× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৮ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

পরামর্শক সেবা বা কনসালটেন্সি

মত-মতান্তর

এ এম এম নাসির উদ্দিন, সাবেক সচিব
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বুধবার

ক'দিন আগে বহুল প্রচারিত একটি বাংলা দৈনিক একনেকে উপস্হাপিত একটি উন্নয়ন প্রকল্পে প্রায় বায়ান্ন কোটি টাকা পরামর্শক খাতে খরচের প্রস্তাব নিয়ে তীব্র সমালোচনামুলক রিপোর্ট ছাপিয়েছে দেখলাম। উন্নয়ন প্রকল্পের মাত্রাতিরিক্ত পরামর্শক খরচ বা কনসালটেন্সি নিয়ে এ রকম রিপোর্ট প্রায়শই দেখা যায়। বলতে দ্বিধা নেই- বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্পে এ খাতে বিশাল অংকের অর্থ অপচয় হচ্ছে প্রতিনিয়ত । এ পেশাকে ঘীরে দেশি- বিদেশি চক্র বা নেটওয়ার্ক অত্যন্ত সক্রিয়। টেকনিক্যাল বা কারিগরি কাজে পরামর্শকের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। দেখা যাচ্ছে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে অনেক ক্ষেত্রে যথাযথভাবে যাচাই বাছাই না করেই অপ্রয়োজনীয় পরামর্শক খরচ বরাদ্দ করা হচ্ছে। আর্থ-সামাজিক খাতের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো এ জাতীয় অপচয়ের উর্বর ক্ষেত্র। অনেক সময় পরামর্শকের রিপোর্ট কর্তাব্যক্তিরা পড়েও দেখেন না।
পরামর্শকের রিপোর্টের গুণগত মান ও যাচাইয়ের ব্যবস্হা নেয়া হয় না। পরামর্শকের মূল্যায়নের ব্যবস্থা ও থাকে না এবং এদের সুপারিশ নথিবদ্ধই থেকে যায়। একবার একটা বড় মন্ত্রণালয়ে একজন পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল যার কাজ ছিল ওই মন্ত্রণালয়ে বাস্তবায়িত সব সমীক্ষার তালিকা এবং পরামর্শকের সুপারিশ সমুহ সংকলন। এই কাজটি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদেরই করার কথা। তা না করে বিপুল অর্থব্যয়ে পরামর্শক নিয়োগ করা হয়েছিলো।
২। বলা হয়ে থাকে, কনসালটেন্সি একটা আদিম পেশা। এ পেশার জনক হচ্ছে আযাযীল বা ইবলিশ। তিনিই সর্বপ্রথম এবং আদিমতম কনসালটেন্ট যার পরামর্শ মোতাবেক নিষিদ্ধ ফল খেয়ে হযরত আদম (আ:) ও বিবি হাওয়া স্বর্গসুখ ছেড়ে মর্ত্যে আসতে বাধ্য হন। আর আমরা মনুষ্যকুলও ভুল কনসালটেন্সির শিকার হয়ে নিশ্চিত স্বর্গসুখ থেকে বঞ্চিত। ভুল কন্সালটেন্সির পরিণাম অনেক সময় মারাত্মক হতে পারে। বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ পল স্যামুয়েলসন আক্ষেপ করে বলেছিলেন,"Often when I became a consultant to a Federal Agency,that precipitated its demise". কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো সংস্থায় তাকে পরামর্শক নিয়োগ প্রায়শই ওই সংস্হার অধঃপতনের কারণ হতো। কনসালটেন্ট বহু রকমের রয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটেন্ট, ফিনান্সিয়াল কনসালটেন্ট , ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট, আইটি কন্সালটেন্ট, লিগ্যাল কনসালটেন্ট , মানব সম্পদ কন্সালটেন্ট, কমিউনিকেশন কন্সালটেন্ট, চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার কনসালটেন্ট , ক্রিকেটের বোলিং কন্সালটেন্ট ইত্যাদি হাজারো ধরনের কন্সালটেন্ট তাদের পেশায় নিয়োজিত।আমার আলোচ্য বিষয় সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের পরামর্শক খরচ । সঠিক তদারকি না থাকলে পরামর্শকের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায় না। পরামর্শক ফাঁকি দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়। বলা হয়ে থাকে,"A Consultant is someone who saves his client almost enough to pay his fees"। তার ফিস পেলেই পরামর্শক সন্তুষ্ট। নিয়োগকর্তার আর্থিক সাশ্রয়ের বিষয়টা পরামর্শক প্রায়শই বিবেচনায় রাখেন না। ব্রীজ, ফ্লাইওভার, মহাসড়ক ইত্যাদি অনেক বড় প্রকল্পে আমরা এর প্রমাণ দেখেছি।
অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে, অনেক সময় পরামর্শক অসুদ্দেশ্য নিয়েও কাজ করেন। কারো পক্ষ হয়ে কাজ করেন এমন পরামর্শক ও দেখেছি। আমি জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে কাজ করার সময়ে একবার পেট্রোবাংলার অধীনস্থ এক কোম্পানি একটা বহুপাক্ষিক(Multilateral) ঋণ দান সংস্হার অর্থায়নে গ্যাস কম্প্রেসার স্হাপনের জন্যে টেন্ডার আহ্বান করে। একাধিকবার টেন্ডারের পর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে চুড়ান্ত নির্বাচিত দরদাতা অনুমোদনের প্রস্তাব ওই ঋণদাতা সংস্হায় পাঠানো হলে তারা এটা অনুমোদনে অস্বীকৃতি জানায়। সংস্হা জানায় যে, একটা বিশেষ কোম্পানির তৈরী কম্প্রেসার মাথায় রেখেই টেন্ডারে উল্লিখিত কম্প্রেসারের ডিজাইন করা হয়েছে। তারা আরো জানায়, প্রকল্পের পরামর্শক এক সময় ওই কম্প্রেসার কোম্পানিতে চাকুরি করতেন এবং এর সুত্রেই ওই কোম্পানির পক্ষ হয়ে ডিজাইনটা করেছেন। ফলে টেন্ডারে অন্য কোন কোম্পানির কামিয়াব হবার সুযোগ সীমিত। ওই সময়ে আর কম্প্রেসার কেনা যায় নি। সঠিক পরামর্শক বাছাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উল্লেখ্য, ঋণদাতা সংস্হাই ওই পরামর্শক নির্বাচন করেছিলো।

৩।অনেক বিদেশি পরামর্শককে কাজে যোগ দেবার জন্য তার নিজ দেশ থেকে বিমানে ওঠার সময়কাল থেকেই ফিস হিসেব করে পরিশোধ করতে হয়। সাধারণত আমাদের দেশে সাদা চামড়া বিদেশি পরামর্শকের প্রতি দুর্বলতা দেখা যায় এবং তাদের ফিস ও অনেক বেশি। অবশ্য সাম্প্রতিককালে অনেক ভারতীয় পরামর্শক এদেশে কাজ পাচ্ছেন। লিগ্যাল কনসালটেন্টদের ফিস অন্যদের তুলনায় সাধারণত বেশি। একমাত্র ডক্টর কামাল হোসেন সাহেবকেই দেখেছি ফিস ছাড়াই সরকারকে পরামর্শক সেবা দিয়েছেন। পেট্রোবাংলাকে তিনি বিনা ফিসে আইনি সহায়তা দেন।২০০৭ সালে Model Production Sharing Contract (যা Model PSC-2008 হিসেবে অনুমোদিত হয়)এর খসড়া তিনি বিনা পারিশ্রমিকে রিভিউ করে দিয়েছিলেন। আমি এবং তদানীন্তন জ্বালানী উপদেষ্টা জনাব তপন চৌধুরী খসড়াটা নিয়ে একদিন বেশ কয়েক ঘণ্টা ডক্টর কামাল হোসেন সাহেবের চেম্বারে বিস্তারিত আলোচনা করি। তিনি আন্তরিকভাবে রিভিউ করে তার মতামত দেন বিনা ফিসে।অবশ্য তিনি আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, পেট্রোবাংলার কোন কাজে তিনি ফিস নেবেন না।

উল্লেখ্য,ডক্টর কামাল হোসেন সাহেব বিখ্যাত আন্তর্জাতিক আইনি পরামর্শক এবং তার ফিস আমার জানামতে অনেক বেশি।

৪। অন্যরকম দেশীয় পরামর্শকও রয়েছেন যারা সরকারকে এতটুকু ছাড় দিতে নারাজ। বরং সরকারের কাছ থেকে যথাসম্ভব সর্বোচ্চ ফিস আদায় করেই তারা কাজ করেন।অনেক সময় তাদের দাবিকৃত ফিস অযৌক্তিকভাবে বেশি মনে হলেও তা পরিশোধ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। দেশের একজন প্রথিতযশা শীর্ষ আইনজীবী পেট্রোবাংলার পক্ষে মামলা লড়ে বিশাল অংকের ফিস আদায় করে নিয়েছেন যা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়নি। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে প্রাইভেটাইজেশন বোর্ডের(বর্তমান প্রাইভেটাইজেশন কমিশন) সচিব হিসেবে কাজ করার সময়ে একবার লিগ্যাল পরামর্শক নিয়োগের জন্যে Expression of Interest(EOI) আহ্বান করা হয়। আমাদের ইচ্ছা ছিল, বিখ্যাত আইন বিশেষজ্ঞ একজন সাবেক আইন সচিবকে নিয়োগ দেয়া হবে। যোগাযোগ করা হলে তিনি EOI দাখিলে অস্বীকৃতি জানান এবং বলেন যে, আবেদন করে তিনি কাজ নেবেন না। আমাদের প্রয়োজন হলে তাকে সরাসরি নিয়োগ দিতে হবে তার শর্তে।তিনি এমনকি জীবন বৃত্যান্ত দাখিল করতেও অস্বীকৃতি জানান। তার শর্তেই তাঁকে নিয়োগ দেয়া হয়।শর্তের মধ্যে ফিস ছাড়াও সকাল দশটার সময়ে সফট ড্রিংকসসহ নাস্তা(মেনু তিনি ঠিক করে দিয়েছিলেন) এবং দুপুরের মধ্যাহ্ন ভোজ অন্তর্ভুক্ত ছিল।

উল্লেখ্য, প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের অফিস ছিল তখন জীবনবীমা টাওয়ারের পনের তলায়।ওই ভবনের বিশ তলায় একটা উন্নত মানের রেষ্টুরেন্ট ছিল যেখান থেকে প্রতিদিন তার জন্য দুপুরের খাবার আসতো তার পছন্দ ও শর্ত মোতাবেক।

৫।পরামর্শক অনেক ক্ষেত্রে অবশ্য প্রয়োজনীয়। কাঙ্ক্ষিত ফলাফলের জন্যে কিছু বিষয় বিবেচনায় নেয়া জরুরি।

ক) কোন প্রকল্পে পরামর্শক সেবার প্রয়োজনীয়তা যথাযথ ভাবে যাচাই করা দরকার। প্রকল্প প্রণয়নের সময়েই উর্ধতন কর্মকর্তাদের তত্বাবধানে কাজটা করতে হবে।
খ) সঠিক পরামর্শক বাছাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গ) পরামর্শকের কাজের তত্বাবধান জরুরি। পরামর্শকের কাজের মধ্যবর্তী মূল্যায়ন আবশ্যক। শীর্ষ কর্মকর্তাগণ কতৃক মাঝে মধ্যে পরামর্শকের কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা দরকার।
ঘ) পরামর্শকের রিপোর্টে সুনির্দিষ্ট তথ্য উপাত্ত ও বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশ থাকা বাঞ্ছনীয়।
ঙ)পরামর্শকের প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়/বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অবশ্যই পড়া প্রয়োজন।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর