× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নিঃসন্তান বিধবা বৃদ্ধা আয়শার কপালে জোটেনি সরকারি ঘর মাথা গোঁজার ঠাঁই কেড়ে নিতে চায় প্রতিবেশীরা

বাংলারজমিন

মাহামুদুন নবী, মহম্মদপুর (মাগুরা) থেকে
৮ মার্চ ২০২১, সোমবার

হতভাগ্য নিঃসন্তান বিধবা আয়শার কপালে জোটেনি সরকারি একখানা ঘর। বয়ষ্ক ভাতা অথবা বিধবা ভাতা থেকেও বঞ্চিত তিনি। স্বামীর ভিটেয় একমাত্র মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও কেড়ে নিতে চায় প্রতিবেশীরা। এমনই এক হতভাগ্য নারীর নাম আয়শা খাতুন। বয়স (৬৫), স্বামী মারা গেছেন প্রায় ১০ বছর আগে। বাবা-শ্বশুরবাড়ির প্রায় সবাই মারা গেছেন। স্বামীর ছোট্ট ভিটেয় একটি ভাঙাচোরা জরাজীর্ণ ঘরে একাই বসবাস করেন তিনি।
শেষ সম্বল স্বামীর বসতভিটার জমি কেড়ে নিতে মরিয়া প্রতিবেশীরা।
এখন তাকে সমাজে একঘরে করে রেখেছে। তার সঙ্গে কেউ কথা বলেন না। এমনকি সম্পর্ক রাখেন না আশেপাশের লোকজনও। স্বামীর ভিটে থেকে উচ্ছেদ করতে মারধর থেকে শুরু করে ঘরে আগুন দেয়াসহ চালাচ্ছেন নানা রকম অত্যাচার-নির্যাতন। বিচারের আশায় সমাজপতিদের দ্বারে-দ্বারে ঘুরলেও তার সঙ্গে নেই কেউ।
অসহায় এই নারীর বাড়ি মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার দীঘা ইউনিয়নের জনার্দ্দনপুর গ্রামে।
মহম্মদপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার পাড়ি দেবার পর নিভৃত গ্রাম জনার্দ্দনপুরে গিয়ে মিললো তার দেখা। বাড়ি খুঁজে পেতে কষ্ট হয় না। এক নামে আয়শা খাতুনকে সবাই চেনেন। ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে নির্বাক হয়ে বসে ছিলেন বৃদ্ধা আয়শা খাতুন।
ঘর বলতে কাদামাটির তৈরি ডোয়া। জরাজীর্ণ পাটকাঠির বেড়া। ঘরজুড়ে ইঁদুরের বসতি। জীর্ণ বেড়া খসে খসে পড়ছে। ভেঙে যাচ্ছে মাটির ডোয়া। গত বছর ঝড়ে টিনের চালটি উড়ে যায়। কোনমতো চালটা আবার বসিয়ে রেখেছেন। বাতাস আসলে যেকোনো সময় আবার পড়ে যেতে পারে। ঘরের মেঝেতে চট বিছিয়ে ঘুমান আয়শা।
জানতে চাইলাম তার সম্পর্কে। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে শুরু করলেই দেখা গেলো আয়শা খাতুনের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে দরদর করে বেয়ে। বাকরুদ্ধ তিনি। কিছুক্ষণ পর বলতে শুরু করলেন তার জীবন-সংগ্রাম আর অসহায়ত্বের গল্প।
স্বাধীনতার পর ১২ বছর বয়সে আয়শার বিয়ে হয়। তার বাবার বাড়ি মহম্মদপুর উপজেলার বালিদিয়া ইউনিয়নের ছোট কলমধারী গ্রামে। অভাব আর দারিদ্র্যতা নিয়েই তার জন্ম। বিয়ে হয় ওয়াজেদ শেখের সঙ্গে। ওয়াজেদ ভূমিহীন কৃষি শ্রমিক। স্বামীর চৌদ্দ শতক জমির ওপর বসতভিটায় তিনি একা বাস করেন।
এই একখ- জমিই এখন তার বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিঃসন্তান এই বৃদ্ধার জমিটুকুর ওপর প্রতিবেশীসহ অনেকের লোলুপ দৃষ্টি। দশ বছর আগে স্বামী মারা যান।
স্বামীর মৃত্যুর পর আরো অসহায় হয়ে পড়েন তিনি। বাবা-শ্বশুর বাড়ির পক্ষের তাকে দেখার আর কেউ নেই।
প্রতিবেশী কয়েকজন তাকে একঘরে করেছেন বলে তিনি জানান। তার সঙ্গে কেউ কথা পর্যন্ত বলেন না। কয়েকদিন আগে গভীর রাতে তার ঘরের বেড়ায় কে বা কারা আগুন ধরিয়ে দেয়। টের পেয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলায় এ যাত্রায় বেঁচে যান তিনি। ঘরের বেড়ায় আগুনের পোড়া চিহ্ন এখনো স্পষ্ট। গভীর রাতে ঘরে ঢুকে তাকে বাড়ি ছাড়ার জন্য ভয় দেখান বলে অভিযোগ করেন তিনি।
আয়শা খাতুন জানান, আমার কেউ না থাকায় সবাই জমিটুকু দখল করতে চান। তিনি স্বামীর ভিটায় মরতে চান। কোথাও যেতে চান না। এমনকি জমি বিক্রি করতে চান না। জমি দিতে না চাওয়ায় প্রতিবেশী কয়েকজন তাকে উচ্ছেদ করার জন্য নানা হয়রানি ও অত্যাচার করছেন। কয়েক বছর আগে থানায় অভিযোগ করেও তিনি প্রতিকার পাননি। অসহায়-দরিদ্র হওয়ায় সমাজপতিরা তার সঙ্গে কেউ নেই বলে তিনি জানান। অন্যের বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি।
আয়শা খাতুন বলেন, শুনছি সরকার ঘর বানায় দিচ্ছে। আমার বাড়ির আশপাশে বড় লোকেরা ঘর পাইছে আমারে কেউ দেয় না। চেয়ারম্যান-মেম্বরগের পাছে বছরের পর বছর দোড়োইছি কোন লাভ হই নেই। বয়স্ক-বিধবা বা দশ টাহার চালির কার্ড কোনডাই আমার কপালে জুটি নেই।
গত বছর ঝড়ে ভাঙে পড়া ঘর আর সারতি পারি নেই। আমার এটটা সরকারি ঘর খুবই দরকার। সারবো যে আমার কোনো টাহা-পয়সা নাই। ঘরডা পড়ে গিলি ভিটেততে আমারে উচ্ছেদ করে দিবেনে। আপনারা সরকাররে এটটু কবেন আমারে যেন এটটা ঘর বানায় দেয়।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রউফ মিয়া জানান, নিঃসন্তান বিধবা আয়শা নিদারুণ কষ্টে আছেন। তার স্বামীর বসতভিটার ওপর অনেকের লোভ। অসহায় এ নারীকে দেখার কেউ নেই। নিদারুণ কষ্টে আছেন তিনি। তার একটা সরকারি ঘর খুবই দরকার।
আয়শার বাড়ি জর্নাদ্দনপুর এলাকার দীঘা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও বর্তমানে প্যানেল চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা খোকন মিয়া জানান, আয়শা খাতুনের বিষয়টি তিনি জানেন। অল্পদিন হলো চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন। অসহায় ও নারীর নিরাপত্তা ও সরকারি সহযোগিতা দেয়ার জন্য তিনি তৎপর হবেন বলে জানান।
মহম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) তারক বিশ্বাস বলেন, বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে দেখবো। তার সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন বলে জানান তিনি।
কথা শেষ করে আয়শা খাতুনের বাড়ি থেকে পা বাড়ালাম। আবার ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে শূন্যে দৃষ্টি তার। নির্বাক অবয়বে অসংখ্য জিজ্ঞাসা- শেষ জীবনে তাকে কে দেখবে। কোথায় যাবেন, কার কাছে যাবেন তিনি- ‘নিঃসন্তান বিধবা বৃদ্ধা আয়শার কেউ নেই।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর