‘কেষ্টর কাকিমা কুসুমকলি, কঠিন কণ্ঠে কাঁদতে কাঁদতে, কনফারেন্সের কবিদের কইলেন, কবিগণ কর্ণপাত করুন, কর্ণপাত করুন কবিগণ, কেষ্ট কথা কইবেনা, কুপোকাত করেছে কেষ্ট, কেষ্ট কুপোকাত করেছে, কেষ্ট করুণাময়ীর কাছে কাল কাটাচ্ছে, করুণাময়ীর কাছে কাল কাটালে, কেউ কখনো কথা কয় না’- ‘ক’ বর্ণ দিয়ে তৈরি সব শব্দেই এগিয়েছে গল্প। ২৭ হাজার এমন শব্দে রচিত ৩টি বই। ‘ক’ দিয়ে তৈরি শব্দের খোঁজে লেখক ব্যতিব্যস্ত ছিলেন ২০ বছর। বিভিন্ন পাঠাগারে গিয়েছেন, নানা রকম বই-পুস্তক পড়ে ‘ক’ বর্ণ দিয়ে তৈরি প্রায় আড়াই লাখ শব্দ সংগ্রহ করেছেন। গল্পের শেষে প্রধান চরিত্রের মৃত্যু হবে। কিন্তু ‘ক’ দিয়ে এ রকম কোনো শব্দ মেলাতে পারছিলেন না। এর সমার্থক একটি শব্দ খুঁজেছেন ৮ মাস। সংসার ভেঙেছে এ কারণেই তার।
আরো নানা প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হন। কিন্তু হাল ছাড়েন নি। অবশেষে সফল হয়েছেন ভিন্ন মাত্রার এক বই রচনায়। অভিনব এ বইয়ের উদ্ভাবক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের এস,এম নাজমুল কবির ইকবাল। ছদ্মনাম ইসমোনাক। ২০১০ সালে বের হয় ইসমোনাকের প্রথম বই ‘কেষ্ট কবির কষ্টগুলো’। ‘ক’ বর্ণের সাত হাজার শব্দ দিয়ে লিখেছেন তিনি এই বইটি। এরপর ২০১৩ সালে ‘কেষ্ট কবির কনফারেন্স’। এটিও ‘ক’ বর্ণের ১০ হাজার শব্দে সাজানো। সর্বশেষ ২০১৬ সালে ‘ক’ বর্ণের ১০ হাজার শব্দের ‘কেষ্ট কবি’ প্রকাশিত হয়। ইসমোনাক বলেন, বাংলা সাহিত্যে ‘ক’ বর্ণের শব্দ বেশি এবং এই বর্ণ দিয়ে সহজেই শব্দ তৈরি করা হয়। সে কারণে ‘ক’ বর্ণকেই বেছে নিয়েছি। তবে আট মাস অনুসন্ধান করেও ‘ক’ দিয়ে তৈরি মৃত্যু শব্দের কোনো সমার্থক শব্দ পাইনি। মৃত্যুর কাছাকাছি শব্দ কতল বা কুপোকাত (পরাস্ত হয়ে যাওয়া) পেয়েছি। তাই কুপোকাত শব্দটি ব্যবহার করেছি। ‘ক’ নিয়ে ধ্যান-জ্ঞান করছেন তিনি ২০ বছর ধরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগার, কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি, শিল্পকলা একাডেমি লাইব্রেরি, বাংলা একাডেমি লাইব্রেরি, বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমি লাইব্রেরি ও ঢাকা ক্লাব প্রাইভেট লিমিটেড লাইব্রেরিতে অনেক সময় কাটিয়েছেন। করেছেন সাহিত্য চর্চা। এই সময়ে ‘ক’ বর্ণ দিয়ে প্রায় আড়াই লাখ শব্দ সংগ্রহ করেন। এর ফলশ্রুতিতে ‘ক’ বর্ণের ২৭ হাজার শব্দের তিনটি বই লিখতে সক্ষম হয়েছেন জানিয়ে বলেন, এই বইগুলো মানুষের কাছে পৌঁছাতে অনেকের দ্বারস্থ হন। কিন্তু উপযুক্ত কাউকে পাননি। ১৯৬৭ সালে সরাইলের নোয়াগাঁও গ্রামের সরদার বাড়িতে জন্ম ইসমোনাকের। বাবার নাম হেফজু মিয়া। ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে ইসমোনাকের অবস্থান পঞ্চম। তিনি সরাইলের কালিকচ্ছ পাঠশালা থেকে মেট্রিকুলেশন (এসএসসি) ও সরাইল মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে বিএ পাস করেন। ঢাকার মিরপুরের মোস্তফা আইডিয়াল কিন্ডার গার্টেনে দুই বছর এবং গাজীপুরের এ্যানিতা মডেল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে তিন-চার বছর শিক্ষকতা করেছেন। ঢাকার মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় থাকতেন। করোনা শুরু হলে গত বছরের ২০শে মে তিনি গ্রামের বাড়ি নোয়গাঁও চলে আসেন। ইসমোনাক বলেন, এসব করতে গিয়ে আমি সবকিছু হারিয়েছি। স্ত্রী-সন্তান আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন সঙ্গে শুধু মা আছেন। ২০০৫ সালের ২৩শে জুন মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে বিয়ে করেন ইসমোনাক। সংসার জীবন ছিল ১৫ বছর। তার প্রথম কন্যা সন্তান জন্মের ছয়দিন পর মারা যায়। বর্তমানে তার ১১ বছরের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। তবে দুই বছর আগে স্ত্রী সন্তান নিয়ে তার কাছ থেকে চলে যান। সাহিত্য সাধনা করতে গিয়ে সামাজিক গঞ্জনা-বঞ্চনার শিকার হয়েছেন বলেও জানান তিনি। চরম অর্থকষ্টে নিপতিত হন। নিভৃতচারী এই লেখক এতোদিন লোকচক্ষুর আড়ালেই ছিলেন। তার বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন জামি জেলা প্রশাসককে অবহিত করেন। এরপর ২১শে জানুয়ারি জেলা প্রশাসক হায়াত উদ-দৌলা খাঁন তার সম্মেলন কক্ষে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে এই লেখককে সাংবাদিকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এ সময় জেলা প্রশাসক তাকে ২৫ হাজার টাকার আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। তিনি ইসমোনাকের বই মানুষের কাছে পৌঁছানোর উদ্যোগ নেয়ার কথাও জানান। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তৃতা করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব সভাপতি রিয়াজউদ্দিন জামি, সাধারণ সম্পাদক জাবেদ রহিম বিজন, সিনিয়র সহ-সভাপতি পীযূষ কান্তি আচার্য, ব্রাহ্মণবাড়িয়া টেলিভিশন জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন সভাপতি মনজুরুল আলম, প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি মো. আরজু, প্রেস ক্লাব কার্যনির্বাহী কমিটির কোষাধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম শাহজাদা, সদস্য কবি মনির হোসেন, সাংবাদিক আবদুন নূর, উজ্জ্বল চক্রবর্তী, বাহারুল ইসলাম মোল্লা, জালাল উদ্দিন রুমি, শফিকুল ইসলাম, শাহাদাৎ হোসেন প্রমুখ। সভায় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আশরাফ আহমেদ রাসেল, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রশান্ত কুমার বৈদ্য।