× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

‘ঢাকা মেডিকেলের ছাত্ররা এক রাতে তৈরি করেন প্রথম শহীদ মিনার’

দেশ বিদেশ

আশরাফুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ থেকে
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, রবিবার

১৯৫২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারিও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে অমর একটি দিন। এদিনেই হোস্টেলের পার্শ্বে ঢাকা মেডিকেল প্রাঙ্গণে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের প্রাথমিক কাজটি সম্পন্ন হয়। সেদিন নির্মিত ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’টিই পরবর্তীকালের শহীদ মিনার। আজকে যে শহীদ মিনার, সেটা শুরুতে নির্মিত হয়েছিল মাত্র এক রাতের মধ্যে। সেই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হতে শুরু করে নির্মাণ পর্যন্ত সবটুকু কৃতিত্ব যারা সে সময়ের ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র, তাদের। মানবজমিনকে দেয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রথম শহীদ মিনার তৈরির ইতিহাস ও ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে এসব কথা জানান মাতৃভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গে শহীদদের স্মরণে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রদের নির্মিত প্রথম ইটের শহীদ মিনার তৈরিতে অংশ নেয়া ঢাকা মেডিকেল কলেজের আদিপর্বের ছাত্র ডা. এএ মাজহারুল হক। ডা. এএ মাজহারুল হক মাতৃভূমির প্রায় প্রতিটি বিজয়-সংগ্রামেই, বিশেষ করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিসংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় অবদান রাখেন। ১৯৪৬-৪৭ সালে ছাত্রাবস্থায় ব্রিটিশ হটাও আন্দোলনে প্রবলভাবে যুক্ত থেকে তিনি সামপ্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে কাজ করেন।
ভাষা আন্দোলনে সংক্ষিপ্ত কারাবাসসহ সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে তিনিই প্রথম মুক্তিকামী কিশোরগঞ্জবাসীকে স্বাধীনতার ঘোষণা অবহিত ও প্রচার করেন এবং তার নেতৃত্বে নিজ বাসভবনেই আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন রক্তপাতহীনভাবে কিশোরগঞ্জের পতন ঘটিয়ে সেখানে সর্বপ্রথম স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করেন। প্রায় ৬৮ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে চিকিৎসা-সমাজসেবা-রাজনীতির মহান ব্রত পালনের মাধ্যমে বিশিষ্ট ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ডা. মাজহারুল হক বর্তমানে কিশোরগঞ্জে অবসর-জীবন-যাপনরত।

ভাষা আন্দোলনে ডা. মাজহারুল হকের ব্যক্তিগত সংযোগ স্মৃতির ঘটনাটি ২০০৭ সালে জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রকাশিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনে আলী হাবিব বিস্তারিত লিখেছেন: ‘ঢাকা মেডিকেলের ছাত্ররা এক রাতের মধ্যে এ প্রশংসনীয় কাজটি করেছিলেন।’ ডা. মাজহারুল হকসহ মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের সরাসরি ও  প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সেসব কথা শহীদ মিনার নির্মাণের কাজে জড়িত অপর এক ছাত্র সাঈদ হায়দার তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন: ‘মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা শহীদ মিনার তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। এটাকে স্বতঃস্ফূর্ত একটা পরিকল্পনা বলা চলে। বিকাল থেকে কাজ শুরু হয়। শেষ হয়  ভোরে।’  ডা. মাজহারুল হক জানান: ‘আমরা এক প্রকার গেরিলার মতো গোপনে নির্মাণ কাজ চালিয়ে ছিলাম। ইট, বালি, সিমেন্ট সংগ্রহ করেছিলাম। ঘোষণা দিয়ে ঘটা করে তা নির্মাণ করা হয়নি কৌশলগত কারণে। পূর্বাহ্নে জানতে পারলে পাকিস্তানপন্থিরা সেটা গড়তেই দিতো না। আমরা নির্মাণ-সংক্রান্ত যোগাড়-যন্ত্র ও অন্যান্য আয়োজন নির্ধারণ করে পালাক্রমে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ চালিয়ে গভীর রোমাঞ্চ ও উত্তেজনায় দেখতে পেলাম যে, আমাদের কাঁচা হাতে শহীদদের রক্তদানের পবিত্র স্থানে মাথা উঁচু করা স্মৃতিস্তম্ভ দাঁড়িয়েছে আছে। সেইদিনের উত্তেজনা আজও মনে আছে। শহীদ শফিউরের পিতাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন সাহেব। পরপরই আমরা ফুল ও শ্রদ্ধার মালায় শহীদ মিনার ভরে তুললাম। সারা দিনই বিপুল ছাত্র-জনতা এভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করলো। সেদিনই শেষ বিকালের দিকে সরকারের পক্ষ হতে শহীদ মিনারের ওপর আক্রমণ চালানো হলো। তছনছ করে  দেয়া হল স্মৃতি ও শ্রদ্ধার মিনার। পুলিশ অকস্মাৎ হামলা চালিয়ে আদি শহীদ মিনারটি সম্পূর্ণরূপে গুঁড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে  দিলো এবং আমাদের মেডিকেল হোস্টেলে আক্রমণ করলো। জীবনে প্রথমবারের মতো পুলিশি নির্যাতনের শিকার হলাম। আহত অবস্থায় আমাদেরকে থানায় নিয়ে গিয়ে শাসিয়ে দেয়া হলো। বিপুল সংখ্যক ছাত্রকে আটক করে রাখার মতো স্থান হয়তো থানা-পুলিশের ছিল না। গণগ্রেপ্তার করে আন্দোলনকে আরো বেগবান করার পথে তারা অগ্রসর হলো না। কয়েক ঘণ্টার আটকাবস্থা, জেরা ও খবরদারির পর আমাদেরকে  ছেড়ে দেয়া হলো। হলে ফিরে এসে দেখলাম উদ্বিগ্ন বন্ধু-বান্ধব অপেক্ষমাণ। আমাদেরকে অতি দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হলো। দীর্ঘ ৬৯ বছর আগের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি আজও আমাকে রোমাঞ্চিত করে।’

ডা. মাজহারুল হক জানান, ঢাকা মেডিকেলে অধ্যয়নের সময় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মতো জাতীয় রাজনীতির ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সরাসরি সম্মুখীন হন তিনি এবং ব্যক্তিগতভাবে নিজে ও আমার সহপাঠীগণ তাতে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ব্যারাক নামে পরিচিত মেডিকেল হোস্টেলে তখন থাকতেন। ইত্যবসরে রাজনীতিতে নানারূপ পরিবর্তন সাধিত হলো। ভাষার জন্য লড়াইয়ের ক্ষেত্রও তৈরি হয়ে গেল।

ডা. মাজহারুল হকের ভাষায়, ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখের দিকে ছাত্র আন্দোলন সুতীব্র হলো। অনেকে গ্রেপ্তার বরণ করলেন। সরকার এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা বহাল করলো। সভা-সমাবেশ-হরতাল নিষিদ্ধ করা হলো। কিন্তু সবাই তখন সংগ্রামমুখর। বাংলার ছাত্রসমাজ তখন অকুতোভয়। কে তাদেরকে রুখবে! এমন সাধ্য কার!! রাত্রি বেলাতেই সিদ্ধান্ত জানা গেল যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে। সমাবেশ হবে। মিছিল হবে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ চলবেই। রাত্রি শেষে এলো ২১শে ফেব্রুয়ারি। সেদিন সকাল হতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পার্শ্ববর্তী এলাকার পরিস্থিতি আপাত দৃষ্টিতে শান্তই ছিল। ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ৫ জন ৫ জন করে ১৪৪ ধারার ভেতরেও মেডিকেল হোস্টেল, যা ব্যারাক নামে পরিচিত ছিল, তার সম্মুখে সমবেত হতে লাগলো। আজিমপুর ও সলিমুল্লাহ হলের দিক হতেও লোকজন আসতে লাগলো। মধুর ক্যান্টিনের দিকেও ছাত্ররা সংগঠিত হলো। অবিরাম ছাত্রস্রোত রুদ্ধ করতে প্রথমে পুলিশের পক্ষ হতে শুরু হয় লাঠিচার্জ। এর পর শুরু হলো টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ। কিন্তু কোনোভাবেই বিক্ষোভ দমন করা সম্ভব হলো না। বেলা যতই বাড়তে লাগলো, ততই বিক্ষোভ তীব্রতর হতে লাগলো; প্রতিবাদ-বিক্ষোভে জনসমাগমও হু হু করে বৃদ্ধি পেলো। বিশ্ববিদ্যালয় মাঠ, মেডিকেল কলেজ গেট প্রভৃতি এলাকায় ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ সমাবেশ পুঞ্জিভূত হতে লাগলো। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানাতে হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় হতে শুরু করে হলবয় পর্যন্ত এসে মিছিলে একাত্ম হলো। এরই মধ্যে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ আরম্ভ হলো। এমন অবস্থায় বেলা তিন ঘটিকার দিকে রাজপথে দাঁড়িয়েই ডা. মাজহারুল হক অতি নিকটেই পুলিশের বন্দুক হতে হঠাৎ গুলিবর্ষণের আওয়াজ শুনতে পান। প্রচণ্ড উত্তেজনা ও হৈ চৈ-এর মধ্যে আন্দোলনরত ছাত্রদেরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সন্নিকটে অবস্থিত মেডিকেল হোস্টেলে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বহুজন আহত হলো। আহত ও নিহতদের ইমার্জেন্সিতে নেয়া হলো। তিনিসহ মেডিকেলের ছাত্ররা ইমার্জেন্সিতে ছুটে গিয়ে বহু আহতকে কাতরাতে দেখলেন। স্বাধীন দেশে পুলিশের নির্মম অত্যাচারের চিত্র  যে এত ভয়াবহ হতে পারে, তা দেখে সবাই বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ আবুল বরকতকে দেখতে পেলেন তিনি। বরকতের তলপেটে গুলি লেগেছিল। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসেবে তিনি সকলের চোখের সামনে দিয়ে পরপারের পথে চিরবিদায় নিলেন। শহীদ আবুল বরকতের পর গুলিবিদ্ধ হন রফিকউদ্দিন। তিনি ছিলেন মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজের ছাত্র। তাঁর পিতা ছিলেন বাদামতলীর কমার্শিয়াল আর্ট প্রেসের মালিক। ২১শে ফেব্রুয়ারির আরেক শহীদ আব্দুুল জব্বার। তাঁর বাড়ি  ময়মনসিংহে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে লক্ষ্মীপুরে ডা. মাজহারুল হকের গ্রামের বাড়ির সম্মুখ দিয়ে প্রবাহিত পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম পার্শ্বে গফরগাঁও থানার পাঁচুয়া গ্রামের এই ভাষাশহীদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক আত্মীয়-রোগী ভর্তি করতে এসেছিলেন। তিনি মেডিকেল কলেজ হোস্টেলেই নিজ এলাকার একজন ছাত্রের কক্ষে এসে উঠেছিলেন। গত কয়েকদিন ধরে তাকে কলেজ ক্যান্টিন ও হাসপাতালে দেখেছিলেন ডা. মাজহারুল হক। অদৃষ্টের ইঙ্গিতে তিনিও শহীদের তালিকায় নাম লিখালেন। তিনি চোখের সামনে রক্ত, মৃত্যু আর আহতদের আহাজারি দেখে ক্ষণকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন বটে। কিন্তু সেই সুতীব্র আঘাত ও আক্রমণ তাঁদের মধ্যকার একটি ঘুমন্ত-ক্ষত-বিক্ষত বাঘকে জাগিয়ে দিলো। বন্ধু-সহপাঠীদের মধ্যেও তিনি লক্ষ্য করলেন অভিন্ন ক্ষোভের লেলিহান অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত  হয়েছে।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর