শেষের পাতা

ভাষার বৈচিত্র্য সংরক্ষণ, চর্চা ও বিকাশ একান্তভাবে প্রয়োজন

স্টাফ রিপোর্টার

২০২১-০২-২২

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যেকোনো একটি জাতির জন্য ভাষাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মায়ের ভাষায় শিক্ষা নিতে পারা এবং মায়ের ভাষায় কথা বলতে গেলে সহজে আমরা শিখতে পারি। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, ধীরে ধীরে অনেক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। তারপরও সারাবিশ্বব্যাপী ভাষার যেই বৈচিত্র্য রয়েছে, তা সংরক্ষণ, তার চর্চা এবং বিকাশ একান্তভাবে প্রয়োজন। পাশাপাশি পৃথিবী থেকে অনেক ভাষার হারিয়ে যাওয়া ঠেকাতে হবে।

রোববার ভাষা শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক ২০২১ প্রদান অনুষ্ঠানে একথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। অনুষ্ঠানে নিজ নিজ মাতৃভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন, বিকাশ, চর্চা, প্রচার-প্রসারে অবদান রাখায় ৩ ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠান ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক’ পান।

মাতৃভাষায় শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই অন্য ভাষা শিখতে হবে, সেই সঙ্গে মাতৃভাষাও আমাদেরকে শিখতে হবে। বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর ভাষাও যেন সংরক্ষণ করা যায় এবং তারা যেন সেই ভাষায় শিক্ষা নিতে পারে, সেজন্য সরকারের প্রচেষ্টার কথাও জানান শেখ হাসিনা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, যার নেতৃত্বে এই ভাষা আন্দোলনের শুরু, আর ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। ভাষা আন্দোলন থেকেই তিনি বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। এবং তারই নেতৃত্বে আমরা বিজয় অর্জন করি, স্বাধীন রাষ্ট্র পাই, স্বাধীন জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পাই।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এবার স্বশরীরে শহীদ মিনারে যেতে না পারায় আক্ষেপও প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা।

স্বশরীরে উপস্থিত হতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বিশেষ করে যখন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক রফিকুল ইসলাম সাহেবের হাতে পদক তুলে দেয়া, এটা যে আমার জন্য কতো সম্মানের এবং গৌরবের। কিন্তু আমার দুঃখ এখানে যে, আমি নিজের হাতে দিতে পারলাম না।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদকপ্রাপ্ত জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামকে উদ্দেশ্য করে শেখ হাসিনা বলেন, স্যার, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি করোনাভাইরাসের কারণে আসলে... প্রধানমন্ত্রী হলে সব স্বাধীনতা থাকে না। অনেকটা বন্দি জীবনযাপন করতে হয়। সেই রকমই আছি।
ইউনেস্কোর বাংলাদেশ মিশনের প্রধান বিয়াত্রিস কালদুনও ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন।

অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক জীনাত ইমতিয়াজ আলী উপস্থিত ছিলেন।

প্রথম মাতৃভাষা পদক পেলেন ৪ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান: মাতৃভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন, বিকাশ, চর্চা, প্রচার-প্রসারে অবদানের জন্য জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামসহ ৩ ব্যক্তি এবং এক প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রথমবারের মতো তুলে দেয়া হলো ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক’। অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম জাতীয় পর্যায়ে মাতৃভাষার সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন ও বিকাশে অবদানের জন্য ২০২১ সালের এই সম্মননা পেলেন। এ ছাড়া জাতীয় পর্যায়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা সংরক্ষণে অবদানের জন্য খাগড়াছড়ির জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক পেয়েছেন।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উজবেকিস্তানের গবেষক ইসমাইলভ গুলম মিরজায়েভিচ এবং লাতিন আমেরিকার আদি ভাষাগুলো নিয়ে কাজ করা বলিভিয়ার অনলাইন উদ্যোগ অ্যাক্টিভিজমো লেংকুয়াস এ বছর বাংলাদেশ সরকারের এ সম্মাননা পেয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি পদক তুলে দেন। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সরকার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর এ বছরই প্রথম এ সম্মাননা দেয়া হলো। দুই বছর পর পর জাতীয় পর্যায়ে দুটি এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুটি পদক দেয়া হবে।

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম: অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম নজরুল অধ্যাপক এবং নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক। ৮৭ বছর বয়সী এই ভাষাবিজ্ঞানী, লেখক ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। সেই সময়ের দুর্লভ আলোকচিত্রও ধারণ করেছেন তিনি। বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের এই প্রত্যক্ষ সাক্ষী সেইসব ইতিহাস গ্রন্থিত করেছেন তার লেখায়। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে প্রথম গ্রন্থ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের ইতিহাসের প্রথম গ্রন্থটিসহ প্রায় ৩০টি বই তার হাত দিয়ে এসেছে। এক সময় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৮ সালে সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক করে নেয়। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম এর আগে একুশে পুরস্কার, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা: প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক পাওয়া আরেক বাংলাদেশি মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বাংলাদেশের বিভিন্ন ভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন, বিকাশ ও এসব ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম প্রণয়নে কাজ করেছেন। দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার চিত্র, মাতৃভাষায় শিক্ষা পরিস্থিতি, মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি।

ইসমাইলভ গুলম মিরজায়েভিচ: আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, উজবেকিস্তানের নাগরিক ইসমাইলভ গুলম মিরজায়েভিচ তার মাতৃভাষার গবেষণায় অনন্য সাধারণ ভূমিকা রেখেছেন। উজবেক ভাষার চর্চার প্রসার, সংরক্ষণ এবং সাংস্কৃতিক বিকাশে তার ভূমিকা অগ্রগণ্য। ভাষাবিজ্ঞানের বিষয়গুলো ছাড়াও আর্থ-সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটগুলো তার কাজে গুরুত্ব পেয়েছে। বিশ্বে মাতৃভাষা হিসেবে উজবেক ভাষার অবস্থান সংহত করতে বিভিন্ন প্রকল্পের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন ইসমাইলভ গুলম মিরজায়েভিচ।   

অ্যাক্টিভিজমো লেংকুয়াস: লাতিন আমেরিকার স্থানীয় ভাষাগুলোকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে বলিভিয়ার অ্যাক্টিভিজমো লেংকুয়াস। এ সংস্থার কোনো অফিস নেই, এ উদ্যোগে জড়িত সবাই কাজ করেন ভার্চ্যুয়ালি। ২০১৪ সালে মেক্সিকোতে ইনডিজেনাস ল্যাঙ্‌গুয়েজ ডিজিটাল অ্যাক্টিভিস্টসদের প্রথম সম্মেলনের পর অ্যাক্টিভিজমো লেংকুয়াসের যাত্রা শুরু হয়। আমেরিকার লাতিন ভাষাভাষী অঞ্চলের আদিবাসীদের মাতৃভাষা এবং পুরনো ভাষাগুলোর সংরক্ষণ, প্রসার ও গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে এ সংস্থা।
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status