× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার , ৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

রাবেয়া খাতুনের ‘নীল পাহাড়ের কাছাকাছি’ ও পাবর্ত্য চট্টগ্রাম

অনলাইন


(৩ বছর আগে) জানুয়ারি ২০, ২০২১, বুধবার, ৫:৩৪ অপরাহ্ন

সদ্য প্রয়াত দেশ বরেন্য কথা সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন জীবদ্দশায় ৫০টির মতো উপন্যাস লিখেছেন। এর মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত উপন্যাস ‘নীল পাহাড়ের কাছাকাছি’ (১৯৮৫) এক সময়ে পাবর্ত্য চট্টগ্রামে কর্মরত অনেক তরুন সেনা অফিসারদের হৃদয় কতখানি ছুঁয়ে গিয়েছিল এই, লেখাটি তারই সংক্ষিপ্ত ও বিলম্বিত বয়ান।

বাংলাদেশের এক রূপময় খন্ড পাবর্ত্য চট্টগ্রাম। পাহাড়, হ্রদ ও অরন্যের অপরূপ সৌন্দর্য্য, স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্য আর ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি ও বাঙালি অধ্যুষিত এই অঞ্চল আমাদের অনন্য অহংকার। অপরূপ পাবর্ত্য চট্টগ্রাম যে দেখেনি চেনে না সে আমাদের বাংলাদেশের রূপ।
সময়টা ১৯৮৬ সাল। রাঙ্গামাটি জেলার দক্ষিনাঞ্চলে মোতায়েনকৃত একটি পদাতিক ব্যাটালিয়নে কর্মরত আমি। পাবর্ত্য চট্টগ্রামে তখন সবুজ পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বইছে হিংসার প্রবল ঝর্ণাধারা। অনাকাংখিত ও ভ্রাতৃঘাতী এক যুদ্ধে (১৯৭৬) জড়িয়ে পড়েছে সেনাবাহিনীসহ এ অঞ্চলে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনী।
সর্বাত্বক যুদ্ধ না হলেও পাবর্ত্য চট্টগ্রামের জটিল ও সংঘর্ষময় সময় ছিল তখন। বিশেষত খাগড়াছড়ির উত্তরাঞ্চলে।
শান্তিবাহিনীর (পাবর্ত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখা, যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারী) বিরুদ্ধে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী তখন ভিন্নধর্মী এক যুদ্ধে (কাউন্টার ইন্সারজেনসি অপারেশন) নিয়োজিত। এ যুদ্ধের মূলমন্ত্রঃ স্থানীয় অধিবাসীদের হ্রদয় ও মন জয়। সহজ সরল প্রকৃতির সন্তান ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির  সাধারন অধিবাসীগন কখনই আমাদের শত্রু নয়।

ক্যাম্পগুলো থেকেই মূলত অপারেশন পরিচালনা করা হয়। পর্যাপ্ত পানি, বিদ্যুৎ আর যোগাযোগহীন বিচ্ছিন্ন ক্যাম্পগুলোতে সৈনিক ও অফিসারদের জীবন তখন খুব কঠিন। বিশেষত তরুন অফিসারদের কাছে শান্তিবাহিনীর মতোই আরও দুটি প্রধান শত্রু হলোঃ নিঃসঙ্গতা ও এনোফিলিস মশা (ম্যালেরিয়া)।
বারুদের গন্ধ মাখা সেই জীবনে, হঠাৎ একটি বই আমার মতো অনেক তরুন সেনা কর্মকর্তাদের হৃদয় ছুঁয়ে গেল। রাবেয়া খাতুনের লেখা উপন্যাস ‘নীল পাহাড়ের কাছাকাছি’। প্রকাশিত হয় আগষ্ট ১৯৮৫।
মাত্র ৪৫ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি দূগর্ম এক ক্যাম্পে কর্মরত একজন তরুন সেনা অফিসার (ওমর খালেদ) ও তার বাঙালি গায়িকা বান্ধবীর (মিমোসা) হৃদয় ঘটিত সম্পর্ক নিয়ে লেখা। সময়টা ১৯৮০ দশকের প্রথম দিক। ক্যাম্পের চরম নিঃসঙ্গ জীবনে ওমর খালেদের প্রিয়তম সঙ্গী হলো রেডিও। একদিন ওমর খালেদ ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত গায়িকা মিমোসার গান শুনে মুগ্দ্ধ  হন। অতপর একদিন ওমর খালেদ অপরিচিত সেই গায়িকাকে চিঠি দিলেন ঢাকা বেতার ভবনের প্রযতেœ। আভিযানিক দায়িত্বে এসএমজি কাঁধে পাহাড় অরন্যে ছুটে ফেরা ওমর খালেদ একদিন প্রায় অপ্রত্যাশিতভাবে একটি চিঠি পেলেন। ....’আমার দেশের এক সৈনিক আমার গান শুনে কিছুক্ষনের জন্য হলেও শান্তি পেয়েছেন একথা জেনে কি খুশী যে লাগছে.. মিমোসা’। এভাবেই অসংখ্য চিঠির বিনিময়ে তাদের মধ্যে তুমুল এক বন্ধুত্বময় সম্পর্ক গড়ে উঠলো।

