্তম গুণাবলি ভাবার্থসহ অভিধানে সন্নিবেশিত করিবার একটি মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করিয়াছি। অভিধানে উহাদের নেতিবাচক উপস্থিতি অগ্রহণযোগ্য যাহা অহেতুক জনমনে এই ধরনের উন্নয়নবান্ধব শব্দাবলী সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি করিতেছে।

আমরা অনুকরণপ্রিয়। বহুভাষাবিদ, গুণীজন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলিয়াছিলেন, ‘ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নহে’ আর রোগের প্রাদুর্ভাব না হইলে তো উহার উপশমের চেষ্টা করা যাইবে না - উচ্চমূল্যে রোগ প্রতিষেধক কিংবা ওষুধ আমদানি করিয়া টুপাইস কামাই করা যাইবে না। তাই, যে যাহাই বলুক, ‘আসুক ব্যধি, আসুক জ্বরা/খোদার হাতে বাঁচা মরা’! একই উপদেশ অনুসরণ করিয়া আমরা মহা আনন্দে বলিউড, হলিউড, টালিউড হইতে বাছিয়া বাছিয়া নিকৃষ্ট প্রকৃতির আচরণাদি রপ্ত ও অনুকরণ করিয়া থাকি। সমাজে মন্দ ঘটনা না ঘটিলে আমাদের উত্তরসূরীরা ভাল মন্দের ফারাক কি করিয়া অনুধাবন করিবে? অন্ধকার না থাকিলে আলোর মূল্যইবা তাহারা কিভাবে উপলব্ধি করিবে?

কাজের তুলনায় আমরা কথায় অধিকতর পটু। আমরা ইচ্ছায় অনিচ্ছায়, কারনে অকারণে আত্মস্তুতি গাহিতে পছন্দ করি। গুণীজনেরা কহেন, নিজের ঢোল নিজেকেই পিটাইতে হয়। অপরে পিটাইলে এতো আস্তে পিটাইবে যাহা অন্য কেহ শুনিবে না, কিংবা এতো জোরে পিটাইবে যে ঢোল ফাটিয়া যাইতে পারে! তাই আমরা নিজেদের ঢোল নিজেরাই পিটাইতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। ইহাতে অপরের কান ঝালাপালা হইল কিনা, তাহা আমাদের বিবেচ্য বিষয় নহে।
আমরা যাহা খুশি তাহাই করি। আমরা আইন-কানুন, আদেশ-উপদেশ, বাঁধা-নিষেধ ইত্যাদির উর্ধে থাকিতে পছন্দ করি। কবিগুরু বলিয়াছেন, ‘পদে পদে ছোটো ছোটো নিষেধের ডোরে/বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালো ছেলে করে।’  
আমরা গুরুদেবকে অনুসরন করতঃ অকর্মণ্য ও অকিঞ্চিৎকর ‘ভালো ছেলে’ হইয়া থাকিতে চাহি না, এবং কেহ মানুক আর নাই মানুক, আমরা বিপুল বিক্রমে সকল বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করিয়া আমাদের বাঙাল স্ট্যাটাসটিকে যে কোন মুল্যে সংরক্ষন করিব – ইহা গোটা বিশ্বের কাছে আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার!

বিঃ দ্রঃ পাঠশেষে যাহারা এই অধম প্রণীত ‘বাঙালনামা’র আওতাভুক্ত নহেন বলিয়া মনে করিবেন, তাহারা অনুগ্রহপূর্বক নিজেদেরকে ‘বাঙাল’ বলিয়া দাবি করিবেন না। ইহাতে আমাদের সনাতন বাঙাল সমাজের সম্মান এবং সংহতি ক্ষুণ্ণ হইতে পারে।


লেখক একজন প্রবাসী বাঙাল, শিক্ষক ও সাবেক আমলা
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর