রিকশাচালক জীবন সর্দার প্যাডেলে লম্বা টান মেরে সগর্বে বললো, এবার আমাদের একজন প্রার্থী হয়েছে। হাওড়া থেকে কাটোয়া লোকালে সওয়ার হয়ে এসে পৌঁছেছি ত্রিবেণীর কাছে বলাগড়ে। এই বিধানসভা আসনেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রার্থী করেছেন একদা রিকশা চালক মনোরঞ্জন ব্যাপারীকে। সেই মনোরঞ্জন ব্যাপারীর সঙ্গে কথা বলতে এসেছি বলাগড়ে সম্পাদকের নির্দেশ শিরোধার্য করে। জীবন সর্দারের রিকশা পৌঁছে দিলো মনোরঞ্জন ব্যাপারীর খোলার ঘুপচি ঘরে। তাঁর সম্পর্কে বাংলাদেশের আগ্রহের কথা বলতেই মনোরঞ্জন বাবু বললেন, আগ্রহ তো হবেই, আমার জন্ম যে আইতে শাল যাইতে শাল বরিশালে সেই উনিশশো পঞ্চাশে। আমি তো ওপার বাংলার উদ্বাস্তু। একটা মিছিল চলে গেল মনোরঞ্জন ব্যাপারীর বাড়ির সামনে দিয়ে।
তৃণমূলের ছোট মিছিল। স্লোগান উঠলো, বহিরাগতকে মানছি না, মানবো না। দুহাজার ষোলোর ভোটে বলাগড় থেকে প্রার্থী ছিলেন তৃণমূলের অসীম মাঝি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবার প্রার্থী বদলে দিয়েছেন। অসীম মাঝির জায়গায় মনোরঞ্জন ব্যাপারী। মনোরঞ্জন বাবু জানালার ঘুলঘুলি দিয়ে মিছিলটা দেখে বললেন, একটু আধটু এরকম হয়। সব মিটে যাবে। বলতে বলতে মনোরঞ্জন বাবুর অনুগামীরা হইচই করে এসে হাজির। ঠিক হলো, মঙ্গলবার থেকে প্রচার শুরু করবেন মনোরঞ্জন ব্যাপারী। তিন বছর বয়সে যিনি বাবা-মায়ের হাত ধরে উদ্বাস্তু হন। প্রথম জায়গা হয় বাঁকুড়ার শিরোমনিপুরের উদ্বাস্তু ক্যাম্পে। এরপর দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ঘোলাদোলতলা ক্যাম্প হয়ে দ-কারণ্যে। এখানেই নক্সাল নেতা শঙ্কর গুহনিয়োগীর সঙ্গে পরিচয় ও সঙ্গ। তার আগে জীবিকার সন্ধানে চৌদ্দ বছরের কিশোরের গৃহত্যাগ ও নানা পেশায় আসাম, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশে ঘুরে বেড়ানো। মনোরঞ্জন বাবু তাঁর বাঁখারির চাঁটাইয়ে বসে বললেন, শঙ্কর গুহনিয়োগীর সান্নিধ্য আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো। দলিতদের কথা বুঝতে শিখলাম। জানলাম সম্পন্ন উদ্বাস্তুদের জন্যে একরকম আর নিঃসম্বল উদ্বাস্তুদের জন্যে আর একরকম ব্যবহার হয়। দু মুঠো অন্ন জোগানোর জন্যে রাঁধুনির কাজ। ডোমের কাজ করেছেন মনোরঞ্জন বাবু। দু’বছর জেল খাটার সময় লিখতে পড়তে শিখেছেন। বেরিয়ে এসে রিকশা চালানোকে পেশা করেছেন। আর মনের আনন্দে দলিতদের কথা লিখে গেছেন। একদিন তাঁর রিকশার সওয়াব হয়ে তাঁর কথা শোনেন মহাস্বেতা দেবী। তিনি মনোরঞ্জন ব্যাপারীকে তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা বর্তিকায় লেখার সুযোগ দেন। মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় অনুবাদ করেন তাঁর লেখা আমার চ-াল জীবন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনোরঞ্জন ব্যাপারীকে দলিত সাহিত্য একাডেমির সভাপতি করেন। তারপর রিকশাচালক মনোরঞ্জন আজ নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী। বিধায়ক হলে কি করবেন? উদাস গলায় ঘুঘু ডাকা দুপুরে রিকশাচালক উত্তর দিলেন, দলিতদের মুখে মাংস ভাত না হোক দুটো শাকভাত যাতে পড়ে দিদির সেই কাজে সাহায্য করবো। জীবন সর্দারের রিকশাতে বলাগড় স্টেশনে ফিরতে ফিরতে ভাবছি। দ-কারণ্যে জমি জায়গা করা মনোরঞ্জন ব্যাপারী বলাগড় এ রিকশা চালাচ্ছেন বারো বছর। আর দুবছর হলে রামচন্দ্রের বনবাসের কাল শেষ হত। সম্বিত ফিরলো জীবন সর্দারের কথায়- এবার আমাদের দিন আসবে। আমাদের একজনকে ভোটে জেতাতেই হবে। ভোঁ শব্দ তুলে হাওড়াগামী ডাউন কাটোয়া লোকাল আসছে। দলিত মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার ধোঁয়া যেন গলগল করে স্টিম ইঞ্জিনের চিমনি দিয়ে বের হচ্ছে।