একবার গায়িকা মিমোসা কক্সবাজারে গানের অনুষ্ঠান শেষে রাঙ্গামাটি এলেন। তার সঙ্গে দেখা করতে ক্যাম্প থেকে ছুটে আসেন ওমর খালেদ। বেসামরিক পোষাকে বান্ধবীকে নিয়ে ছুটলেন নীল গিরি পাহাড়ে। (উপন্যাসের এই অংশটি অবশ্য একেবারেই অবাস্তব)। রাঙ্গামাটির বিশাল ও অপরুপ হ্রদ পেরিয়ে স্পীডবোটে  ছুটলেন দুই তরুন তরুনী। এক অসাধান রোমান্সের মধ্য দিয়ে তাদের বোটটি এগিয়ে যেতে থাকে।

উপন্যাসের এই অংশে আবেগ ও রোমান্টিকতার বন্যা বয়ে যায়। মনে পড়ে গার্সিয়া মার্কেজের ‘লাভ ইন টাইম অব কলেরা’ এর কথা। প্রেমিক ফ্লোরেন্টিনো আর প্রেমিকা ফারমিনা জাহাজে চড়ে এক রোমান্টিক ভ্রমনে চলেছেন সূদুর লা ডোরাডায়। এর শেষ দৃশ্যটি অবশ্য ট্রাজেডির। অসাধারন সৌন্দর্য্যময় স্থানের মধ্য দিয়ে ছুটছে স্পীডবোট। দুই পাশেই পাহাড়। হঠাৎ শান্তি বাহিনীর একটি দলের গুলিতে (অ্যামবুশে) নিহত হলেন ওমর খালেদ।  উপন্যাসটি শেষ হয়েছে এভাবে। .....‘ আমারও (মিমোসা) আর যাওয়া হয়নি নীল পাহাড়ের কাছাকাছি। সে আর তুমি কবে থেকে এক হয়ে গেছো। যে তুমি আনন্দ ও বেদনার।’

রাবেয়া খাতুনের অন্য প্রেমের গল্পের মতে এটিও যেন এক দীপ্তিময় হীরক খন্ড। মিষ্টি প্রেমের ছোট উপন্যাস। কিন্তু এর মধ্যেই পাবর্ত্য চট্টগ্রামের জটিল সমস্যার  একটি বিরল বস্তুনিষ্ঠ একটি বয়ান পাঠক পেয়ে যায়। এখানে আমরা পাই, ...তরুন অফিসার ওমর খালেদের কঠিন ক্যাম্প জীবন, ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধে সেনা সদস্যদের ভাবনা, রনাঙ্গনে সহযোদ্ধাদের হারানোর বেদনা, নদী ভাঙ্গা গৃহহারা সহায় সম্বলহীন বাঙালীদের জীবন সংগ্রাম। অন্যদিকে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির অধিবাসীদের সংগ্রাম মুখর কষ্টকর জীবন, কাপ্তাই বাঁধের (১৯৫৭-১৯৬২) ফলে লক্ষ বাঁধভাসি মানুষের দুর্দশা ও আহাজারি। অধিকার আদায়ের নামে পাহাড়ের শত শত তরুনদের সশস্ত্র আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন...।

ব্যাটালিয়ন হেডকোর্য়াটারের তরুনরা বইটি পড়ার পর টহলের মাধ্যমে (পিঠের হ্যাভার স্যাকে) সেটি পৌছেঁ গেল অন্য ক্যাম্পে। এরপর স্পীডবোটে, কখনো লঞ্চে চলে গেল পাশ্ববর্তী ব্যাটালিয়নে বা জোনে। একবার রীতিমতো হেলিকপ্টারে চড়ে জনপ্রিয় কিতাবটি পৌঁছালো কালো পাহাড়ে অবস্থিত এক দূর্গম হেলিসার্পোটেড ক্যাম্পে।

শান্তিবাহিনীর ভয়ংকর অ্যাম্বুস, রেইড এবং ক্যাম্পের কঠিন জীবন নিয়ে মনোকষ্ট ও হতাশার কোন সুযোগ ছিলনা আমার মতো তরুন সেনা অফিসারদের। বাংলাদেশের অখন্ডতা রক্ষাই আমাদের ব্রত। এর জন্য যে কোন স্থানে, যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য আমরা প্রস্তুত। তবুও রনাঙ্গনের সৈনিকদের মধ্যে একটা চাপা অভিমান থাকে, কারন যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের আত্মত্যাগ নিয়ে খুব কমই লেখা হয় বা প্রচার পায়। এ বিষয়ে অনেক পরে (১৯৯৭) লেখক হুমায়ুন আজাদ লিখবেন- ‘শান্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে জিতেছে সেনাবাহিনী এবং হেরেছে প্রচারে।’

রাবেয়া খাতুনের এই উপন্যাসে একজন তরুন অফিসারের নিঃসঙ্গ ও কষ্টকর জীবন এবং ভাবনার কথা উঠে এসেছে। তাই রনাঙ্গনের তরুনদের হৃদয় জয় করে বইটি হয়ে ওঠে তাদের জীবনের নিজস্ব বয়ান ও কন্ঠস্বর। আমরা যেন হয়ে উঠি, এক এক জন ওমর খালেদ। আর নিজেদের ব্যক্তিগত আরাধ্য মিমোসাদের নিয়ে নিয়ত কল্পনায় ভাসি অলৌকিক যানে। কারো কারো চিঠিতে আবেগ বয়ে যায় সুবলংয়ের ঝর্ণাধারা মতো ।

উপন্যাসের একটি স্থানে লেখক অনেক তরুন অফিসারের মনের ভাবনাটাই যেন তুলে ধরেছেন। ‘....আমি ও আমরা এই ভাঙন রোধ করার জন্য মাথা খাটাই। হৃদয় দিয়ে স্পর্শ করতে চাই। কোথেকে আসবে এই দুঃখ দুদর্শা দূর করার বাস্তব স্থায়ী সমাধান ...’। এখানে উল্লেখ্য, পাবর্ত্য চট্টগ্রামের এই রক্তাক্ত সংঘাতের পটভূমিতে লেখা এটিই সম্ভবত প্রথম উপন্যাস।

বিষয়োক্ত উপন্যাসটি নিয়ে এত আয়োজনের মধ্যেই (১৯৮৬) আমাদের ব্যাটালিয়নে ডিভিশনের সম্মানিত জিওসি (জেনারেল অফিসার কমান্ডিং) মহোদয়ের ভিজিট কর্মসূচী ঘোষিত হলো। একদিন জিওসি এলেন স্বপরিবারে। ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে ফর্মাল ভিজিটের পর একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। অনুষ্ঠানের নাম রাখা হয়েছিলো- নীল পাহাড়ের কাছাকাছি। স্থানীয় শিল্পীরা চমৎকারভাবে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তুলে ধরলেন। র‌্যাংখিয়াং নদী তীরের একজন তরুনী সেই সময়ের জনপ্রিয় একটি পাহাড়ের গান গেয়েছিল- ‘উত্তোন পেঘে মেঘে মেঘে....’।

অনুষ্ঠান শেষে পিন পতন নীরবতা। জিওসির কড়া ভিজিটে ততোক্ষনে তটস্থ সবাই। জিওসি মহোদয়ের মন্তব্য এর জন্য আমরা অপেক্ষমান। জিওসি বললেন- ‘তোমাদের অনুষ্ঠানটা খুব সুন্দর হয়েছে। নামটাও খুব সুন্দর। এরপর স্বভাবশুলভ ভঙ্গিতে বললেন- ‘লেফটেন্যান্ট, বলোতো হে, পাহাড় কি কখনো নীল হয়? জিওসির বিরল প্রশংসায় আমাদের বুক থেকে ভারী পাথরটি যেন নেমে গেল।
যে বই নিয়ে এতো উত্তেজনা ও চাঞ্চল্য তার লেখককে এইসব কথা কিভাবে যে জানাই? এর কয়েক বছর পর (১৯৯১) উপন্যাসিক রাবেয়া খাতুনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তখন তিনি থাকতেন বাংলা মোটর সংলগ্ন নিউ ইস্কাটন রোডের একটি বাসায়।

বইটি আমাদের এতো ভাল লেগেছে, জেনে খুব খুশী হলেন রাবেয়া খাতুন। নিস্পাপ ভঙ্গিতে তাকে জিঞ্জাসা করলাম- খালাম্মা, দূর্গম পাহাড়ী এলাকায় না যেয়ে কিভাবে লিখলেন এরকম উপন্যাস? তিনি বললেন- ‘পাহাড়ে যুদ্ধ বন্ধ হলে, রাঙ্গামাটি, সাজেক, সুবলং ও মারিশ্যা যাওয়ার খুব ইচ্ছে আমার’। স্মিত হেসে আমাকে শেষে বলেছিলেন- ‘তোমাদের অনুষ্ঠানের ছবিটা পারলে আমাকে দিও।’
এরপর কতদিন কেটে গেল। বিভিন্ন সময়ে দীর্ঘদিন ধরে শান্তি প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। অবশেষে, ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর তারিখে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে দুঃখজনকভাবে এখনো পাহাড়ে রক্ত ঝরছে। তবে আমি আশাবাদী পাহাড়ে একদিন প্রার্থিত শান্তি ফিরে আসবেই। আমরা একত্রে পথ চলবো সবাইকে নিয়ে।

আমার আর জানা হয়নি, পরবর্তীতে রাবেয়া খাতুন কখনো সুবলং, সাজেক ও মারিশ্যা বেড়াতে গিয়েছিলেন কিনা। আমার এ্যালবামে রাখা সেই অনুষ্ঠানের ছবিগুলো অস্পষ্ট ও ঝাপসা হয়ে যাওয়ায় তাকে ছবিটিও আর দেয়া হয়নি। রাবেয়া খাতুনের মৃত্যুর পর হঠাৎ জানতে পারলাম, সেই সময়ের একজন সহযোদ্ধার  কাছে একটা ছবি এখনও সুরক্ষিত আছে। মূহুর্তেই মোবাইলের হোয়াটসএ্যাপে আমার কাছে ছবিটি চলে এলো। ছবিটির দিকে তাকালাম। একটা মঞ্চের মাঝখানে অনুষ্ঠানের নামটি লেখা- ‘নীল পাহাড়ের কাছাকাছি’। কত বছর আগের ছবি। কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। তবুও বোঝা যায়। মনে পড়লো পাহাড়ের দিনগুলোর কথা, পাহাড়ে আমাদের সহজ সরল দরিদ্র মানুষদের কথা। ছবিটি এখন আমার মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে। কিন্তু রাবেয়া খাতুন খালাম্মার  কাছে ছবিটি পাঠাই আমি কোন ঠিকানায়?

লেখকঃ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ বায়েজিদ সরোয়ার, এনডিসি (অবঃ)
[email protected]
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর