সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘মিউচুয়াল ফ্রেন্ড’ লিস্টে থাকা এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয় হয় বাংলাদেশি শেহওয়ার হোসাইন ও রোমানিয়ার নাগরিক মারিয়ার। ২০১৭ সালের অক্টোবরে তাদের পরিচয় হয়। অতঃপর পরিণয় এবং বিয়ে। ভালোবাসার টানে ধর্মান্তরিত হয়েছেন বিদেশিনী মারিয়া। শিখছেন বাংলাসহ মোট পাঁচটি ভাষা। গত বছর ঢাকায় তারা বিয়ে করেন। তাদের ভিডিও দেখা হয়েছে প্রায় ৩৬ লাখেরও বেশি বার। বাংলা, বাংলাদেশের নানা বিষয় নিয়ে কাজ করছেন স্বামীর সঙ্গে।
ভ্রমণ-রান্নাসহ নানা বিষয়ে ভিডিও তৈরি করে তা ইউটিউবে প্রচার করছেন। পেয়েছেন দারুণ জনপ্রিয়তা। শেহওয়ার-মারিয়া দম্পত্তি নেট দুনিয়ায় এখন অনেকটা সেলিব্রেটি। ভিন দেশের এই দুই তরুণ-তরুণীর প্রেম, প্রণয় এবং নেট দুনিয়ায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠার গল্প জানা গেছে তাদের নিজের মুখেই।
শেহওয়ার হোসাইন বলেন, ২০১৭ সালের অক্টোবরে আমাদের পরিচয়। ওভাবে ঘটা করে ভালোবাসি কথাটি বলা হয়নি রোমানিয়ান নাগরিক মারিয়াকে। আসলে আমাদের ভাগ্যটা খুব ভালো। আমাদের দু’জনের কমন বন্ধু এবং মারিয়ার অফিসের কলিগের মাধ্যমে পরিচয় হয়। প্রথমদিকে আমরা ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে যোগাযোগ শুরু করি। এভাবে অনেকদিন চলতে থাকে। এরপর সরাসরি দেখা হওয়ার পরে ধীরে ধীরে নিজেদের মধ্যে ভালোলাগার শুরু। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে মারিয়াকে যখন আমাদের লন্ডনের বাসায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে যাই তখন প্রথম দেখায় সবারই ওকে ভালো লেগে যায়। বিশেষ করে আমার মা এবং দু’বোনের। মারিয়ার বাংলা বলাটা সত্যি বলতে আমাদের সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম থেকে ওর বাংলার প্রতি একটি অন্যরকম টান ছিল। এমনকি যখন আমাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ওকে পরিচয় করিয়ে দেই তখনো খুব করে জানতে চাইতো আচ্ছা এটাকে বাংলায় কি বলে? এটার মানে কি? ইত্যাদি। তিনি বলেন, মারিয়া তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তার বাবা সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন এবং মা গৃহিণী। মারিয়ার জন্ম ও বেড়ে ওঠা রোমানিয়ায়। মারিয়ার বাবা-মা থাকেন রোমানিয়াতে এবং আমার বাবা চার বছর আগে মারা যান। তিনিও একজন সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। মা বাংলাদেশ টেলিভিশন, বেতারে বিভিন্ন ধরনের উপস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রান্না নিয়ে তার নিজস্ব একটি ইউটিউব চ্যানেলে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তিনি বলেন, চার ভাই-বোনের মধ্যে আমি বড়।
শেহওয়ার বলেন, একটি মজার ঘটনা শেয়ার করতে চাই। শুরুতে মারিয়া বাংলা ভালো বুঝতো না। ভাষার বিড়ম্বনা হলে যা হয়। এটা হয়তো আমাদের জন্য মধুর স্মৃতি হতে পারে। ওকে যখন আমাদের বাসায় সকলের সঙ্গে প্রথম দেখা করাতে নিয়ে আসলাম তখন খুব মজা করে সকলের সঙ্গে পরিচিত হলো। এছাড়া মারিয়া খুবই মিশুক স্বভাবের। খুব ভালো মনের একটি মানুষ। সকলের সঙ্গে পরিচয় শেষে বললাম, তোমাকে আমাদের পুরো বাসা ঘুরে দেখানোর আগে চলো আমার ব্যক্তিগত রুমটি দেখাই। যদিও রুমটা সবসময় একটু অগোছালো থাকে। এ সময় আমার অন্য দুই বোন আমাকে ডেকে বলেন, ছি ছি! তোর এই রুম দেখলে বিদেশি মেয়ে তোকে তো কখনোই বিয়ে করবে না। তখন দু’বোন মিলে দ্রুত আমার রুমটি গুছিয়ে দেয়। পরিচয় শেষে গাড়িতে ওর বাসায় এগিয়ে দিতে যাওয়ার সময় দেখেছি ওর চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। ভীষণ মন খারাপ। কি হয়েছে জানতে চাইলে মারিয়া জানায়, ‘তোমার বোনরাতো আমাকে পছন্দ করেনি। হ্যা আমি শুনেছি। তুমি রুমে যাওয়ার পর বোনরা তোমার সঙ্গে ঝগড়া করছিল’। যেহেতু তখনো মারিয়া বাংলা ভাষাটা ভালোভাবে বোঝে না। কাজেই তখন শুধু ওর নামটা শুনে ধরে নিয়েছে ওকে পছন্দ হয়নি। এটা নিয়ে এখনো আমরা অনেক হাসাহাসি করি। এখন মারিয়া সবই বোঝে। বাংলায় আমি যাই বলবো সে ৯০ ভাগই বুঝতে পারে। বলতেও পারে।
তিনি বলেন, মা এক সময় রেডিওতে দুর্বার নামে একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন। রেডিওতে নিউজ পাঠ করার পাশাপাশি বাবা সেনাবাহিনীতে থাকায় মা সেনাবাহিনী সংক্রান্ত অনুষ্ঠানগুলো উপস্থাপনা করতেন। বিভিন্ন ক্লাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সব সময় মা গান গাইতেন। লন্ডনে এসেও বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে সংবাদ পাঠ করেছেন। গান গেয়েছেন। বর্তমানে মা তার ‘বিলেতের রান্নাবান্না’ নামে নিজস্ব একটি ইউটিউব চ্যানেল নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। যেটা ইতিমধ্যে অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। মায়ের হাতের রান্না খুব মজার। প্রবাসী এই নাগরিক বলেন, আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা বাংলাদেশে। বাবা-মা দু’জনেই ঢাকার বাসিন্দা হলেও বাবার চাকরির সুবাদে দেশের একাধিক স্থানে বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, কুমিল্লায় বেড়ে ওঠার স্মৃতি রয়েছে আমার। বাংলাদেশের খুব সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলো দেখার সুযোগ হয়েছে। ছোটবেলার অনেক স্মৃতি আছে দেশে। লন্ডনে এসেছি প্রায় ১৬ বছর আগে। এক সময় প্রিমিয়ার লীগে ক্রিকেট খেলতাম। কিন্তু মারিয়ার পড়ালেখা এবং বেড়ে ওঠা সবকিছুই রোমানিয়াতে। গত পাঁচ বছর ধরে লন্ডনে আছে।
তিনি বলেন, মারিয়ার জন্ম রোমানিয়ার প্লয়েশতি শহরে। সেখানেই বড় হয়েছে। মারিয়া ২০১৩ সাল থেকে দুই বছর ইরাকের কুর্দিস্তানে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেছেন। সেখান থেকে লন্ডনে আসেন ২০১৫ সালে। এখানে স্বাস্থ্য সুরক্ষার ওপর (নিবস) সবচেয়ে বড় একটি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। এখন পেশায় মারিয়া একজন স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থাতেই আমি লন্ডনে চলে আসি। এখানে এসে স্নাতকোত্তর করে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টের উপর (সিআইপিডি) কোর্স সম্পন্ন করি। এটা বর্তমানে লন্ডনে সবচেয়ে বড় কোয়ালিফিকেশন। এখন কাজ করছি মানবসম্পদ বিভাগে। শেহওয়ার বলেন, বাবার বদলি চাকরির সুবাদে ভ্রমণটা যেনো অস্থিমজ্জায় ঢুকে গেছে। ছোটবেলায় বাবা প্রতি শুক্রবার সকালে পুরান ঢাকা থেকে আমাদের জন্য হাজির বিরিয়ানি আনতেন। এই মধুরতম স্মৃতি কখনো ভুলবার নয়। শৈশব থেকে স্বপ্ন ছিল বাবার মতো হবো। এখন মা’কে ঘিরেই সবকিছু।
শেহওয়ার বলেন, আমাদের সব সময় ঘুরতে খুব ভালো লাগে। আমরা হচ্ছি ভ্রমণপোকা। আমাদের এই ইউটিউব ভিডিও তৈরি করার পেছনে মূল যে পরিকল্পনা ছিল বাংলা ভাষায় ভ্রমণ ভিডিও করা। কারণ, বাংলায় ভালো কোয়ালিটির কোনো ভিডিও আমরা কখনো দেখিনি। ইংরেজিতে অসংখ্য ভিডিও রয়েছে। এটা নিয়ে আমরা দু’জনে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেই আমাদের বাংলাদেশিদের জন্য কিছু একটা করতে চাই। ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে কোন কোন স্থানে যাওয়া উচিৎ? কি কি করা যেতে পারে? এসব কিছু বাংলায় আমাদের দেশের দর্শকদের জন্য বানানোর একটি বড় পরিকল্পনা রয়েছে। এর আগে আমরা এমনিতেও ছবি তুলে ভিডিও তৈরি করে ফেসবুকে আপলোড করতাম। এটা দেখে বাসার সবাই বলতেন ‘এগুলো এতো ভালো লাগে, ইউটিউবে দিতে পারো। অন্য মানুষও দেখবে’। প্রথমে এটা আন্তরিকভাবে নেইনি। করোনায় লকডাউন শুরুর পর থেকে আমরা দু’জনেই প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে বাসায় থেকে কাজ করছি। এতে অতিরিক্ত সময় হাতে থাকে। তখনই আমরা সিদ্ধান্ত নেই ইতিমধ্যে যে সকল স্থানে ঘুরেছি তার ছবি এবং ভিডিও দিয়ে আমাদের কাজ শুরু করি। তিনি বলেন, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা শুরু থেকেই ছিল আমরা যে সকল স্থানে ঘুরতে যাবো ওখানে কোথায় কিভাবে যেতে হয়? কি করা যেতে পারে? এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে যাতে বাংলা মানুষের জন্য উপযোগী ভিডিও তৈরি করা।
তিনি বলেন, আমাদের ইউটিউব চ্যানেলের বেশ কয়েকটি উদ্দেশ্য আছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের যে ব্রান্ড ইমেজ আছে সেটাকে ভালোভাবে তুলে ধরা। বিশেষ করে বিদেশে বাংলাদেশের কথা বললে বিদেশি গণমাধ্যমগুলো দেখায়, দুর্নীতি, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ইত্যাদি নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে। ভালো কোনো কিছু ওভাবে তুলে ধরে না। আমাদের ইচ্ছা আছে যখন দেশে যাবো তখন বাংলাদেশের সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলোর ভিডিও তৈরি করে বিদেশিদের কাছে তা পৌঁছে দেবো। কারণ আমাদের খুব খারাপ লাগে যখন দেখি ভারত, মালদ্বীপ, ভুটান, নেপালে বেড়াতে যাওয়ার হাজারো বিজ্ঞাপন দেখে এখানকার মানুষ ছুটি কাটাতে সেখানে যায়। আমাদের দেশে ওভাবে যায় না। ওরা জানেই না যে বাংলাদেশেও সুন্দর কোনো দর্শনীয় স্থান রয়েছে। আমাদের ইচ্ছা আছে কক্সবাজার, সুন্দরবনসহ সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলোকে তুলে ধরা। আরেকটি কথা আমি সব সময় বলি ‘আমাদের দেশের মানুষেরা আতিথেয়তায় শ্রেষ্ঠ’। এই বিষয়গুলো তুলে ধরতে চাই আমরা। এবং ইতিমধ্যে আমরা এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছি। আরেকটি কথা যেটা না বললেই নয়, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের ধারণা ‘ওহ না না বিদেশির সঙ্গে সংসার করতে পারবে না! বিদেশি হলেই মনে হয় খুব খারাপ’। আমাদের দেশে এ নিয়ে একটি ভুল ধারণা আছে। না না বিদেশি মানুষ হলে ভালো না। এই ভুল ধারণাটা আমরা ভাঙতে চাই। সবার আগে হচ্ছে মানুষ। সে দেশি কিংবা বিদেশি। এক দেশের মানুষ ভালো আরেক দেশের মানুষ খারাপ এমন কোনো কথা নেই। ছোট বয়স থেকেই এটা শুনে এসেছি। তিনি বলেন, করোনা মহামারি শেষ হলে আগামী ডিসেম্বর বা জানুয়ারি মাসে আমরা দেশে আসবো। এছাড়া আমাদের চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার যখন এক লাখ হয়েছিল তখন আমরা বাংলাদেশি চার বছর বয়সী ফাতিহা নামে একটি শিশুর ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছি। প্রতি মাসেই ওর ভরণপোষণের খরচ আমরা দিচ্ছি। এবং পরবর্তী চার বছর এটা চালিয়ে যাবো। আমাদের ইচ্ছা আছে দেশে গেলে ওর সঙ্গে দেখা করবো। ফাতিহার সঙ্গে আমাদের চিঠি আদান-প্রদান হয়। সম্প্রতি ও আমাদের একটি ছবি একে পাঠিয়েছে। শেহওয়ার বলেন, মারিয়া নিজে নিজেই বাংলা শিখেছেন। একাধিক ভাষায় কথা বলতে পারেন। মারিয়ার মতে, বাংলা অনেক বেশি মিষ্টি ভাষা। মারিয়া বাংলায় গান গাইতে, কবিতা আবৃত্তি করতে পারেন। একুশে ফেব্রুয়ারির দিন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো‘ এই গানটি আমি গেয়েছি।