মুশতাক কুমিরের প্রতি দুর্বল ছিলেন| এমন মৃত্যু হবে এটা স্বপ্নবাজ মুশতাক কোনদিন বুঝতে পারেননি। মুশতাক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত নয় কিন্তু কারাগারেই মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে। কাশিমপুর থেকে সরাসরি আজিমপুর। রাষ্ট্র এখন নিশ্চিত হয়েছে মুশতাক আর রাষ্ট্রের বিপদের কারণ হবে না। যারা ভয়ংকর মুশতাককে আবিষ্কার করতে পেরে মামলা দায়ের করেছেন, জামিন অযোগ্য বলে জামিন আবেদন বাতিল করেছেন সবাই প্রশংসা যোগ্য কাজ করেছেন। সরকার নিশ্চয়ই তাদের পুরস্কৃত করবে।
এমনটা ঘটবে বুঝতে পারলে এ রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে তিনি বিদেশ থেকে ফিরে আসতেন না। পায়জামা পাঞ্জাবি পরা অবস্থায় বাসা থেকে বের হয়েছিলেন কারাগারের উদ্দেশ্যে। ফেরত এলেন কাফনের কাপড় পরে।
নাগরিক কথা বললে বা কলমে কিছু লিখলেই রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি তলিয়ে যায় আর নাগরিক খুন হলে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। এ কোন রাষ্ট্রের আবির্ভাব। দীর্ঘদিন কারাগারে আটক রেখে শারীরিক-মানসিকভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার কৌশল হত্যারই নামান্তর।
নাগরিকের জন্য রাষ্ট্র। কিন্তু সেই রাষ্ট্রের নাগরিক বিনা বিচারে রোষানলে পড়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে অথচ রাষ্ট্র তাঁর পাশে দাঁড়াবে না সেটা তখন আর রাষ্ট্র থাকেনা। মুশতাক আহমেদ কারাগার থেকে মুক্তি পায়নি, জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছে। এ রাষ্ট্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্র নয়। এ রাষ্ট্র, ক্ষমতাসীনদের রাষ্ট্র, জনগণের নয়। এই নিষ্ঠুর রাষ্ট্রের উপস্থিতির জন্য মানুষ আত্মত্যাগ করেনি।
মুশতাক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আইনের আশ্রয় লাভ করতে পারেনি। সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। কল্পিত অভিযোগের কারণে রাষ্ট্রের আইন আদালত তাকে সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। রাষ্ট্রের এই অবহেলা, রাষ্ট্রের এই নৃশংসতা মুশতাকের দেহমন কুলাতে পারেনি। ফলে তাঁর দেহ থেকে আত্মা উড়াল দিয়েছে ঊর্ধ্ব আকাশে।
এই মৃত্যু প্রমাণ করছে মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্র প্রতিস্থাপন করে ফেলেছে এক নিষ্ঠুর রাষ্ট্র। উপরে উন্নয়নের আচ্ছাদন আর ভিতরে নিষ্ঠুরতার মধ্যযুগীয় বর্বরতা। বাইরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর ভিতরে হত্যা, জুলুম, অন্যায়, অমানবিক ও বেআইনি কর্মকাণ্ডের মহড়া। এই রাষ্ট্র ভয়াবহ ও নির্মম।
আজ বাংলাদেশে একটি সত্য কথা বললেই সরকার মনে করে তার বিরুদ্ধাচরণ করা হচ্ছে। এ সরকার সমাজকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে, সমাজের অভ্যন্তরে পচন ধরিয়ে দিয়েছে। সুতরাং বিবেকবান মানুষ এই সরকারের হত্যা, জুলুম এবং অমানবিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করছে এবং করবে। সরকার যে মিথ্যার আবাদ করছে তার বিপরীতে শক্ত অবস্থান নিয়ে সত্যকে তুলে ধরতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সমাজ সত্য প্রকাশের অঙ্গীকার থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। সরকারের অন্যায় ও নির্মম নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণ মানুষের নিরন্তর সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।
শিল্পীর দায় ও সমাজ সম্পর্কে সৈকত হাবিব বলেছেন, একজন মহৎ শিল্পী সব সময় তার সমাজ, মানুষ ও বিশ্বের প্রতি সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিগত সামাজিক দায় বহন করেন। কখনো কখনো এই দায় সেই শিল্পীকে তার সমাজের বিরুদ্ধে তীব্র দ্বন্দ্বে লিপ্ত করে। তাঁর উপর নেমে আসে অবিচার ও নির্যাতন। সেখানে তার প্রতিপক্ষ হিসেবে আসে ক্ষয়িষ্ণু ঘুনে ধরা কায়েমি সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র, বণিক এবং তাবৎ বিদ্যমান ব্যবস্থা রক্ষাকারীর দল। আর মানবতাবাদী দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও প্রতিবাদী শিল্পীরা এ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলতে চান। কারণ তারা জানেন এসব ব্যবস্থার ফলে পৃথিবীর ইতিহাসে এমন সময় খুবই কম এসেছে, যে সময় মানুষ সার্বিকভাবে, সত্যিকার অর্থে মহৎভাবে বেঁচেছে। বরং মানুষের ইতিহাস পক্ষান্তরে নিরন্তর সংগ্রামেরই ইতিহাস -অন্যায়, অসত্য, শোষণ-নির্যাতন, বঞ্চনা ও ক্ষুধা-দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে আত্মপ্রতিষ্ঠার ও মানবিকতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ইতিহাস। আর এ সংগ্রাম যতোটা না প্রাকৃতিক শক্তির বিরুদ্ধে তার চেয়েও অনেক বেশি মানুষেরই বিরুদ্ধে- একশ্রেণীর বিরুদ্ধে আরেক শ্রেণীর মানুষের। এই মানবিক সংগ্রামে শিল্পীকে প্রথমত একজন মানুষ হিসাবে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হয়; দ্বিতীয়তঃ একজন শিল্পী হিসেবে তার ওপর দায় অর্পিত হয়। কেননা একজন শিল্পী তার সময়ের সবচেয়ে মেধাবী, প্রাজ্ঞ, অনুভূতিশীল ও মহৎ গুণ সম্পন্ন মানুষের অন্যতম। এই জন্য একজন শিল্পীর মানসে সামাজিক প্রপঞ্চগুলো সবচেয়ে বিশ্বস্ত ভাবে ধরা দেয়। যুগে যুগে দেখা গেছে সমাজের আন্তঃকাঠামো, সামাজিক মানুষের বিভিন্ন আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন ও বাস্তবতা শিল্পীর চোখেই গভীরভাবে প্রতিভাত হয়েছে। এবং এই গভীর দেখার ক্ষমতা বলেই শিল্পী সমাজের ক্ষত পচন বা বৈসাদৃশ্যগুলো নিবিড় ভাবে লক্ষ্য করেন, যা থাকে সমাজের আপাত চাকচিক্যের অন্তরালে, খুব গভীরে, উপরিকাঠামোর বিপরীতে একেবারে শেকড়ে প্রোথিত।
মুশতাক রাষ্ট্রের প্রপঞ্চকে গভীরভাবে দেখতে পারার কারণে মৃত্যুকে তাঁর আলিঙ্গন করতে হয়েছে। রাষ্ট্রের অন্যায় ও অবিচার এর বিরুদ্ধে লেখক, সাংবাদিক, সমাজ ও গণমানুষকে অবশ্যই সোচ্চার হতে হবে।
মুশতাক ছাত্রজীবনে কোন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না। বিদেশেও লেখাপড়া করেছেন। কোথাও তার বিরুদ্ধে কারো কোন অভিযোগ নেই। মুশতাক জামিনের অধিকার পান নি। বারবার আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন, কিন্তু মুক্তি মেলেনি। কি ভয়ানক আজকের এই সমাজ বাস্তবতা। রাষ্ট্র এখন কারো কারো জন্য তবে সবার জন্য নয়। সরকারকে অবশ্যই তার কৃতকর্মের দায়-দায়িত্ব নিতে হবে।
বিগত ১২ বছর ধরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উত্থাপিত বিভিন্ন বিষয়কে সরকার তথাকথিত চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দিচ্ছে আর মুশতাক এর মত একজন কেতাদুরস্ত বোহেমিয়ান চরিত্রের মানুষকে সরকার মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হবে একথা বিশ্বাস করলে সরকারের প্রতি সবচেয়ে বড় অবিচার হবে। সরকার এখানেও সফল হয়েছে। এর মাঝ দিয়ে সরকার আবারো একটি বার্তা সফলভাবে দিতে সমর্থ হয়েছে যে ভবিষ্যতে যে কাউকে মুশতাকের মত ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে।
রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির নামে মানুষ হত্যার নানান বয়ান সরকারকে অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। মানুষের গভীর সমাজ চেতনা, দর্শন ভাবনা, সাহিত্য শিল্পকলা কবিতা আর গান এগুলো অপরাধের উপাদান নয়। সমাজের গভীর ক্ষত প্রকাশ করলেই সরকার পাশবিক হয়ে উঠবে এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায়না। সত্যের প্রতি অবিচল থাকা কোন ষড়যন্ত্র নয়। মানুষকেই সত্যের উপস্থাপক হতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন ছড়াতে হবে। সরকার সংবিধান ও আইনের নিশ্চয়তা দিচ্ছে না। রাষ্ট্রের সাংবিধানিকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান নাগরিকগণের অভিভাবকত্ব গ্রহণের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। ফলে বিচার বিভাগসহ সাংবিধানিক অধিকার পাবার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না।
লেখক: গীতিকার
২৭.০২.২০২১
[email protected]